চীনের এক দশক ধরে থাকা বিতর্কিত ‘এক সন্তান’ নীতির পরিবর্তন হয় ২০১৬ সালে। ভবিষ্যতে দেশটির কর্মক্ষম লোকের সংখ্যা কমে যাওয়ার আশঙ্কায় তখন দুই সন্তান নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। কিন্তু এরপরও আশানুরূপ হারে জনসংখ্যা বাড়েনি। পরে আবার তিন সন্তান নীতি প্রণয়ন করে। এরপরেও বাড়ছে না। চীনের জনসংখ্যা রেকর্ড হারে কমছে। কমার হারটা এতই যে নামতে নামতে গত কয়েক দশকের রেকর্ড ছুঁয়ে ফেলেছে।
ন্যাশনাল ব্যুরো অব স্ট্যাটিসটিকস সোমবার এ বিষয়ে নতুন একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে, চীনের মূল ভূখণ্ডে ২০২১ সালে প্রতি এক হাজারে সন্তান জন্মদানের হার ছিল মাত্র ৭ দশমিক ৫২ শতাংশ। খবর আল জাজিরার।
দেশটিতে দীর্ঘদিন ধরে চলা এক সন্তান নীতির কারণেই মানুষের মধ্যে সন্তান জন্মদানের আগ্রহ কমেছে। যদিও সরকার এই নীতি তুলে নিয়ে দম্পতিদের তিনটি পর্যন্ত সন্তান নেওয়ার অনুমোদন দিয়েছে। কিন্তু তারপরেও পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না।
অথচ ২০২০ সালেও ১ হাজারে চীনে জন্মহার ছিল ৮.৫২ জন।
সংখ্যার দিক থেকে চীনে ২০২১ সালে জন্মেছে ১ কোটি ৬ লাখ ২০ হাজার শিশু। অথচ ২০২০ সালে সংখ্যাটি ছিল ১ কোটি ২০ লাখ।
এ ছাড়া ২০২১-এ চীনের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ০.০৩৪ শতাংশ। ১৯৬০-এর পর এ হার সর্বনিম্ন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, চাকরি ও স্বাধীনতাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া এবং জীবনধারণের খরচ বেশি হওয়ার কারণে চীনে দম্পতিদের মধ্যে সন্তান জন্মদানে আগ্রহ কম বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।
বিশ্লেষকদের মতে, দেশ উন্নত হওয়ার সাথে সাথে শিক্ষা বা ক্যারিয়ারের মতো অন্যান্য অগ্রাধিকারের কারণে জন্মের হার হ্রাস পায়।
উদাহরণস্বরূপ— চীনের প্রতিবেশী জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়াতেও দম্পতিদের আরও বেশি সন্তান নিতে সরকার নানা কর্মসূচি নিয়েছে। এরপরও, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ওই দুই দেশে জন্মহার কমেছে।
দেশটিতে দীর্ঘদিন ধরে চলা এক সন্তান নীতির কারণেই মানুষের মধ্যে সন্তান জন্মদানের আগ্রহ কমেছে। যদিও সরকার এই নীতি তুলে নিয়ে দম্পতিদের তিনটি পর্যন্ত সন্তান নেওয়ার অনুমোদন দিয়েছে। কিন্তু তারপরেও পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে চীনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমও জনসংখ্যার প্রবৃদ্ধি নিয়ে তাদের দুশ্চিন্তার কথা ধারাবাহিকভাবে জানিয়ে যাচ্ছে। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী আগামী কয়েক বছরের মধ্যে চীনের মূল ভূখণ্ডে জনসংখ্যা সংকুচিত হওয়া শুরু করতে পারে।
জাতিসংঘের অনুমান, চীনের মূল ভূখণ্ডের জনসংখ্যা ২০৩০ সালে শিখরে পৌঁছাবে, এরপর থেকে নামতে শুরু করবে।
কয়েক দশকের এক সন্তান নীতি ২০১৬ সালে বাতিল করে চীন। এরপরেই দম্পতিদের দুটি করে সন্তান নেওয়ার অনুমোদন দেওয়া হয়। দেশটিতে দীর্ঘদিন এক সন্তান নীতির প্রচলনের কারণে সেখানে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা দ্রুত বেড়ে যাচ্ছিল।
এ অবস্থায় ভারসাম্য টিকিয়ে রাখতে সরকার দুটি সন্তান নেওয়ার অনুমোদন দেয়। কিন্তু বেশির ভাগ দম্পতিই এতে সাড়া দেয়নি। শহুরে জীবনে ব্যয় অনেক বেশি হওয়ায় তারা সন্তান নেওয়ার বিষয়ে আগ্রহী নন।
