করোনা মহামারির কালো থাবায় মন্দায় পড়েছে বিশ্ব অর্থনীতি। থাবা থেকে বাদ যায়নি বিশ্ব মোড়ল যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিও। বাইডেন প্রশাসনের নানা ধরনের সহযোগিতার পরও খাদ্য সংকটে পড়েছে দেশটির দুই কোটিরও বেশি মানুষ।
উত্তর আমেরিকার এই দেশটির আদমশুমারি ব্যুরো থেকেই এই পরিসংখ্যান সামনে এসেছে। বুধবার (২২ ডিসেম্বর) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খিস্টান ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব বড়দিন এবং নববর্ষসহ ছুটি ও উৎসবের মৌসুমে খাবার সংকটে ভোগা আমেরিকানদের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রের আদমশুমারি ব্যুরোর অনুমান, ডিসেম্বর মাসের শুরু থেকে খাবার সংকটে ভুগছেন ২ কোটি ১০ লাখেরও বেশি মার্কিন নাগরিক। মূলত করোনা মহামারিকালীন মার্কিন সরকারের দেওয়া অর্থ সহায়তা বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
আলজাজিরা বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের নিম্ন আয়ের পরিবারগুলো শিগগিরই আরও আর্থিক চাপে পড়তে যাচ্ছে। কারণ দেশটিতে শিশু ট্যাক্স ক্রেডিট পেমেন্ট বন্ধ হতে যাচ্ছে এবং প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সমর্থিত এই কর্মসূচির মেয়াদ আরও বাড়ানোর ব্যাপারে মার্কিন কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সিনেটে কার্যত অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের আদমশুমারী ব্যুরো থেকে চলতি মাসের ১ তারিখ থেকে ১৩ তারিখ পর্যন্ত সংগ্রহ করা হাউজহোল্ড পালস জরিপের তথ্যে দেখা যাচ্ছে, দেশটিতে মাঝে মাঝে বা প্রায়ই খাবার সংকটে ভুগছে এমন পরিবারের সংখ্যা চলতি মাসে বৃদ্ধি পেয়ে ৯ দশমিক ৭ শতাংশে পৌঁছেছে। যা গত ৫ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ।
এছাড়া এক বছর আগের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে ৬ দশমিক ৪ শতাংশ। একইসঙ্গে পণ্যের চাহিদা বাড়ছে বলেও দেখতে পাচ্ছে ফুড ব্যাংকগুলো। এই পরিস্থিতিতে অপুষ্টিতে ভোগা এবং অনাহারে-অর্ধহারে থাকা শিশুদের প্রতি সহায়তাও বেড়েছে।
আলজাজিরা বলছে, চাইল্ড ট্যাক্স ক্রেডিট পেমেন্ট মূলত বছরে ১ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলারের কম উপার্জনকারী দুই অভিভাবক বিশিষ্ট পরিবারের ট্যাক্স রিটার্নের অগ্রিম হিসেবে কাজ করে। এই স্কিমের আওতায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি পরিবার ৬ বছরের নিচে প্রতি শিশুর জন্য মাসিক ৩০০ ডলার এবং ১৮ বছরের কমবয়সী প্রতি শিশুর জন্য ২৫০ ডলার মার্কিন সরকারের কাছ থেকে পেয়ে থাকে।
অবশ্য আরও বেশি টাকা উপার্জনকারী পরিবারগুলো মার্কিন সরকারের কাছ থেকে তুলনামূলক কম অর্থ সহায়তা পায়। চলতি বছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের আদমশুমারী ব্যুরোর জরিপের তথ্য বলছে, মার্কিন সরকারের পক্ষ থেকে মাসের মাঝামাঝি পর্যায়ে দেওয়া এই অর্থ সহায়তা বেশিরভাগ পিতামাতা খাবার কেনার পেছনেই খরচ করে থাকেন।
