বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে বিশ্বজুড়ে বেড়ে যাওয়া নারী নির্যাতনের প্রতিফলন দেখা গেছে দেশেও। গত বছর জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বরে ৩ হাজার ৭০৩ জন নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন সবচেয়ে বেশি ১ হাজার ২৩৫ জন। এছাড়া ১৪টি কন্যাশিশুসহ ৩৩ জন শ্লীলতাহানির শিকার হয়েছেন। আর ৬২টি কন্যাশিশুসহ যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন ৯৫ জন।
কতটা বেড়েছে ধর্ষণ?
সদ্য বিদায় নেওয়া বছর ২০২১ সালে ১ হাজার ২৫৩ নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে শিশু ৭৩৮ জন অর্থাৎ মোট ঘটনার প্রায় ৫৯ শতাংশ। এসব নারী ও শিশুর মধ্যে ৪৬ জনকে হত্যা করা হয়। একই বছর নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনাও বেড়েছে। আর তা আগের বছরগুলোর চেয়ে অনেক বেশি।
গতকাল সোমবার বিকেলে রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী হলে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরে বেসরকারি সংস্থা বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি (বিএনডব্লিউএলএ)। ‘নারীর প্রতি সহিসংতায় বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি’ শিরোনামে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, গত বছর দেশে নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলার সংখ্যা ছিল আনুমানিক ১৯ হাজার। এর মধ্যে শুধু ১০ জেলা—যশোর, খুলনা, নরসিংদী, রাজশাহী, ফরিদপুর, সিলেট, নড়াইল, কুষ্টিয়া, দিনাজপুর ও কুমিল্লায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মামলা ছিল ১১ হাজার ৭৭১টি।
গত বছর বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরগুলোর সংকলনের ভিত্তিতে তৈরি করা পরিসংখ্যান উদ্ধৃত করে বিএনডব্লিউএলএ জানায়, গত বছর ৬০২টি পারিবারিক সহিংসতার ঘটনার কথা জানা গেছে। এর মধ্যে ২৮৫ জন নারীকে স্বামী ও স্বামীর পরিবারের সদস্যরা হত্যা করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
হত্যা এবং আত্মহত্যা
বছরজুড়ে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নারী ও কন্যাশিশু হত্যার শিকার যেমন হয়েছেন, তেমনি নানা কারণে আত্মহত্যাও করেছেন অনেকেই। এর মধ্যে অনেকেই উত্ত্যক্তের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছেন।
গত বছরের তথ্য বলছে, বিভিন্ন কারণে ১১৪টি কন্যাশিশুসহ ৪৪৪ জন নারীকে হত্যা করা হয়েছে। এর মধ্যে অক্টোবর মাসে সবচেয়ে বেশি ৫১ জন হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। ফেব্রুয়ারি মাসে এই সংখ্যা ছিল সর্বনিম্ন ১২ জন।
এছাড়া বছরজুড়েই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা কমবেশি একইরকম ছিল। এর মধ্যে জানুয়ারি মাসে ৪১ জন, মার্চে ৪৯ জন, এপ্রিলে ৪০ জন, মে মাসে ৪১ জন, জুনে ৩৮ জন, জুলাইয়ে ২৮ জন, আগস্টে ৩০ জন, সেপ্টেম্বরে ৪৩ জন, নভেম্বরে ৩৯ জন ও ডিসেম্বরে ৩২ জন নারী ও কন্যাশিশু হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন।
এছাড়াও ১৯টি কন্যাশিশুসহ ৮৭ জনকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। এছাড়াও ১৩১টি কন্যাশিশুসহ ৪২৭ জনের রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে গত বছর।
একই সময়ে ৫৮টি কন্যাশিশুসহ শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ২০৮ জন। ৩২টি কন্যাশিশুসহ ৪৬ জনকে উত্ত্যক্ত করার তথ্য মিলেছে। এর মধ্যে একটি কন্যাশিশুসহ উত্ত্যক্ত হওয়ার কারণে আত্মহত্যা করেছেন দুই জন।
এছাড়া ৪৩টি কন্যাশিশুসহ ১২১ জনের আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে গত বছরে। আত্মহত্যায় প্ররোচনার ঘটনা ঘটেছে চারটি। পাঁচটি কন্যাশিশুসহ আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন ১১ জন।
