গত কয়েক দশকে আফ্রিকার দুর্ভিক্ষ বারবার বিশ্বকে নাড়া দিয়েছে৷ তবু এই খরা আর দুর্ভিক্ষের শেষ নেই। কিছুদিন আগেও চারদিকে ছিল সবুজ তৃণভূমি। আজ সেখানে কিছু মৃত ঘাসের জঙ্গল ছাড়া কিছু নেই। আর রয়েছে অসংখ্য মৃতদেহ। রাস্তার ধারে সারি দিয়ে পড়ে আছে অসংখ্য গবাদি পশুর মৃতদেহ। কারোর কারোর শরীরে হয়তো প্রাণের শেষ স্পন্দন তখনও মিলিয়ে যায়নি। আবার কোনো মৃতদেহ একেবারে পচে গলে গিয়েছে।
এমনই দৃশ্য প্রায় গোটা পূর্ব আফ্রিকা জুড়ে। কেনিয়া, সোমালিয়া, ইথিওপিয়া জুড়ে ভয়ঙ্কর খরার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে গবাদি পশুরাই। আর সাভানা অঞ্চলের মানুষের মূল জীবীকাই পশুপালন এবং পশুচারণ। অথচ পশুচারণের জন্য একটি চারণভূমিও বেঁচে নেই। নেই সামান্য পাণীয় জলও।
শুধুই গবাদি পশুরা নয়, সংরক্ষিত অরণ্যের প্রাণীদের অবস্থাও একই রকম। ইথিওপিয়ায় গত এক মাসে ১১টি জিরাফের মৃতদেহ উদ্ধার করেছে বনবিভাগ। পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার কোনো রাস্তাও খুঁজে পাচ্ছেন না তারা।
আর এই খরা পরিস্থিতি মিটতে এখনও অন্তত ৮ মাস বাকি। তারপরেও আগামী বর্ষায় প্রয়োজনমতো বৃষ্টি হবে কিনা, তা নিয়ে নিশ্চিত নন কেউই। ২০১১ সালের পর এমন ভয়াবহ খরার মুখে পড়েনি পূর্ব আফ্রিকা।
গত ৪ মাস ধরেই পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে বলে জানিয়ে আসছেন ইথিওপিয়া, সোমালিয়া এবং কেনিয়া সরকার। আন্তর্জাতিক সাহায্যও চেয়েছেন তারা। অথচ এর মধ্যে কপ-২৬ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে গেলেও এই খরা সমস্যার সমাধানের প্রায় কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি।
এই পরিস্থিতিতে মানুষ ও বন্যপ্রাণীর সম্পর্ক আরও খারাপ হয়ে উঠছে। যখন সম্বল অতি সামান্য, তখন সমস্ত মানবিক অনুভূতি হারিয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। তাই সামান্য খাদ্য-পাণীয় যা পাচ্ছেন, মানুষ আগে নিজের জীবন বাঁচাতে কাজে লাগাচ্ছেন।
অবশ্য পূর্ব আফ্রিকার অধিকাংশ মানুষই জানেন, পশুরা না বাঁচলে তারাও বাঁচবেন না। পশুপালনই যে তাদের জীবীকা। কিন্তু গবাদি পশুদের বাঁচানোর কোনো উপায়ও যে নেই। এক একটি পরিবার, যাদের ১০০-১৫০টি পোষ্য ছিল আগে, সেই সংখ্যাটা নেমে এসেছে ৩০-৪০-এর মধ্যে। জীবিত প্রাণীদের অবস্থাও সংকটজনক।
ইতিমধ্যে ৭০ শতাংশ গবাদি পশুর মৃত্যু হয়েছে পূর্ব আফ্রিকা জুড়ে। হয়তো এই খরা মিটতে মিটতে আর একটি প্রাণীও বেঁচে থাকবে না। তখন পশুপালক মানুষদের জীবীকা কী হবে, জানেন না কেউই।
কী কারণ এই ভয়াবহ খরার?
জাতিসংঘ সতর্ক করে দিয়ে জানিয়েছে, ইথিওপিয়া, কেনিয়া এবং সোমালিয়ায় যে দুর্যোগ দেখা দিয়েছে তা গত ৬০ বছরে দেখা যায়নি৷ অনেকেই প্রশ্ন করতে পারে আফ্রিকার এই অঞ্চলে খরা বা দুর্ভিক্ষের কারণ কী? শুধু কি বৃষ্টির অভাবেই এই খরা দেখা দিয়েছে নাকি এর পেছনে অন্য কোন কারণ রয়েছে?
