নাম বেবি ড্রাগন। কারণ মৃত্যুর সময়েও শিশু অবস্থায় থাকে এই ড্রাগনগুলো। গোটা পৃথিবীতে একমাত্র একটি গুহায় দেখা যায় স্যালামান্ডার গোত্রের এই প্রাণীদের। স্লোভেনিয়ার রাজধানী লুব্লজানার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত পোস্টোজনা গুহায় রয়েছে এই বাচ্চা ড্রাগনেরা।
পূর্ব ইউরোপের স্লোভানিয়ার এই পোস্তোজনা গুহায় অদ্ভুত এই প্রাণীকে দেখতে ভিড় জমান বহু পর্যটক। নাম ওলমস বা ল্যাটিন ভাষায় প্রোটিয়াস অ্যাঙ্গুইনাস। বাচ্চা ড্রাগন ওলমস ২৫ সেন্টিমিটার লম্বা এবং এরা পানিতেই বসবাস করে থাকে।
এমনকি তাদের নিয়ে নানা রূপকথার গল্পও প্রচলিত। কয়েক শতাব্দী ধরে ইউরোপের নানা দেশের মানুষ প্রায় তীর্থদর্শনের মতো ভিড় জমিয়ে আসছেন এখানে। তবে প্রাণীটির চরিত্র এখনও বিজ্ঞানীদেরও অবাক করে।
ঠিক কবে পোস্তোজনা গুহায় এই সরীসৃপের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে, তা যদিও জানা যায় না। তবে গুহায় একটি গ্রাফিটি থেকে অনুমান করা হয়, ১২১৩ সালেও এই গুহায় মানুষের পা পড়েছে। ১৮১৮ সালে অস্ট্রিয়ার রাজা প্রথম ফ্রানৎজ এসেছিলেন গুহা পরিদর্শনে।
কেবল উনিশ শতকেই এই গুহায় অন্তত সাড়ে ৩ কোটি মানুষ এসেছেন। আর বিশ ও একুশ শতকে পর্যটকের সংখ্যাটা যে আরও বেড়েছে, সে-কথা বলাই বাহুল্য। গুহার মধ্যেই গড়ে উঠেছে একটি অ্যামিউজমেন্ট হল। সেখানে অর্কেস্ট্রার ব্যবস্থাও করা হয়েছে। আর এই সবই হয়েছে বেবি ড্রাগন নামের এই প্রাণীকে ঘিরে।
৩৭৭ ফুট গভীরতায় যাত্রা করার সময় কখনও কখনও দর্শনার্থীদের এক মিটার চওড়া স্লিটের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। সেখানেই দেখা মেলে ওলমসের। পানির বাইরে কিংবা স্থলে বাচ্চা ড্রাগন ওলমস প্রজাতির বিকাশ ঘটে না।
স্থানীয়রা ওলমসকে বাচ্চা ড্রাগন বলার কারণ হিসেবে জানা যায়, ড্রাগন যখন বিলুপ্ত হয়েছিল তখন তারা পোস্টোজনা থেকেই ভেসে গিয়েছিল। পোস্টোজনা গুহাটি ছিল ড্রাগনদের আবাসস্থল। তাই এই গুহায় ওলমসের বসবাস থাকায় তাদের ড্রাগনের বাচ্চা বলা হয়।
প্রাণীদের সাধারণত একেবারে শৈশব দশায় দৃষ্টিশক্তি থাকে না। আর এই সরীসৃপ মৃত্যুর সময় পর্যন্ত থাকে অন্ধ। তাদের চোখ থাকে ঠিকই, কিন্তু চোখের ওপর থাকে মোটা চামড়ার স্তর। এমনকি সরীসৃপ হওয়া সত্ত্বেও তাদের শরীরে আঁশ বা খোলস তৈরি হয় না। গোলাপি রঙের নরম চামড়ায় ঢাকা থাকে শরীর। দেখে মনে হয় এই বুঝি ডিম ফেটে বেরিয়ে এসেছে তারা।
ইউরোপের সর্বাপেক্ষা বৃহৎ গুহা অর্থাৎ পোস্টোজনা গুহা ভ্রমণপিপাসুদের জন্য সবসময়ই খোলা থাকে। সেখানকার কর্মীরা খুব ভালো ভাবে পর্যবেক্ষণ করে দেখেছেন, এই ড্রাগন শিশুগুলির জন্ম ২০১৬ সালে।
বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় ওই গুহার ম্যানেজিং ডিরেক্টর মার্জা বাতাগেলজ বললেন, “ডিমগুলি যখন প্রথমে আমাদের নজরে আসে, তখনই খুব উত্তেজিত হয়ে যাই। কিন্তু পরবর্তীতে মাথায় হাজারো চিন্তার উদয় হয়। কী ভাবে বাঁচানো যায়, কী ভাবে বাচ্চাগুলোকে খাওয়াব, আর কী ভাবেই বা সংক্রমণ থেকে ওদের রক্ষা করা যাবে?”
