সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ১৩ নভেম্বর থেকে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি৷ হাসপাতালে নিবিড় পর্যবেক্ষণ বা সিসিইউতে রয়েছেন তিনি৷ ডাক্তাররা তাকে বেশ কয়েকবার দ্রুত উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন৷ প্রসঙ্গত, শর্ত সাপেক্ষে জেল থেকে মুক্ত হওয়ার পর ইতিমধ্যেই একাধিকবার খালেদা জিয়াকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে৷
এর মধ্যে ২৭ এপ্রিল থেকে টানা ৫৪ দিন তিনি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন তিনি৷ এ সময়ে বিভিন্ন সময় তার আর্থ্রাইটিস, ডায়াবেটিস, কিডনি, ফুসফুস, চোখের সমস্যাসহ নানা জটিলতায় ভোগার তথ্য গণমাধ্যমে উঠে আসে৷
কেন বিদেশে নেয়া প্রয়োজন?
লিভার সিরোসিসের চিকিৎসায় খালেদা জিয়ার ট্রান্সজুগুলার ইন্ট্রাহেপাটিক পোর্টোসিস্টেমিক সান্ট (টিআইপিএস) করানো প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন তার চিকিৎসক।
গত কাল সন্ধ্যা সোয়া ৭টার দিকে গুলশানে খালেদা জিয়ার বাসায় এক ব্রিফিংয়ে খালেদা জিয়ার চিকিৎসার জন্য গঠিত মেডিকেল বোর্ডের প্রধান অধ্যাপক ডা. ফখরুদ্দিন মোহাম্মদ সিদ্দিকী বলেন, ভারতীয় উপমহাদেশ বা সিঙ্গাপুর-ব্যাংককেও এর চিকিৎসা নেই।
গ্যাস্ট্রোইনটেস্টিনাল রক্তক্ষরণে ভুগছেন বলে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ‘ট্রান্সজুগুলার ইনট্রাহেপ্যাটিক পোর্টোসিস্টেমিক শান্ট (টিআইপিএস)’ চিকিৎসার প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক।
খালেদা জিয়ার বর্তমান শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে মিডিয়াকে ব্রিফ করার সময় মেডিকেল বোর্ডের চিকিৎসক ডা. ফখরুদ্দীন মোহাম্মদ সিদ্দিকী বলেন, ‘এটি তার জন্য একমাত্র জীবন রক্ষাকারী চিকিৎসা। কিন্তু প্রযুক্তিটি ভারতীয় উপমহাদেশে, এমনকি ব্যাংকক বা সিঙ্গাপুরেও পাওয়া যায় না।’
টিআইপিএস হলো লিভারের মধ্যে একটি কৃত্রিম চ্যানেল, যা ইনফ্লো পোর্টাল শিরা এবং আউটফ্লো হেপাটিক শিরার মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করে।
তিনি আরও বলেন যে, খালেদার সাম্প্রতিক গ্যাস্ট্রোইনটেস্টিনাল রক্তক্ষরণগুলোর উৎস সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা করতে পারছেন না বলে ডাক্তাররা অসহায় বোধ করছেন।
খালেদা জিয়ার লিভার সিরোসিস হয়েছে জানিয়ে এই চিকিৎসক জোর দিয়ে বলেছেন যে, চিকিৎসার জন্য তাকে অবিলম্বে বিদেশে পাঠানো উচিত।
অধ্যাপক সিদ্দিকী আরও বলেন, ‘ম্যাডাম এখন সিরোসিস অব লিভারে আক্রান্ত। হিমোগ্লোবিন লেভেল প্রথমবার কমে হয়েছিল ৫ দশমিক ৫। তারপর আমরা তাকে চার ব্যাগ রক্ত দিয়ে হিমোগ্লোবিন লেভেল ৯-১০ এর কাছাকাছি নিয়ে গিয়েছিলাম। আবার সেটা কমে এসেছিল ৭ দশমিক ৮ এ। তারপর আবার রক্ত দিয়ে সেটা স্বাভাবিক করার চেষ্টা করি।’
তিনি আরও বলেন, ‘এর আগে তিনি চেস্ট টিউব নিয়ে ১৭ দিন কাটিয়েছেন। প্রতিদিন ওনার ফ্লুয়িড বের হয়ে এসেছে। প্রতিদিন উনি নিজের চোখে ব্লাড দেখেছেন। এন্ডলেস একটা সিচুয়েশন, সেখান থেকেও কিন্তু আমরা কনফিডেন্টলি বের হয়ে এসেছি।’
অধ্যাপক সিদ্দিকী বলেন, ‘মনোবল ওনার অনেক দৃঢ়। উনি আমাদের যথেষ্ট বিশ্বাস করেন। তবে আমাদের আর কিছু করার উপায় নেই। দ্যাট টাইম উই ওয়্যার কনফিডেন্ট, কিন্তু দিস টাইম আমরা হেল্পলেস ফিল করছি। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য মিলিয়ে অন্তত ১৭ থেকে ২৩ জনের মেডিকেল টিম কাজ করছে।’
বর্তমান অবস্থা