বাল্যবিয়ে
বছরজুড়েই বাল্যবিয়ের ঘটনা উদ্বেগ ছড়িয়েছে। ২০২০ সালে ১১৭টি বাল্যবিয়ের তথ্য পাওয়া গেলেও বিদায়ী বছরে বাল্যবিয়ে সংক্রান্ত ঘটনা ঘটেছে ৩২৭টি। এর মধ্যে মাত্র ৪৩টি বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ করা গেছে।
১৩টি দৈনিকের তথ্য অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি বাল্যবিয়ে হয়েছে সেপ্টেম্বর মাসে— ১৮৫টি। এরপরই নভেম্বর মাসে ৭৪টি বাল্যবিয়ের ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া জানুয়ারি মাসে চারটি, ফেব্রুয়ারিতে ১০টি, মার্চে পাঁচটি, এপ্রিলে দুইটি, মে মাসে একটি, জুলাই মাসে দুইটি ও অক্টোবরে একটি বাল্যবিয়ের ঘটনা ঘটেছে। জুন, আগস্ট ও ডিসেম্বর মাসে কোনো বাল্যবিয়ের ঘটনা কোনো পত্রিকায় প্রকাশ পায়নি।
মহিলা পরিষদের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, গত বছরের ৭ ডিসেম্বর কেবল কিশোরগঞ্জ জেলাতেই ২৬০ মাদরাসা ছাত্রীর বাল্যবিয়ের ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া গত দেড় বছরে কেবল টাঙ্গাইল জেলাতেই ১ হাজার ২৪২টি বাল্যবিয়ে হয়েছে।
বাল্যবিয়ের পাশাপাশি যৌতুক গ্রহণ ও এ সংক্রান্ত নির্যাতনের ঘটনাও ছিল উদ্বেগজনক। একটি কন্যাশিশুসহ যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ১৩৮ জন। এর মধ্যে ৪৫ জনকে যৌতুকের কারণে হত্যা করা হয়েছে।
অপহরণ ও পাচার
লকডাউন ও করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যেও থেমে ছিল না অপহরণ ও পাচার। ১৫৩টি কন্যাশিশুসহ এ বছর অপহরণের শিকার হয়েছেন ১৮০ জন।
এছাড়াও আটটি কন্যাশিশুসহ ১১ জনকে অপহরণের চেষ্টা করা হয়েছে। ছয়টি কন্যাশিশুসহ ৪২ জন নারী ও কন্যাশিশু পাচারের শিকার হয়েছেন। এসব সংবাদ অনুযায়ী গত বছর দুই জনকে পতিতালয়ে বিক্রি করা হয়েছে।
নির্যাতন নিপীড়ন
মহিলা পরিষদের পরিসংখ্যান বলছে, ২০২১ সালে পাঁচটি কন্যাশিশুসহ এসিডদগ্ধের শিকার হয়েছেন ২২ জন। এর মধ্যে এসিডদগ্ধ হয়ে চার জনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া অগ্নিদগ্ধের শিকার হয়েছেন তিনটি কন্যাশিশুসহ ২৩ জন। এর মধ্যে মারা গেছেন ১০ জন।
এছাড়াও প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখানের কারণে নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে চারটি। ফতোয়ার ঘটনা ঘটেছে দুইটি। এ বছর ২৩টি কন্যাশিশুসহ ৬৩ জন সাইবার অপরাধের শিকার হয়েছেন। এছাড়াও ২৬ জন নারী ও কন্যাশিশু অন্যান্য নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
যেকারণে বাড়ছে ধর্ষণ
পরিবার ও সমাজে অসহিষ্ণুতা বেড়ে যাওয়ায় করোনা মহামারির সময় নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা অর্থাৎ ধর্ষণ, তালাক, পারিবারিক সহিংসতা, যৌন নির্যাতন, বাল্যবিবাহ, পাচার, অপহরণ ও যৌতুকের জন্য নির্যাতনের ঘটনা বেশি ঘটেছে।
সংবাদ সম্মেলনে বিএনডব্লিউএলএর সভাপতি সালমা আলী বলেন, ‘আগের বছরগুলোর তুলনায় গত বছর নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা অনেক বেড়েছে। দেশে অনেক ভালো ভালো আইন থাকলেও যথাযথভাবে এগুলোর প্রয়োগ না হওয়ায় নির্যাতনের ঘটনা কমছে না।’
‘একজন ভুক্তভোগীকে বিচার পাইয়ে দিতে হলে তাঁর জন্য কিছু সুরক্ষামূলক ব্যবস্থাও নিতে হয়। সরকার সে ক্ষেত্রে কতটুকু ব্যবস্থা নিতে পারছে, সে প্রশ্নও আসে।’
যথাযথ তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে যেন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল দ্রুত বিচার করতে পারেন, সে জন্য জনবল বাড়াতে হবে উল্লেখ করে সালমা আলী বলেন, ‘আইন প্রয়োগে শক্ত নজরদারি রাখতে হবে। পারিবারিক সহিংসতা বন্ধে যে আইনটি রয়েছে, তা মূলত প্রতিরোধমূলক। সেটিও ঠিকঠাক প্রয়োগ করা হচ্ছে না।’
এসডব্লিউ/এসএস/১১৩৫
আপনার মতামত জানানঃ