কদিন আগে বিশ্বজুড়ে হইচই ফেলে দেওয়া অনলাইন প্ল্যাটফর্ম নেটফ্লিক্সের সিরিজ ‘স্কুইড গেম’ বিক্রি করার জন্য উত্তর কোরিয়ায় এক ব্যক্তিকে শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। যিনি সিরিজটি কিনেছিল তাকেও যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে কিম জং উনের প্রশাসন। এনিয়ে বিশ্ব এখনো তোলপাড় চলছে।
দেশটির এক সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়, চীন থেকে স্কুইড গেম সিরিজের একটি কপি লুকিয়ে কিনে এক ব্যক্তি নিয়ে এসেছিলেন উত্তর কোরিয়ায়। তারপর সেটি পেনড্রাইভে নিয়ে বিক্রি করছিলেন। ওই ব্যক্তির কাছ থেকে এক ছাত্রসহ সাতজন তা কিনেছিলেন। বিষয়টি প্রকাশ্যে আসতেই পদক্ষেপ গ্রহণ করে উত্তর কোরিয়ার শাসক কিম জং উনের প্রশাসন।
আইন অমান্য করায় ওই ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ডের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তাকে ফায়ারিং স্কোয়াডে দাঁড় করিয়ে গুলি করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বাকি এক ছাত্রকে যাবজ্জীবন এবং ৫ জনকে পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছে কিমের প্রশাসন। ওই ছাত্ররা যে স্কুলে পড়ে সেই স্কুলের শিক্ষক এবং প্রশাসককে বহিষ্কার করার পাশাপাশি শাস্তি হিসেবে খনিতে কাজ করার নির্দেশও দেওয়া হয়েছে।
উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে ভীতি সৃষ্টির জন্য রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ড ব্যবহার করার অভিযোগ রয়েছে।
এদিকে মানবাধিকার রেকর্ড নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে প্রশ্ন ওঠার পর মৃত্যুদণ্ডের খবর লুকানোর চেষ্টা করছে উত্তর কোরিয়া। দক্ষিণ কোরিয়াভিত্তিক একটি গবেষণা দলের পক্ষ থেকে গতকাল বুধবার প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে এমনটি জানানো হয়েছে।
দক্ষিণ কোরিয়ার গবেষণা দল দ্য ট্রানজিশনাল জাস্টিস ওয়ার্কিং(টিজেডব্লিউ) স্যাটেলাইট থেকে প্রাপ্ত ছবি বিশ্লেষণ করে জানায়, কিম জং উনের শাসনামলে ২৩টি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। উল্লেখ্য, কিম ২০১১ সালের ডিসেম্বরে উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট হন।
উত্তর কোরিয়া থেকে পালান ব্যক্তিদের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, মৃত্যুদণ্ডগুলো খুব কড়াকড়িভাবে কার্যকর হয়েছে যাতে এর তথ্য বাইরে না আসতে পারে ।
টিজেডব্লিউর পক্ষ থেকে বলা হয়, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উত্তর কোরিয়া কৌশলগতভাবে এই মৃত্যুদণ্ডগুলো সীমান্ত এলাকা থেকে দূরের এলাকাতে নিয়ে কার্যকর হচ্ছে। দেশের বাইরে যাতে মৃত্যুদণ্ডের তথ্য ফাঁস না হয় সে জন্য এসব অনুষ্ঠানে আগতদের কড়া নজরদারির মধ্যে রাখা হচ্ছে।
টিজেডব্লিউর প্রতিবেদনে বলা হয়, আমাদের অনুসন্ধান থেকে বোঝা যায় যে, আন্তর্জাতিক তদন্তের প্রতিক্রিয়ায় মানবাধিকার ইস্যুতে আরও মনোযোগ দিচ্ছেন কিম।
পালিয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের পরিচয় স্বাধীনভাবে যাচাই করা টিজেডব্লিউর পক্ষ থেকে সম্ভব হয়নি কারণ উত্তর কোরিয়া নাগরিকদের তথ্য ও রেকর্ড কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে।