এ সময় ডা. শামসুল আরেফিন খালেদা জিয়ার বর্তমান অবস্থা ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘আমাদের শরীরে দুটি সার্কুলেশন সিস্টেম আছে। একটা হলো পোর্টাল সার্কুলেশন সিস্টেম, আরেকটা সিস্টেমিক সার্কুলেশন সিস্টেম। লিভারে দুটা সিস্টেমই কার্যকর। লিভারে টোটাল যে ব্লাড যায় তার তিন ভাগের এক ভাগ যায় সিস্টেমিক সার্কুলেশন থেকে আর দুই ভাগ যায় পোর্টাল সার্কুলেশন থেকে।’
‘এখানে যেটা হয়েছে, তার (খালেদা জিয়ার) পোর্টাল প্রেসার বেড়ে গেছে। কারণ তার লিভারের ভেতরের নরমাল চ্যানেলগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যে কারণে পোর্টাল প্রেসার বেড়ে যায় এবং যেসব ভেইন খাদ্যনালীতে থাকে সেগুলো ফুলে গিয়ে ফেটে যায়। সেজন্য সিভিয়ার ব্লিডিং হয়।’
তিনি বলেন, ‘এই সিচুয়েশনে আমরা যেটা করেছি সেটা ইন্টারন্যাশনাল প্রাকটিস। এটার পরে আবার ব্লিডিং হলে আরও কিছু জিনিস আছে যেগুলো আমরা করি, স্পেশাল কিছু কেমিক্যাল এজেন্ট আছে সেগুলো ইনজেক্ট করি অনেক সময়। আনফরচুনেটলি সেটা আমাদের দ্বারা সম্ভব হয়নি এবং এখন আমাদের দেশে সেই ওষুধগুলো পাওয়া যায় না।’
এ চিকিৎসক আরও বলেন, ‘তৃতীয়ত যেটা আছে সেটা হলো টিপস। লিভারের ভেতরে টোটাল প্রেসার কমানোর জন্য সিস্টেমিক সার্কুলেশন এবং পোর্টাল সার্কুলেশনের মধ্যে একটা কমিউনিকেশন করে দেওয়া। এটা একটা হাইলি টেকনিক্যাল কাজ। এটা সচরাচর হয় না।’
‘আমাদের দেশে আমি দেখিনি কোনো টিপস করা রোগী এসেছে। রোগীদের দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয়বার ব্লিডিং হলে সার্ভাইভ করা কঠিন হয়ে যায়। সেজন্য এ সেন্টারগুলো মেইনলি আমেরিকা ও ইউরোপে হয়। বিশেষত ইউকে জার্মানি এবং ইউএসএ। ওইসব দেশে এগুলোর জন্য অ্যাডভান্সড সেন্টার আছে। তবে সেসব দেশেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে নেই। দুই-চারটা সেন্টার আছে। বিশ্বের সব রোগীরা সেসব সেন্টারে যায়।’
অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ
ফখরুদ্দিন সিদ্দিকী আরও বলেন যে, খালেদার রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কয়েকবারই কমে গেছে। এছাড়াও তার বেশ কয়েকবার রক্তবমি হয়েছে।
হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার শরীরে এরই মধ্যে কয়েকবার রক্তক্ষরণ হয়েছে। সামনে আবার রক্তক্ষরণ হলে তার মৃত্যুঝুঁকি বেড়ে যাবে। তাই বর্তমানের স্ট্যাবল অবস্থাতেই তাকে বিদেশের উন্নত মেডিকেল সেন্টারে স্থানান্তর করা দরকার।
তিনি জানান, এ পর্যন্ত খালেদা জিয়ার তিন দফায় রক্তক্ষরণ হয়েছে। তৃতীয়বার রক্তক্ষরণ অনেক বেশি ছিল বলে জানান ফখরুদ্দিন সিদ্দিকী। তবে আজ রক্তক্ষরণ হয়নি।
ফখরুদ্দিন সিদ্দিকী বলেন, আগামী সপ্তাহে খালেদা জিয়ার রক্তক্ষরণ হওয়ার আশঙ্কা ৫০ শতাংশ এবং ৬ষ্ঠ সপ্তাহে রক্তক্ষরণের সম্ভাবনা ৭০ শতাংশ।
চিকিৎসক দলের প্রধান ডা. এফ এম সিদ্দিকী বলেন, ‘আমরা আশঙ্কা করছি, ম্যাডামের যদি পুনরায় রক্তক্ষরণ হয়, তাহলে সেটি নিয়ন্ত্রণ করার মতো সাপোর্টিং টেকনোলজি আমাদের এখানে নেই। সে ক্ষেত্রে ওনার আবার রক্তক্ষরণ হলে মৃত্যুঝুঁকি অনেক বেড়ে যাবে।’
তিনি আরও বলেন, আমরা আমাদের সাধ্যমতো দেশের সবচেয়ে সেরা চিকিৎসকদের দিয়ে ম্যাডামের (খালেদা জিয়া) চিকিৎসা করে যাচ্ছি। কিন্তু তার যে চিকিৎসাটি প্রয়োজন, সেটি দেশে সম্ভব নয়।
শুধু বাংলাদেশ নয়, উপমহাদেশ তো বটেই, সিংগাপুর-ব্যাংককেও এ ধরনের চিকিৎসা নেই। এটি বিশ্বের হাতেগোনা কয়েকটি অ্যাডভান্সড সেন্টারেই অত্যন্ত দক্ষ কয়েকজন চিকিৎসক করে থাকেন।
এসডব্লিউ/এসএস/১০১৫
আপনার মতামত জানানঃ