প্রশান্ত মহাসাগরের নিচে এক আগ্নেয়গিরিতে বিশাল অগ্ন্যুৎপাতের পর সুনামির বিরাট ঢেউ এসে আঘাত হেনেছে দ্বীপরাষ্ট্র টোঙ্গাতে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করা ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে একটি চার্চ এবং কয়েকটি বাড়ির ভেতর পানির স্রোত বয়ে যাচ্ছে । প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, টোঙ্গার রাজধানী নুকুয়ালোফার আকাশ থেকে আগ্নেয়গিরির ছাই পড়তে দেখা যাচ্ছে।
দেশটিতে সুনামি সতর্কতা জারির পর লোকজন উঁচু স্থানে সরে যাবার জন্য ছোটাছুটি করছে। এই অগ্ন্যুৎপাত ঘটেছে হাঙ্গা টোঙ্গা-হাঙ্গা হাপাই আগ্নেয়গিরিতে। এটি পুরো দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলকে কাঁপিয়ে দিয়েছে।
টোঙ্গার ভূতাত্ত্বিক বিভাগ জানায়, গ্যাস, ধোঁয়া ও ছাইয়ের কুণ্ডলী আকাশের অন্তত ২০ কিলোমিটার পর্যন্ত ওপরে উঠে গিয়েছিল।
যোগাযোগ ও বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে টোঙ্গার মূল দ্বীপ। দুর্যোগকবলিত এলাকায় ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তার জন্য সেনাবাহিনী পাঠানো হয়েছে। তাৎক্ষণিকভাবে হতাহতের তথ্য পাওয়া যায়নি।
ফিজির রাজধানী সুভার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, অন্তত আট মিনিট স্থায়ী অগ্ন্যুৎপাত এত প্রচণ্ড ছিল যে এর শব্দ উৎপত্তিস্থল থেকে অন্তত ৮০০ কিলোমিটার দূরে ফিজি থেকে জোরালো বজ্রধ্বনির মতো মনে হয়েছে।
ফিজির সরকার একটি সুনামি সতর্কতা জারি করে উপকূলের নিচু স্থানগুলোতে বাসিন্দাদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র খুলেছে। ২৩০০ কিলোমিটার দূরবর্তী নিউজিল্যান্ড ঝড়ের সময়ের মতো ঢেউ হতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে।
একটি আগ্নেয়গিরি থেকে এই বিপদ ঘটলে ভাবুন, সাগরের তলদেশে অবস্থিত সবগুলো আগ্নেয়গিরিতে বিস্ফোরণ ঘটলে কী হতে পারে! হ্যাঁ আপনি ঠিকই ভাবছেন। ধ্বংস হতে পারে গোটা পৃথিবী।
অগ্ন্যুৎপাত বিশেষজ্ঞ জেস ফিনিক্স বিবিসিকে বলেছেন যখন আগ্নেয়গিরি থেকে উদগীরণ শুরু হয়, তখন উত্তপ্ত ম্যাগমা ভুগর্ভ থেকে ঠেলে ওপরে ওঠে। এর ফলে অপেক্ষাকৃত ঠাণ্ডা পাথরগুলো ভাঙতে শুরু করে, যার ফলে ঘটতে পারে ভূমিধস।
বিজ্ঞানীদের মাঝেই আছে বিতর্ক
যদিও সমুদ্রতলের আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের পর কী পরিস্থিতি হয়, তা নিয়ে বিজ্ঞানীদের মাঝেই বিতর্ক আছে। তবে গ্লোবাল ফাউন্ডেশন ফর ওশানিক এক্সপ্লোরেশন গ্রুপের মতে, আগ্নেয়গিরিসংক্রান্ত ঘটনাগুলোর চার ভাগের তিন ভাগই ঘটে সমুদ্রের তলদেশে।
হুঙ্গা-টোঙ্গা-হুঙ্গা-হা’আপায় আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতে প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপরাষ্ট্র টোঙ্গাতে সুনামি আঘাত হেনেছে। এমনকি জাপানের শিকোকু দ্বীপের দক্ষিণ উপকূলের কোচি প্রশাসনিক অঞ্চলে আঘাত হেনেছে মৃদু সুনামি, কিন্তু ঠিক কী কারণে সাগরতলের হুঙ্গা-টোঙ্গা-হুঙ্গা-হা’আপায়ের অগ্ন্যুৎপাতে সুনামির সৃষ্টি হলো?
কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জানুয়ারির ১৫ তারিখে হওয়া হুঙ্গা-টোঙ্গা-হুঙ্গা-হা’আপায়ের অগ্ন্যুৎপাত ঠিক কী কারণে সুনামির জন্ম দিল তা স্পষ্ট নয়।
আগ্নেয়গিরি বিশারদ ও বিজ্ঞানবিষয়ক সাংবাদিক রবিন জর্জ এন্ড্রুসের মতে, এটি কি অগ্ন্যুৎপাতে সৃষ্ট বিস্ফোরণের কারণে হয়েছে নাকি আগ্নেয়গিরির কোনো ধসে পানির স্থানচ্যুতি হয়েছে অথবা দুটির কারণেই হয়েছে। তা এখনও স্পষ্ট নয়।
তবে এন্ড্রুর মতে, হা’আপায়ে এ ধরনের বিস্ফোরণ হাজার বছরে একবারই হয়। আসলে সমুদ্রতলের আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের পর কী পরিস্থিতি হয়, তা নিয়ে বিজ্ঞানীদের মাঝেই বিতর্ক আছে।
হুঙ্গা-টোঙ্গা-হুঙ্গা-হা’আপায়ের মতো সাগরতলে প্রায় ১০ লাখ আগ্নেয়গিরি আছে। এসব আগ্নেয়গিরি শুধু লাভাই উদগিরণ করে না, ব্যাপক পরিমাণে আগ্নেয়গিরির ছাইও তৈরি করে।
গ্লোবাল ফাউন্ডেশন ফর ওশানিক এক্সপ্লোরেশন গ্রুপের মতে, আগ্নেয়গিরিসংক্রান্ত ঘটনাগুলোর চার ভাগের তিন ভাগই ঘটে সমুদ্রের তলদেশে। পানির নিচের আগ্নেয়গিরির কারণে সমুদ্র পর্বতও তৈরি হয়।
এদিকে হুঙ্গা-টোঙ্গা-হুঙ্গা হা’আপাই আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতে বিভিন্ন দেশে সুনামি সতর্কতা জারি করা হয়েছিল। উপকূলীয় এলাকা থেকে জনগণকে সরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছিল জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড।
তবে বড় আকারের সুনামি শুধু টোঙ্গাতেই আঘাত হেনেছে। এতে কোনো প্রাণহানির খবর পাওয়া যায়নি। যোগাযোগব্যবস্থা ব্যাহত হওয়ার কারণে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও জানা সম্ভব হচ্ছে না।
কী হয়েছিল সবচেয়ে ভয়াবহ অগ্ন্যুৎপাতে?
১৮৮৩র অগাস্ট মাসে ক্র্যাকাতোয়ায় যে অগ্ন্যুৎপাত হয়েছিল তা পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম সবচেয়ে ভয়াবহ অগ্ন্যুৎপাত হিসাবে নথিভুক্ত হয়ে আছে।
আঘাত হেনেছিল বিশাল সুনামি, যেখানে জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা ছিল ১৩৫ ফুট (৪১ মিটার)। প্রাণ হারিয়েছিল ৩০ হাজার মানুষ।
তপ্ত ছাইয়ে প্রাণ হারিয়েছিল আরও হাজার হাজার মানুষ। ওই উদগীরণের তেজ ছিল ২০০ মেগাটন ওজনের টিএনটি বিস্ফোরণের সমতুল্য- যা ১৯৪৫ সালে হিরোশিমায় ফেলা পারমাণবিক বোমার শক্তির তুলনায় ১৩,০০০ গুণ বেশি।
হাজার হাজার কিলোমিটার দূর থেকে ওই উদগীরণের শব্দ শোনা গিয়েছিল। ওই অগ্ন্যুৎপাতের পরের বছর বিশ্বের তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি কমে গিয়েছিল। আগ্নেয়গিরির কারণে দ্বীপটি পুরো নিশ্চিহ্ণ হয়ে গিয়েছিল।
এসডব্লিউ/এসএস/১৫৫০
আপনার মতামত জানানঃ