গবেষণা দলের প্রধান আহিয়ং পার্ক বলেন, সংস্থাটি সাবধানতার সঙ্গে পালিয়ে আসাদের তথ্য মূল্যায়ন করেছে, শুধুমাত্র সেগুলোকে বেছে নেওয়া হয়েছে যা এটি সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বলে মনে হয়েছে।
পিয়ংইয়ংয়ের বিরুদ্ধে দীর্ঘ সময় ধরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে। উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম জং উনের শাসনামলে তার চাচা জং সং থাইকসহ শীর্ষ কর্মকর্তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। তবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ অস্বীকার করে উত্তর কোরিয়া।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উত্তর কোরিয়া কৌশলগতভাবে এই মৃত্যুদণ্ডগুলো সীমান্ত এলাকা থেকে দূরের এলাকাতে নিয়ে কার্যকর হচ্ছে। দেশের বাইরে যাতে মৃত্যুদণ্ডের তথ্য ফাঁস না হয় সে জন্য এসব অনুষ্ঠানে আগতদের কড়া নজরদারির মধ্যে রাখা হচ্ছে।
উত্তর কোরিয়ায় সরকারের প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে দক্ষিণ কোরিয়ার একটি এনজিও’র প্রতিবেদনে। দেশটিতে এমন মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের ৩১৮ টি স্থান চিহ্নিত করেছে এনজিওটি।
বলা হয়েছে, গরু চুরি থেকে শুরু করে দক্ষিণ কোরিয়ার টেলিভিশন চ্যানেল দেখার অপরাধে মানুষজনকে আটক করে এ সমস্ত স্থানে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। নদীর কাছে, মাঠে, বাজারে, স্কুলে এবং খেলার জায়গায়ও সবার সামনে দেওয়া হয় এ দণ্ড। এভাবে মানুষ হত্যা চলে আসছে দশকের পর দশক ধরে।
গত চার বছরে উত্তর কোরিয়া থেকে পালিয়ে আসা ৬১০ জনের সাক্ষাৎকার নিয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে ‘দ্য ট্রানজিশনাল জাস্টিস ওয়ার্কিং গ্রুপ’ নামের এ দক্ষিণ কোরীয় এনজিও।
‘ম্যাপিং দ্য ফেট অব দ্য ডেড’ শিরোনামে প্রকাশিত এ প্রতিবেদনে বেসরকারি সংস্থাটি জানিয়েছে, মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের সময় তা দেখার জন্য ১ হাজার বা তারচেয়ে বেশি মানুষকে জড়ো করা হয়। যাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় তার পরিবারের শিশুসহ অন্যান্য সদস্যকেও কখনো কখনো তা দেখতে বাধ্য করা হয়।
মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের পর বেশিরভাগ সময়ই ওইসব মৃতদেহ কিংবা তাদের সমাধিস্থলের ঠিকানা স্বজনদের দেওয়া হয় না। এ পর্যন্ত প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে দেখা সবচেয়ে কনিষ্ঠজনের বয়স সাত বছর।
আটককেন্দ্র, কারাগার কিংবা শ্রম শিবিরেও কিছু মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। এসব স্থানে রাজনৈতিক অপরাধে মানুষজনকে বন্দি রাখা হয় এবং তাদেরকে খনি ও গাছ কেটে কায়িক পরিশ্রম করতে বাধ্য করা হয়।
২০০০ সালের প্রথম দিকে উত্তর কোরিয়ার লেবার ক্যাম্পে ছিলেন এমন একজন তার অভিজ্ঞতা বর্ণনায় জানান, পালিয়ে চীন যাওয়ার চেষ্টা করায় তিন নারীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা দেখতে বাধ্য করা হয়েছিল ৮০ বন্দিকে।
জননিরাপত্তা মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা ওই সময় বন্দিদের বলেছিলেন, ‘এ ঘটনা তোমাদের বেলায়ও ঘটতে পারে’।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রশাসন চায় না এমন সব কার্যকলাপ থেকে নাগরিকদের দূরে রাখার জন্যই তাদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের এমন পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
