দেশেই থাকবেন নাকি দেশ ছেড়ে চলে যাবেন; তুরস্কের বহু মানুষের কাছে এটা এখন এক জটিল প্রশ্ন। এধরনের লোকের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে যাদের অনেকেই বয়সে তরুণ। তুরস্কে ২০২০ সালে চালানো এক জরিপে দেখা গেছে ৭০ শতাংশেরও বেশি তরুণ দেশ ছেড়ে চলে যেতে আগ্রহী। ভেঙে পড়েছে অর্থনীতি। দেশটিতে বাড়ছে রাজনৈতিক চাপ।
যে কারণে দেশ ছাড়তে চাইছে তরুণরা
সরকারি পরিসংখ্যানে দেখা যায়- যারা তুরস্ক ছেড়ে চলে যেতে চান তাদের বেশিরভাগেরই বয়স ২৫ থেকে ২৯।
দেশটির ২০২০ সালের অভিবাসন সংক্রান্ত তথ্য গত সেপ্টেম্বর মাসে পরিসংখ্যান ইন্সটিটিউটের পক্ষ থেকে প্রকাশ করার কথা ছিল যা স্থগিত করা হয়েছে।
তারা ২০১৯ সালের সর্বশেষ যে পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যাচ্ছে অন্যান্য দেশে বসবাসের জন্য তিন লাখ ৩০ হাজার মানুষ তুরস্ক ছেড়ে চলে গেছে যা তা আগের বছরের তুলনায় ২% বেশি।
ধারণা করা হচ্ছে, সর্বশেষ পরিসংখ্যানেও দেখা যাবে যে এই প্রবণতা অব্যাহত রয়েছে।
ইস্তাম্বুলের ইয়েদিতেপ বিশ্ববিদ্যালয় ও ম্যাক কনসালটেন্সি ২০২০ সালের অগাস্ট মাসে তরুণদের ওপর অভিবাসনের বিষয়ে একটি জরিপ পরিচালনা করেছে যার ফলাফল দেশটিকে স্তম্ভিত করেছে।
জরিপে যারা অংশ নিয়েছেন তাদের ৭৬% বলেছেন যে তারা ভিন্ন কোনো দেশে চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত, যদি তাদেরকে সাময়িকভাবে সেই সুযোগ দেওয়া হয়।
তাদেরকে যখন জিজ্ঞেস করা হয় যে অন্য দেশের নাগরিকত্ব দেওয়া হলে তারা স্থায়ীভাবে তুরস্ক ছেড়ে চলে যেতে চায় কীনা- এই প্রশ্নের উত্তরে তাদের ৬৪% বলেছেন, এই প্রস্তাব গ্রহণ করতে তারা প্রস্তুত।
এর পেছনে একটা কারণ তুরস্কের বিপর্যস্ত অর্থনীতি। বার্ষিক মুদ্রাস্ফীতির হার ১৯ বছরের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। ডিসেম্বর মাসে দ্রব্যমূল্য বেড়েছে ৩৬%-এর বেশি।
পরিবহন, খাদ্যসহ অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধির কারণে পরিবারের খরচও বহুগুণে বেড়ে গেছে। তুর্কী মুদ্রা লিরার মারাত্মক রকমের পতন ঘটেছে। এক বছরেই এর দাম কমেছে প্রায় ৫০ শতাংশ।
স্বল্প-আয়ের পরিবারগুলো সংসারের হিসাব মেলাতে আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি হিমশিম খাচ্ছে। এই অর্থনৈতিক সঙ্কটের প্রভাব পড়েছে তুরস্কের মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর ওপরেও।
করোনাভাইরাস মহামারির কারণে অন্যান্য দেশের মতো তুরস্কের অর্থনীতিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে তুর্কী মুদ্রা লিরার বিপর্যয়ের কারণে দেশটির অর্থনীতির আরো অবনতি হয়েছে।
তবে যুক্তরাজ্য-ভিত্তিক একজন অভিবাসন বিশেষজ্ঞ এবং তুর্কী শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ইব্রাহিম সিরকেচি মনে করেন এর পেছনে তুরস্কের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতিরও বড় ধরনের ভূমিকা রয়েছে।
আরেকটি কারণ স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা। সমাজের বড় একটা অংশ ভবিষ্যতের ব্যাপারে তাদের আশা হারিয়ে ফেলেছে কারণ তারা মনে করে যে তারা রাজনৈতিক ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। তাদের মধ্যে রয়েছে উদ্যোক্তা, ব্যবসায়ী, শিল্পী এবং পণ্ডিত ব্যক্তিরাও।
এজন্য প্রেসিডেন্ট রেজেব তাইয়েপ এরদোয়ানের সমালোচকরা তার বিরুদ্ধে মানুষের স্বাধীনতা খর্ব করা এবং বিরোধী দলকে দমন করার অভিযোগ করেন।
আর একারণে তুর্কীরা ক্রমবর্ধমান সংখ্যায় ইউরোপের দেশগুলোতে আশ্রয় প্রার্থনা করছে।
কী বলছেন তরুণরা?
