আগামী বছরই ইউক্রেনে হামলা চালাতে পারে রাশিয়া। আর এর জন্য ১ লাখ ৭৫ হাজার রুশ সেনাকে প্রস্তুত করা হচ্ছে। মার্কিন সংবাদমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদনে গত শুক্রবার এমনটি বলা হয়েছে। তবে ইউক্রেন সরকারের আশঙ্কা, আগামী মাসেই হামলা চালাবে রাশিয়া।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মার্কিন প্রশাসনের এক কর্মকর্তা ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেন, মস্কো ১০০ ব্যাটালিয়নে ১ লাখ ৭৫ হাজার সেনাকে অস্ত্রশস্ত্রসহ প্রস্তুত করছে। মার্কিন গোপন নথির বরাত দিয়ে ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়, রাশিয়ান বাহিনী বর্তমানে চারটি পয়েন্টে সেনা বাড়াচ্ছে। সেখানে অস্ত্রশস্ত্রসহ ৫০টি কৌশলগত দল মোতায়েন করা হয়েছে।
মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগের সদর দপ্তর পেন্টাগন এর আগে জানিয়েছিল, ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার আক্রমণাত্মক পদক্ষেপ নেওয়ার পরিকল্পনার প্রমাণ পাওয়া গেছে। আর এ নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও এর আগে বলেছেন, ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা ঠেকানোর জন্য নতুন নীতি গ্রহণের প্রস্তুতি নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।
যে কারণে পরিস্থিতি এতটা ভয়াবহ
ইউক্রেন সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ নিয়ে রাশিয়ার সাথে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার পশ্চিমা সামরিক মিত্রদের পাল্টাপাল্টি অবস্থান দিনকে দিন বিপজ্জনক মোড় নিচ্ছে। আর সেই বাদানুবাদের বিস্ফোরণ দেখা গেছে বৃহস্পতিবার সুইডেনে ইউরোপীয় নিরাপত্তা বিষয়ক এক বৈঠকে।
স্টকহোমের বৈঠকে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাবরভ যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের পাশে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট করে বলেছেন রাশিয়া তার ঘরের পাশে ন্যাটো সামরিক জোটের নতুন কোনো তৎপরতা কোনোভাবেই সহ্য করবে না।
লাবরভ সতর্ক করে বলেছেন, আমেরিকা এবং ন্যাটো জোট রুশ এই বার্তা অগ্রাহ্য করলে ইউরোপে আবারো যুদ্ধ শুরু হতে পারে। তিনি বলেন, ইউরোপকে আবারো যুদ্ধের দুঃস্বপ্ন দেখতে হতে পারে।
সুইডেনের বৈঠকে রাশিয়া ইউরোপের নিরাপত্তা নিয়ে নতুন একটি প্রস্তাব দিয়েছে যার মূল কথা ন্যাটো জোটকে ইউরোপের পূর্বে নতুন করে ক্ষমতা বিস্তৃতির চেষ্টা বন্ধ করতে হবে।
ব্লিঙ্কেন রাশিয়ার সেই প্রস্তাব বা দাবির ব্যাপারে তাৎক্ষণিক কোনো প্রতিক্রিয়া দেননি। বরং তিনি পাল্টা সতর্ক করেছেন ইউক্রেনে যে কোনো সামরিক অভিযান চালালে রাশিয়াকে তার ভয়াবহ পরিণতি ভোগ করতে হবে।
প্রসঙ্গত, ২০১৪ সালে রাশিয়ার ক্রাইমিয়া দখল এবং ইউক্রেনের জাতিগত রুশ অধ্যুষিত ডনবাস অঞ্চলে সশস্ত্র বিদ্রোহকে কেন্দ্র করে গত সাত বছর ধরে রাশিয়ার সাথে পশ্চিমা ন্যাটো জোটের সম্পর্কে টানাপোড়েন চলছে। অনেক পর্যবেক্ষক বলছেন এই টানাপড়েন দিনকে দিন বিপজ্জনক চেহারা নিচ্ছে।
মূলত ইউক্রেনের ন্যাটো জোটে যোগ দেয়া বা না দেয়াকে কেন্দ্র করেই পরিস্থিতি আজ যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে। ইউক্রেন যে ন্যাটোতে যোগ দিতে উদগ্রীব তা অজানা কিছু নয়। আর নিজেদের দোরগোড়ায় আরেকটি ন্যাটো দেশের উপস্থিতি যে রাশিয়া মানবে না, তাও নতুন কিছু নয়। পুতিন মনে করছেন ন্যাটোতে ঢোকার ব্যাপারে পশ্চিমারা ইউক্রেনের বর্তমান ক্ষমতাসীনদের আশা যোগাচ্ছে। ন্যাটোর পক্ষ থেকে যেভাবে ইউক্রেনকে অস্ত্র এবং সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে তাতে পুতিন প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত।
উল্লেখ্য, ইউক্রেন সম্প্রতি তুরস্কে তৈরি বেরাকতার সামরিক ড্রোন কিনেছে যা নিয়ে রাশিয়া ক্ষিপ্ত। পূর্ব ইউক্রেনে রুশ সমর্থিত বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে প্রয়োগের জন্য তুরস্কে তৈরি এই ড্রোন কিনেছে ইউক্রেন। ক্রাইমিয়ার কাছে আকাশে সম্প্রতি পারমানবিক বোমা ফেলতে সক্ষম দুটো আমেরিকান যুদ্ধ বিমান উড়তে দেখার ঘটনায় মস্কো প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত।
