অপরাধীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে কক্সবাজারের ৩৪ রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প। খুন, অপহরণ, চাঁদাবাজি, ধর্ষণ, মাদক কিংবা মানব পাচার শরণার্থী ক্যাম্পের নিত্য ঘটনা। ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তার এবং নিজেদের অবস্থান সংহত করতে প্রায়ই অস্ত্রের মহড়া কিংবা রক্তের হোলি খেলায় মেতে ওঠে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা। মাঝেমধ্যে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অভিযানের মুখে কেউ কেউ গ্রেপ্তার হলেও থামানো যাচ্ছে না শরণার্থী ক্যাম্পের সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর অপরাধ তৎপরতা।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে প্রতিদিন কোনো না কোনো অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। ক্যাম্পে হত্যাকাণ্ড, ছিনতাই, সন্ত্রাসী কার্যক্রম, অস্ত্র উদ্ধার, ইয়াবা ব্যবসা, বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ ও অনিয়মতান্ত্রিক কাজে রোহিঙ্গাদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যাচ্ছে।
এছাড়া ক্যাম্প এলাকা থেকে দিনরাত কক্সবাজার শহরসহ সারাদেশে কারণে অকারণে তারা অবাধে বিচরণ করছে বিনা বাধায়।
অপরাধী চক্র বেশকিছুদিন ধরে বিভিন্ন ক্যাম্পে অগ্নি সংযোগসহ সাধারণ রোহিঙ্গাদের ওপর হামলা করছে। ক্যাম্পের পরিস্থিতি ঘোলাটে করতে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে অপরাধী চক্র। তাদের কর্মকাণ্ডে ভীত স্থানীয় লোকজন ও সাধারণ রোহিঙ্গারা।
গত ২৫ ডিসেম্বর রাত ১টার দিকে উখিয়ার পালংখালী ইউপি চেয়ারম্যান এম. গফুর উদ্দিন চৌধুরী আপত্তিকর গতিবিধি দেখে স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় ১০ রোহিঙ্গাকে থাইংখালী বাজার থেকে ধরে পুলিশের হাতে সোপর্দ করেন।
কুতুপালং বর্ধিত ক্যাম্পে হামলায় আহত রোহিঙ্গারা বলেন, ক্যাম্পে কিছু খারাপ রোহিঙ্গা নানা অপরাধ কর্মকাণ্ড করে বেড়াচ্ছে। কিছু এনজিও সহায়তা করছে অপরাধীদের।
অস্বাভাবিক কিছু হত্যাকাণ্ড, অপহরণ ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ধুম্রজাল তৈরি হয়েছে জনমনে। বিশেষ করে মুহিব উল্লাহ হত্যাকাণ্ড এবং রোহিঙ্গা ৩ নেতাসহ ২৫টি হত্যাকাণ্ডের পর ঘনীভূত হয়েছে সন্দেহ। টেকনাফ ও উখিয়াসহ কক্সবাজারের থানাগুলোতে বেড়েই চলেছে রোহিঙ্গা সংক্রান্ত অভিযোগ।
গত তিন বছরে ৩৯ জন রোহিঙ্গা অপরাধী বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়া সত্ত্বেও অপরাধের ধরন একটুও কমেনি বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
গুপ্তচর আকতার আলম নামে এক ব্যক্তি সম্প্রতি ২৭ রোহিঙ্গা হিন্দুকে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে মিয়ানমার। আকতার আলম রোহিঙ্গা জঙ্গিগোষ্ঠীর অন্যতম সদস্য হিসেবে চিহ্নিত। তার বিরুদ্ধে হত্যাকাণ্ড থেকে শুরু করে নানা অপরাধের অভিযোগ রয়েছে। তার মতো ক্যাম্প থেকে কলকাঠি নাড়ছে অনেক রোহিঙ্গা গুপ্তচর।
এদিকে সাড়ে ১১ লাখ রোহিঙ্গার মধ্যে পাঁচ হাজার রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী দেশি বিদেশি একাধিক এনজিও’র সঙ্গে গোপনে সম্পর্ক রক্ষা করে অস্ত্র ব্যবসা, সোনা চোরাচালান, মাদক পাচারের পাশাপাশি বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডেও জড়িত রয়েছে বলে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে।
এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে তৃতীয় কোনো শক্তি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মাথাচাড়া দিয়ে উঠলে পরিস্থিতি হতে পারে ভয়াবহ। গোয়েন্দা তৎপরতার পাশাপাশি প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড বাড়ানোর পরামর্শ সচেতন মহলের।
উখিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে দিন দিন জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসের চর্চা হচ্ছে।
রোহিঙ্গা নেতা আসলাম জানান, মিয়ানমার থেকে পাঠানো প্রত্যাবাসন তালিকায় রয়েছে অনেক গুপ্তচর পরিবারের নাম। যাদের সঙ্গে মিয়ানমার গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে। এছাড়া অপহরণ, অগ্নিকাণ্ড এবং হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলো তদন্ত করলে বেরিয়ে আসবে চাঞ্চল্যকর তথ্য।
রোহিঙ্গা শিবিরের দায়িত্বে নিয়োজিত এপিবিএন ১৬ এর পুলিশ সুপার তারিকুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে ক্যাম্পগুলোতে স্বাভাবিক পরিস্থিতি বিরাজমান রয়েছে। অপরাধ দমন ও সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
সাড়ে ১১ লাখ রোহিঙ্গার মধ্যে পাঁচ হাজার রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী দেশি বিদেশি একাধিক এনজিও’র সঙ্গে গোপনে সম্পর্ক রক্ষা করে অস্ত্র ব্যবসা, সোনা চোরাচালান, মাদক পাচারের পাশাপাশি বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডেও জড়িত রয়েছে বলে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে।
এদিকে মিয়ানমারের সন্ত্রাসবাদী সংগঠন ‘আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি’ (আরসা) নিজেদের আরও মজবুত করতে এবার কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে তাদের নিজস্ব মুদ্রা চালু করেছে। প্রাথমিকভাবে কয়েকটি ক্যাম্পে এ মুদ্রা চালু করলেও পর্যায়ক্রমে সব ক্যাম্পেই এ মুদ্রা চালু করতে চায় তারা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজেদের গ্রুপে তারা এ মুদ্রার পক্ষে প্রচারণাও শুরু করেছে।
কক্সবাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পের একাধিক সূত্র জানায়, আরসার সদস্যরা সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে নতুন মুদ্রার বিষয়ে প্রচার শুরু করেছে কয়েকমাস আগে। কিছু কিছু ক্যাম্পে এরই মধ্যে নতুন মুদ্রা দিয়ে বিনিময় শুরু হয়েছে। আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই আরসার নিয়ন্ত্রণাধীন ক্যাম্পগুলোতে নতুন মুদ্রা দিয়ে বিনিময় পুরোদমে শুরু হবে। প্রাথমিকভাবে এক হাজার, ৫০০ এবং ১০০ টাকার নতুন নোট ছেড়েছে আরসা। মুদ্রায় রয়েছে আরসার নেতা আতাউল্লার ছবি।
কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে বেশ কয়েকটি জঙ্গি সংগঠন সক্রিয়। তবে সব চেয়ে বেশি বিচরণ করছে ‘আরসা’। বাংলাদেশের ৩২টি রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পের মধ্যে ২৭টিতেই রয়েছে আরসার একক আধিপত্য।
রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে আরসার নতুন মুদ্রা প্রচলনকে বাংলাদেশের জন্য হুমকি মনে করেন সামরিক বিশ্লেষক মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘সাধারণত কোনো দেশ প্রতিষ্ঠা লাভের পর তার নিজের মুদ্রা চালু করে থাকে। একটি জঙ্গি সংগঠন কেন মুদ্রা প্রচলন করল? বিষয়টি সন্দেহজনক। বাংলাদেশ সরকারের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে নেওয়া উচিত।’
জানা যায়, গত চার বছরে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ১২ ধরনের অপরাধে ১ হাজার ২৯৮টি মামলা হয়েছে। এতে আসামি হয়েছে ২ হাজার ৮৫০ রোহিঙ্গা। ক্যাম্পগুলোর ভেতরে ১৫ থেকে ২০টি সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে উঠেছে। তাদের নিয়ন্ত্রণে চলছে মাদক ব্যবসাসহ নানা অবৈধ কর্মকাণ্ড।