জাতিসংঘের জরুরি শিশু তহবিল ইউনিসেফের কর্মী ক্রিস্টফার টাইডি জানান, ‘‘এই অবস্থার জন্য অনেকগুলো কারণ এক সঙ্গে কাজ করছে৷ প্রথমত, সারা বিশ্বে খাবার-দাবারের দাম বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে৷ এছাড়া খরা চলেছে অনেক দিন ধরে৷ সেই সময়ে কোন ফসল ফলানো যায়নি৷ আর সবচেয়ে মারাত্মক ক্ষতি করেছে সোমালিয়ার ভিতরকার সংঘর্ষ৷ এসব সংঘর্ষের কারণে লক্ষ লক্ষ মানুষ নিজস্ব গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে গেছে৷ তারা আর ফিরে আসেনি৷”
টাইডি জানান, দুর্ভিক্ষের কারণে খাদ্যের সন্ধানে বেরিয়ে পড়েছে মানুষগত কয়েক মাস ধরেই আশঙ্কা করা হচ্ছিল যে এ ধরণের একটি পরিস্থিতির সম্মুখীন আমরা হবো। আক্ষেপের সঙ্গে তিনি আরও জানান যে, ‘‘কোন কোন সময় আমরা দেখি যে এ ধরণের কোন সংকট যতক্ষণ না তার পূর্ণাঙ্গ শক্তি দিয়ে ধাক্কা দিচ্ছে ততক্ষণ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের টনক নড়ে না৷ এটা খুবই দুঃখজনক৷”
তবে আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা বলছেন অন্য কথা৷ তারা জানিয়েছেন, এর সঙ্গে লা নিনার সম্পর্ক রয়েছে৷ লা নিনা হচ্ছে ঘুর্ণিঝড় এল নিনোর সঙ্গী৷ লা নিনিয়ার কারণেই এসব বিপত্তি এবং এই প্রথমবারের মত যে এসব পরিবর্তন লক্ষ্য করা হচ্ছে তা নয়৷ বিশেষজ্ঞরা আরো বলছেন, ২০১০ সালের গ্রীষ্মকাল থেকে লা নিনা প্রচণ্ড জোর পেয়েছে৷ এই জোরের ফলে আবহাওয়ায় বেশ কিছু পরিবর্তন এসেছে আফ্রিকার পূর্বাঞ্চলে৷
এর ফলে ভারত মহাসাগরের ওপর পশ্চিমমুখি বাতাস বেগবান হয়েছে৷ এবং তা পূর্ব আফ্রিকা থেকে আর্দ্রতা বয়ে নিয়ে গেছে ইন্দোনেশিয়া এবং অস্ট্রেলিয়ার দিকে৷ এর ফলে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে এবং দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় দেখা দিয়েছে বন্যা এবং দারুণ ফলন হয়েছে৷ আর পূর্ব আফ্রিকার প্রধান প্রধান অংশে দেখা দিয়েছে খরা৷
১৯৯৫ সাল থেকে ২০১০ সালের মধ্যে পূর্ব আফ্রিকায় বৃষ্টিপাত কমেছে প্রায় ৩০ শতাংশ৷ ফলে দেখা দিয়েছে খরা৷ এটা পূর্ব আফ্রিকার জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর কারণ সেখানে শুধু মানুষ বা ফসল নয় পশুপাখিও বৃষ্টির পানির ওপর নির্ভর করে৷ খরার সময় জলাশয়গুলো হচ্ছে পানির একমাত্র উৎস৷ কিন্তু বৃষ্টি না হওয়ায় জলাশয়গুলো থাকে শূন্য৷
এর সঙ্গে যোগ হয়েছে সোমালিয়ার গৃহ-যুদ্ধ৷ গত ২০ বছর ধরে দেশটিতে চলছে এই যুদ্ধ৷ দেশটিতে খরা এবং দুর্ভিক্ষ যে দেখা দিয়েছে তাতে আশেপাশের দেশগুলো অবাক হচ্ছে না৷ দেশের মানুষ না খেতে পেয়ে কষ্ট পাচ্ছে তাতে কর্ণপাত করছে না উগ্র ইসলামপন্থি আল-শাবাব জঙ্গি বাহিনী৷ এরাই দেশের বেশিরভাগ অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করছে৷ গত ২০ বছরের গৃহ-যুদ্ধের পর দেশের সাধারণ মানুষরা ভেঙে পড়েছে৷ তারা বেঁচে থাকার জন্য আশ্রয় নিচ্ছে আশেপাশের দেশগুলোতে৷
এসডব্লিউ/এসএস/১২৩০
আপনার মতামত জানানঃ