এর আগে ১৯৪৯ সালে জন্মহার ছিল সর্বনিম্ন। ওই বছর থেকেই এ বিষয়ে তথ্য রাখা শুরু করে ন্যাশনাল ব্যুরো অব স্ট্যাটিসটিকস। ওই পরিসংখ্যানে বলা হয়, অভিবাসী বাদে চীনের জনসংখ্যার স্বাভাবিক বৃদ্ধি ২০২১ সালে ছিল মাত্র ০.০৩৪ শতাংশ। ১৯৬০ সালের পর এ হার ছিল সর্বনিম্ন।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর মতে, ২০২১ সালে জন্মহার যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে, তা ১৯৪৯ সালের পর সর্বনিম্ন। পিনপয়েন্ট অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের প্রধান অর্থনীতিবিদ ঝিওয়েই ঝাং বলেন, চীনে জনসংখ্যাতত্ত্বের চ্যালেঞ্জ সুপরিচিত। কিন্তু প্রত্যাশার চেয়ে যে, বয়স্কদের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে সে বিষয়টি পরিষ্কার।
ধারণা করা হচ্ছে, ২০২১ সালে চীনের মোট জনসংখ্যা হয়তো সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছেছে। আরও ইঙ্গিত মেলে যে, প্রত্যাশার চেয়ে প্রবৃদ্ধি অর্জন হচ্ছে অধিক ধীরগতিতে। উল্লেখ্য, ২০২১ সালে চীনে মোট শিশু জন্ম নিয়েছে এক কোটি ৬ লাখ ২০ হাজার। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০২০ সালে এই সংখ্যা ছিল এক কোটি ২০ লাখ। ওই বছর প্রতি এক হাজারে জন্মহার ছিল ৮ দশমিক ৫২ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চীনের সামাজিক পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। কারণ, বিয়ের জন্য উপযুক্ত পাত্রী খুঁজে পাওয়া চীনের পুরুষদের পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক পুরুষই পারিবারিক জীবন শুরুর কথা ভাবতে পারছেন না।
জনসংখ্যার বৃদ্ধি কমাতে ১৯৭৯ সালে চীনে এক সন্তান নীতি চালু হয়। এ কারণেই দেশটিতে এমন সংকট দেখা দিয়েছে বলে মত রয়েছে। বিশ্বের বেশির ভাগ দেশের মতো চীনা সমাজব্যবস্থাতেও মেয়েসন্তানের চেয়ে ছেলেসন্তান বেশি আকাঙ্ক্ষিত। চীনে এক সন্তান নীতির কারণে অনেক দম্পতিই গর্ভপাত ঘটান।
ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরসের সোশিওলজি ডিপার্টমেন্টের ড. মু ঝেং বলেন, লৈঙ্গিকবৈষম্যের কারণে বিয়ের ক্ষেত্রে কনে পেতে সংকটে পড়েছেন পুরুষেরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এক সন্তান নীতিতে বদল আনলেও চীনে শিশুদের শিক্ষা বা সামাজিক সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকার কোনো পরিকল্পনা নেয়নি। আর্থিক কোনো প্রণোদনাও দেওয়া হয়নি।
বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, জীবনযাপনের খরচ বেড়ে যাওয়ায় চীনে শিশুদের লালনপালনের ব্যয়ভার অনেকেই নিতে চান না।
ড. মু বলেন, উন্নত শহরগুলোতে মানুষের জীবনে সাফল্য নিয়ে ভাবনায় বদল এসেছে। সন্তান লালনপালনের ব্যয়ভারের কারণে অনেকে সন্তান নিতে অনাগ্রহ দেখাচ্ছেন। বিয়ে ও সন্তান জন্মের চেয়ে জীবনযাত্রার মান উন্নত করাকে সাফল্য হিসেবে মনে করছেন অনেকে।
চীনে নারীদের সন্তান না নিতে চাওয়ার পেছনে আরও কারণ রয়েছে। বেশির ভাগ দেশের মতো চীনেও সমাজব্যবস্থার কারণে সন্তান লালনপালনের ভার নারীদের ওপরই থাকে।
ড. মু বলেন, সন্তান লালনপালনের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অনেক নারীই পেশাগত জীবনে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এমন আশঙ্কা করে থাকেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেইজিং ও সাংহাইয়ের মতো উন্নত শহরগুলোতে যেসব নারী বসবাস করেন, তারা দেরিতে সন্তান নিতে চান। অথবা সন্তানের জন্ম দিতে চান না। কিন্তু যেসব নারী গ্রামাঞ্চলে থাকেন, তাদের পরিবার এখনো বড়।
সংশ্লিষ্ট বিষয়ে নীতিনির্ধারকদের একজন রয়টার্সকে বলেছেন, যদি পরিবার পরিকল্পনা নীতি উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়, তাহলে গ্রামাঞ্চলে সন্তান জন্মের হার বেড়ে যাবে। এতে গ্রামাঞ্চলে দারিদ্র্য বাড়বে। বেকারত্ব তৈরি হবে।
তবে জিয়ান জিয়াওটং ইউনিভার্সিটির জনসংখ্যাতাত্ত্বিক ড. জিয়াং কুয়ানবাও বলেন, সন্তান লালনপালন ও শিক্ষার জন্য পরিবারগুলো প্রণোদনা পেলে পরিস্থিতি বদলাতে পারে। এখনো আশা আছে। খুব বেশি দেরি হয়ে যায়নি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯০৬
আপনার মতামত জানানঃ