মার্জা বাতাগেলজ বলেন, “বিজ্ঞান বলছে, এই ধরনের প্রাণীগুলির টিকে থাকার সম্ভাবনা মাত্র ০.৫ শতাংশ। তবে আমরা সেই ২০১৬ সাল থেকে এখনও অবধি ২১টি ড্রাগন বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছি।”
পাশাপাশিই তিনি আরও জানালেন যে, ২০১৬ সালে মোট ৬৪টি ডিমের সন্ধান মিলেছিল গুহার ভিতরে। ড্রাগনের এই বাচ্চাগুলির ১৪ সেন্টিমিটার বা ৫ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হয়। তবে পুরোপুরি বড় হয়ে গেলে, এরা ৩০ সেন্টিমিটার বা ১২ ইঞ্চি অবধি লম্বা হতে পারে।
এই ধরনের ওলমস একবার টিকে গেলে কমপক্ষে ৮ বছর অবধি কোনও রকম খাবার ছাড়াই বেঁচে থাকতে পারে বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। তবে এদের জীবনকাল ১০০ বছর অবধি হতে পারে বলেও জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
শোনা যায়, বাইবেল বর্ণিত ভয়ঙ্কর বন্যায় ভেসে গিয়েছিল পোস্টোজনা গুহা। তার আগে এখানেই ছিল ড্রাগনদের বাস। বন্যায় ড্রাগনদের মৃত্যু হলেও তাদের সন্তানরা থেকে যায়। এমনটাই মনে করেন অনেকে। তবে বেবি ড্রাগন সম্পর্কে সবচেয়ে আশ্চর্যজনক তথ্যটি আবিষ্কার হয়েছে ২০১৬ সালে।
একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে, জন্মের সময় দৃষ্টিশক্তি নিয়েই জন্মায় এই প্রাণীরা। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের চোখের ওপর চামড়ার আবরণ পড়ে যায়। এমন অদ্ভুত অভিযোজন কেন, তার উত্তর পাননি বিজ্ঞানীরা। তবে পৃথিবীতে আশ্চর্য প্রাণীর সংখ্যা তো নেহাত কম নয়। জীবজগতের রহস্যের কতটুকুই বা বিজ্ঞানীদের জানা!
স্থানীয় মানুষজনের কথা অনুযায়ী, জলের গতি যখন খুব পরিমাণে বেড়ে যায়, ঠিক তখনই গুহা থেকে বাইরে বেরিয়ে আসে এই ড্রাগনগুলি। স্থানীয় মানুষজনের অনুমান, যে ড্রাগনদের আমরা গুহায় বসবাস করার কথা এতদিন যাবৎ শুনে এসেছি, এই বাচ্চাগুলি আসলে তাদেরই।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩০০
আপনার মতামত জানানঃ