বিদেশে চলে গেলে কী ধরনের সুবিধা-অসুবিধা তা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াতে লোকজনকে আলোচনা করতে দেখা যায়। ইতোমধ্যেই যারা দেশ ছেড়ে চলে গেছেন তাদের অভিজ্ঞতার কথাও শুনতে চান অনেকে।
এমনই একজন রাজধানী আঙ্কারায় ২৮ বছর বয়সী এক শিক্ষার্থী বার্না আকদেনিজ। তুরস্কে যেসব শহুরে ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির শিক্ষিত তরুণ তরুণী বিদেশে চলে যাওয়ার চিন্তা ভাবনা করছেন বার্না তাদের একজন।
তিনি বলছেন, দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া তার জন্য কঠিন।বআমি এখানেই থাকতে চাই কারণ এটা আমার বাড়ি। কিন্তু একই সঙ্গে আমি এই দেশ ছেড়ে চলেও যেতে চাই কারণ আমি একজন মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকতে চাই।
বার্না একজন বধির। শোনার জন্য তাকে তার কানের ভেতরে বসানো একটি ইলেকট্রনিক যন্ত্রের ওপর নির্ভর করতে হয়। এটিকে বলা হয় ককলেয়ার ইমপ্ল্যান্ট।
তবে সাম্প্রতিক কালে বাইরের দেশ থেকে আমদানি করা এধরনের মেডিকেল সরঞ্জামাদির ঘাটতি দেখা দেওয়ায় তার মধ্যে ভীতির সঞ্চার হয়েছে যে তিনি হয়তো ভবিষ্যতে আর নাও শুনতে পারেন।
বার্না বলেন, যারা এই ককলেয়ার সরবরাহ করে তারা ঘোষণা করেছে যে ২০২২ সালে জানুয়ারির পর থেকে তারা এই যন্ত্রটি আর আমদানি করতে পারবে না। লাগামহীন মুদ্রাস্ফীতি এবং লিরার বিনিময় মূল্য কমে যাওয়ার কারণে এই ব্যবসায় তাদের আর লাভ হচ্ছে না। ফলে তাদের ব্যবসায় সাহায্য করার জন্য তারা এখন সরকারি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথাবার্তা বলবে।
‘কিন্তু তারা যদি কোনো ধরনের সমঝোতায় পৌঁছাতে না পারে তাহলে কী হবে?এর ফলে কী ধরনের পরিণতি হতে পারে সেটা ভেবেও আমি ভয় পাচ্ছি।’ তবে নিজের দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার ব্যাপারে এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেন নি বার্না।
তবে তিনি ইউরোপে যেতে আগ্রহী। এই পছন্দের পেছনে সেখানে বধির লোকজনকে রাষ্ট্রীয় যে সাহায্য সহযোগিতা দেওয়া হয় সেটাই প্রধান কারণ।
“আমি নিরাপত্তা চাই। আমি যে শুনতে পারবো এবিষয়ে আমি নিশ্চয়তা চাই।”
এর আগে বিভিন্ন সময়ে তুরস্কের পিছিয়ে থাকা গ্রামীণ এলাকা থেকে যারা ইউরোপে পাড়ি জমিয়েছেন, তাদের চেয়ে বর্তমানের অভিবাসন-প্রত্যাশীদের অবস্থা ভিন্ন।
এই নতুন প্রজন্মের অভিবাসন-প্রত্যাশীদের একজন তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলীয় গাজিয়ানটেপ শহরের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৮ বছর বয়সী ছাত্র হারুন ইয়ামান। টেলিভিশন, চলচ্চিত্র ও রেডিও মিডিয়ার ওপর পড়াশোনা করে তিনি ডিগ্রি নিয়েছেন।
হারুন ২০১৮ সালে স্নাতক পাস করেছেন। কিন্তু তিনি যেসব বিষয়ের ওপর পড়াশোনা করেছেন সেসব জায়গায় এখনও তিনি কোনো চাকরি জোগাড় করতে পারেন নি। বর্তমানে তিনি একটি গার্মেন্টস কোম্পানিতে কাজ করছেন।
তিনি বলেছেন, ইউরোপের উদ্দেশ্যে দেশ ছাড়ার বিষয়ে তিনি মানসিকভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। তার ইচ্ছা তিনি আয়ারল্যান্ডে চলে যাবেন।
“আমি এই দেশের ভবিষ্যতের ব্যাপারে কোনো আশার আলো দেখতে পাচ্ছি না। আর একারণেই আমি চলে যেতে চাই।”
এসডব্লিউ/এসএস/১৫২০
আপনার মতামত জানানঃ