অভিযোগ উঠেছে, এখানে প্রতিদিন প্রায় শতকোটি টাকার ইয়াবার লেনদেন হয়। শুধু তাই নয়, দেশের সব ইয়াবা ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নাকি এসব ক্যাম্প থেকেই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও স্থানীয় বিভিন্ন সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
২০১৭ সালে নানা অপরাধে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা ছিল ৭৬টি; আসামি ছিল ১৫৯ রোহিঙ্গা। অথচ চলতি বছর মাত্র ছয় মাসেই ৫৬৭টি মামলায় রোহিঙ্গা আসামির সংখ্যা এক হাজার ছাড়িয়ে গেছে।
বিভিন্ন অপরাধজনিত কারণে বর্তমানে কক্সবাজার কারাগারে রয়েছে চার শতাধিক রোহিঙ্গা। মাদক পাচারের মতো অপরাধে জড়িয়ে এদের অনেকে বিপুল অর্থসম্পদের মালিকও হয়েছে।
স্থানীয় অধিবাসীরা বলছেন, নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে রোহিঙ্গারা।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কর্মরত এনজিও কর্মীদের দাবি, অপরাধ জগৎ নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভেতরেই অন্তত ১৫ থেকে ২০টি সক্রিয় সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে উঠেছে। এর বাইরে ক্যাম্পকেন্দ্রিক রয়েছে আরও একাধিক সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাহিনী। প্রত্যেক বাহিনীতে ৩০ থেকে ১০০ জন পর্যন্ত সদস্য রয়েছে। সন্ধ্যার পর থেকে ক্যাম্পগুলো হয়ে ওঠে অপরাধের অভয়ারণ্য। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে গোলাগুলি ও খুনাখুনিতে জড়িয়ে পড়ে রোহিঙ্গারা। ক্যাম্পগুলোতে দিনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর নজরদারি থাকলেও রাতে তা অনেকটাই ঝিমিয়ে পড়ে।
এদিকে কক্সবাজারের উখিয়ায় রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদে ও দুর্বৃত্তদের গ্রেপ্তারসহ বিভিন্ন দাবিতে মানববন্ধন করেছে উখিয়াস্থ অধিকার বাস্তবায়ন কমিটি।
সংগঠনটির আহবায়ক ইঞ্জিনিয়ার রবিউল হোসেনের নেতৃত্বে উপজেলার বালুখালী পানবাজারে বুধবার এই মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হয়।
মানববন্ধনে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরসহ ১০ দফা দাবি উপস্থাপন করা হয়।
২০২২ সালের ১ জানুয়ারি থেকে অধিকার বাস্তবায়ন না হলে কঠোর কর্মসূচি, গণআন্দোলন, এনজিওর অফিস স্থাপনা ভাংচুর, মালামাল আনয়নে ব্যবহৃত যানবাহন অবরোধসহ বিভিন্ন কর্মসূচি নেয়া হবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের সামনে ‘রোহিঙ্গা’ বিষয় একটি বড় ধরনের জটিল চ্যালেঞ্জ হতে যাচ্ছে, যা দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় সমাধান সম্ভব নয়। কূটনৈতিক আলোচনার পাশাপাশি রোহিঙ্গা নেতৃত্বের বিকাশ ঘটিয়ে বিকল্প পথের সরকারের সব আন্তরিক প্রচেষ্টা সহজে কার্যকর হচ্ছে না। রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশেরই নয়, সমগ্র বিশ্বের উদার গণতান্ত্রিক এবং মানবাধিকার রক্ষাকারী চ্যাম্পিয়নদের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ।
সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা বলেন, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যত দেরি করবে, খুনসহ নানা রকম সমস্যা তত বাড়বে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত হবে মিয়ানমার সরকারের ওপর বড় ধরনের চাপ তৈরি করে এ সমস্যার সমাধান করা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৫০
আপনার মতামত জানানঃ