দেশটিতে মাঝে মাঝে বা প্রায়ই খাবার সংকটে ভুগছে এমন পরিবারের সংখ্যা চলতি মাসে বৃদ্ধি পেয়ে ৯ দশমিক ৭ শতাংশে পৌঁছেছে। যা গত ৫ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ।
ইতোপূর্বে গবেষণায় দেখা গেছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের এই অর্থ সহায়তাকে স্থায়ী করা হলে দেশটিতে শৈশবকালীন দারিদ্র্য উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেতে পারে। তবে চিন্তার বিষয় হচ্ছে, চাইল্ড ট্যাক্স ক্রেডিটের সর্বশেষ পেমেন্ট গত ১৫ ডিসেম্বর সম্পন্ন করা হয়েছে।
বিল্ড ব্যাক বেটার অ্যাক্টে বলা হয়েছে, ২০২২ সালজুড়ে চাইল্ড ট্যাক্স ক্রেডিট পেমেন্ট চালিয়ে যাওয়া হবে। অবশ্য সেটি এখন অনিশ্চিত হয়ে গেছে। কারণ ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার ডেমোক্র্যাটদলীয় সিনেটর জো ম্যানচিন গত রোববার জানিয়েছেন, তিনি এর (চাইল্ড ট্যাক্স ক্রেডিট পেমেন্ট) পক্ষে ভোট দেবেন না।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন স্থানে খাদ্যসংকটের অন্যতম কারণ সকারের অর্থ এবং খাদ্য সহায়তা সবার কাছে না পৌঁছানো৷
গত বছর পরিস্থিতি একেবারেই অন্য রকম হয়ে গিয়েছিল করোনাকালে। দেশে বাড়তে থাকা সংক্রমণের ধাক্কায় চাকরির বাজারেও গভীর সমস্যার আবহ তৈরি হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এবছরের শেষে এসে আমেরিকা কিন্তু আগের পরিস্থিতি ফিরে পেয়েছে। পরিসংখ্যান মানলে পরিস্থিতি কোভিডের আগের চেয়েও ভাল।
কিন্তু এই পরিস্থিতিতে বেকারত্বের হার কেন আরও কমেনি? মনে করা হচ্ছে, এর পিছনে রয়েছে কয়েকটি কারণ। বহু ক্ষেত্রেই কর্মরত নারীরা করোনা পরিস্থিতিতে কাজে বেরনোর সময় শিশুকে যথোপযুক্ত স্থানে রেখে যাওয়া নিয়ে সমস্যায় পড়েছেন। আবার অনেকে সংক্রমণের ভয়ে নিয়মিত বাইরে বেরনো এড়াতেও চাকরি থেকে দূরে সরে রয়েছেন। তাছাড়া কোভিড পরিস্থিতিতে যে বেকারত্ব ভাতা দেওয়া হচ্ছিল তার কারণে বহু মানুষেরই হাতে যথেষ্ট সঞ্চয় থাকায় তারা উপযুক্ত কাজ খোঁজার জন্য সময় নিতে পারছেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ব্যাপকহারে চাকরি ছেড়ে দেওয়ায় শূন্যপদের সংখ্যা বৃদ্ধিতে এবং অর্থনীতির গতি ফিরিয়ে আনার পথে বড় কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ এমনিতেই কোভিড হানায় বিপর্যস্ত মার্কিন অর্থনীতি। এরইমধ্যে কোম্পানিগুলো তাদের কর্মীদের আকৃষ্ট করতে জয়েনিং বোনাস ও বেতন বৃদ্ধির মতো প্রণোদনার ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু তাতেও কোনো কাজের কাজ হচ্ছে না।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অতি সংক্রামক ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়ার ফলে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের কিছুটা অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। ফলে সাধারণ সময়ের তুলনায় বেকার ভাতার আবেদনও বাড়তে শুরু করেছে। ২০২০ সালের মার্চের আগে অর্থাৎ মার্কিন অর্থনীতি মহামারির মাধ্যমে প্রভাবিত হওয়ার আগে সাপ্তাহিক বেকার ভাতার আবেদন ছিল গড়ে ২ লাখ ২০ হাজারের মতো।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৫২
আপনার মতামত জানানঃ