সেই সাথে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনেস্কির সাম্প্রতিক কিছু মন্তব্যে রাশিয়া ক্ষিপ্ত। তিনি সম্প্রতি বলেছেন রাশিয়ার কাছ থেকে ক্রাইমিয়াকে মুক্ত করা তার সরকারের লক্ষ্য। ডনবাস অঞ্চলে রুশ সমর্থিত বিদ্রোহীদের দমনে বড় ধরণের সামরিক অভিযান চালানোর ইঙ্গিতও ইউক্রেন দিচ্ছে। এসব কথাকে রাশিয়া উস্কানি হিসাবে দেখছে। মস্কো মনে করছে পশ্চিমাদের ভরসায় ইউক্রেন এসব কথা বলার সাহস পাচ্ছে।
পাল্টাপাল্টি অবস্থান
ইউক্রেন ইস্যুতে রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের উত্তেজনাও চরমে পৌঁছেছে। সীমান্তে ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করা হলে উপযুক্ত জবাব দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। অন্যদিকে, ইউক্রেনের ওপর হামলা হলে রাশিয়াকে চড়া মূল্য দিতে হবে বলে পাল্টা হুঁশিয়ারি দিয়েছে ন্যাটো ও যুক্তরাষ্ট্র।
সীমান্তে শুধু সেনা সমাবেশই নয়, রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনে অভ্যুত্থান চেষ্টায় মদদ দেয়ার অভিযোগও এনেছে ইউক্রেন। দেশটির প্রধানমন্ত্রী বলেন, এরই মধ্যে রাশিয়ার অভ্যুত্থান চেষ্টা প্রমাণ পেয়েছে তার দেশ।
প্রসঙ্গত, ইউক্রেন সীমান্তে রুশ সেনা সমাবেশ নিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটো ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের দিন দিন আরও অবনতি হচ্ছে। সীমান্তে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র সরঞ্জাম, সাঁজোয়া যান ও প্রায় এক লাখ সেনাসহ হামলার ছক কষছে রাশিয়া, এমনই দাবি ইউক্রেনের গোয়েন্দাদের। জানুয়ারির শেষ বা ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকে এই হামলা চালানো হতে পারে বলেও আশঙ্কা তাদের।
ইউক্রেন সীমান্তে রাশিয়ার ব্যাপক সেনা উপস্থিতি ও রণসরঞ্জাম মোতায়েন নিয়ে মস্কোকে আবারও সতর্ক করেছেন ন্যাটোর প্রধান জেন্স স্টোলট্যানবার্গ। তিনি বলেন, পশ্চিমা দেশগুলো এরই মধ্যে রাশিয়াকে দেখিয়ে দিয়েছে অর্থনীতিসহ আরও কীভাবে নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে ব্যবস্থা নিতে হয়।
ন্যাটোপ্রধান বলেন, রাশিয়ার সামরিক উপস্থিতির টের পেয়েছি আমরা। ড্রোন ও অনেক সেনা সীমান্তে জড়ো হয়েছে। আমরা চাই রাশিয়া তাদের অবস্থান পরিষ্কার করুক। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতেই রাশিয়াকে এটা করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, স্বাধীন সার্বভৌম ইউক্রেনের বিরুদ্ধে কোনো শক্তি ব্যবহার করা হলে রাশিয়াকে এর চড়া মূল্য দিতে হবে। সাম্প্রতিক সময়ে আমরাও এই অঞ্চলে আমাদের শক্তি বাড়িয়েছি। রাশিয়ার যে কোনো আগ্রাসন থেকে আমাদের মিত্রদের সুরক্ষা দিতেই আমরা এই ব্যবস্থা নিয়েছি।
তবে সীমান্তে পশ্চিমাদের সামরিক উপস্থিতি নিয়ে ন্যাটোকে পাল্টা হুঁশিয়ারি দিয়েছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। মঙ্গলবার এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ইউক্রেনের মাটি ব্যবহার করে কোনো ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করা হলে এর সমুচিত জবাব দেওয়া হবে।
রুশ প্রেসিডেন্ট বলেন, রুশ সীমান্তে ব্যাপকাকারে যে সামরিক মহড়া চালানো হচ্ছে এটি উদ্বেগের। আমাদের নিরাপত্তার স্বার্থে আমরা বাধ্য হয়ে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করেছি। এটা আমাদের সতর্কতামূলক প্রস্তুতি। আমরা এখনো এটির প্রয়োগ করিনি।
তিনি বলেন, ইউক্রেন অঞ্চলে কোনো ধরনের সামরিক শক্তি ব্যবহার করা হলে মস্কোতে পৌঁছাতে এটির সময় লাগবে ৭ থেকে ১০ মিনিট। আর হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র হলে এর সময় লাগবে মাত্র পাঁচ মিনিট।
এসডব্লিউ/এসএস/১১৩০
আপনার মতামত জানানঃ