বেশিরভাগ মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় ফায়ারিং স্কোয়াডে। এ ধরনের ক্ষেত্রে সাধারণত তিনজন শু্যটার তিন রাউন্ড গুলি ছুড়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে। অনেক সময় ফাঁসি দিয়েও মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। তবে তা খুব কম।
এদিকে উত্তর কোরিয়ার মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে প্রকাশ্য আলোচনার আহ্বান জানিয়েছে নিরাপত্তা পরিষদের কিছু সদস্য। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বেশ কিছু সদস্য এবং জাপান বুধবার ১৫-জাতি পরিষদে উত্তর কোরিয়ার মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে একটি প্রকাশ্য সভা করার জন্য আহ্বান জানিয়েছে।
জাতিসংঘে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের দূত লিন্ডা টমাস-গ্রিনফিল্ড তার সরকার এবং ব্রিটেন, এস্তোনিয়া, ফ্রান্স, আয়ারল্যান্ড, জাপান এবং নরওয়ের পক্ষ থেকে সাংবাদিকদের বলেন, ‘উত্তর কোরিয়া সরকারের ভয়ঙ্কর মানবাধিকার লঙ্ঘন, বেআইনি ডব্লিউএমডি [গণবিধ্বংসী অস্ত্র] এবং ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির মতো কার্যক্রম, আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তাকে অস্থিতিশীল করে তুলছে এবং এ বিষয়ে কাউন্সিলের অধিবেশনে অবশ্যই অগ্রাধিকার দিতে হবে’। জাপান ছাড়া উল্লিখিত দেশগুলোর সবাই নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য।
২০১৪ সালে, জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের নির্দেশিত একটি তদন্ত কমিশন, উত্তর কোরিয়ার পরিস্থিতির উপর একটি দীর্ঘ এবং কড়া প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। যেখানে বলা হয়েছে, ‘ডিপিআরকে [ডেমোক্রেটিক পিপলস রিপাবলিক অফ কোরিয়া] অর্থাৎ উত্তর কোরিয়ায় অকল্পনীয় মাত্রায় মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে’।
কিছু সদস্যের আপত্তি থাকা সত্ত্বেও, সেই সময় থেকে, নিরাপত্তা পরিষদ প্রতিবছর ডিসেম্বরে উত্তর কোরিয়ার মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা অব্যাহত রেখেছে।
উত্তর কোরিয়ায় মানবাধিকার পরিস্থিতির নিন্দা জানিয়ে, বৃহস্পতিবার জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ তার বার্ষিক প্রস্তাব উপস্থাপন করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
নভেম্বরে, উত্তর কোরিয়া সরকার জাতিসংঘে তার দেশের মানবাধিকার বিষয়ক প্রতিবেদনে আন্তর্জাতিক সমালোচনাকে প্রত্যাখ্যান করে বলেছিল, ওগুলো ছিল ‘শত্রু শক্তির দ্বারা তৈরি করা বানোয়াট’ এবং সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচারণার একটি অংশ।
এই চলমান নির্যাতনের মধ্যে রয়েছে খুন, দাসত্ব, নির্যাতন, কারাবাস, ধর্ষণ, জোরপূর্বক গর্ভপাত, জোরপূর্বক গুম, অনাহার এবং রাজনৈতিক, ধর্মীয়, জাতিগত এবং লিঙ্গের ভিত্তিতে নিপীড়ন।
২০১৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত, কাউন্সিল এই বিষয়ে উন্মুক্ত সভা করেছে। পরের বছর থেকে সভাগুলো অনুষ্ঠিত হয় রুদ্ধদ্বার।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০০৪
আপনার মতামত জানানঃ