সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ১৩ নভেম্বর থেকে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি৷ এখন পর্যন্ত যতটুকু জানা যাচ্ছে, তিনি হাসপাতালে নিবিড় পর্যবেক্ষণ বা সিসিইউতে রয়েছেন৷ ডাক্তাররা তাকে বেশ কয়েকবার দ্রুত উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন৷
শর্ত সাপেক্ষে জেল থেকে মুক্ত হওয়ার পর একাধিকবার খালেদা জিয়াকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে৷ এরমধ্যে ২৭ এপ্রিল থেকে টানা ৫৪ দিন তিনি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন৷ বিভিন্ন সময় তার আর্থ্রাইটিস, ডায়াবেটিস, কিডনি, ফুসফুস, চোখের সমস্যাসহ নানা জটিলতায় ভোগার তথ্য গণমাধ্যমে উঠে আসে৷ তবে প্রকৃত তথ্য নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে জটিলতা, বিভ্রান্তি।
দলীয় ঐক্যের অভাব
সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপি চেয়ারপার্সনের অসুস্থতার ধরন নিয়ে সাধারণ মানুষ অনেকটাই অন্ধকারে থেকেছেন৷ এর কারণ কী? বিএনপি বিষয়ক সংবাদ নিয়মিত কাভার করেন এমন একজন টেলিভিশন সাংবাদকর্মী জানান প্রথমত, বিএনপি নেতারা চান না তাদের নেত্রীকে দুর্বল হিসেবে উপস্থাপন করতে৷ এতে কর্মীদের মধ্যে হতাশা নেমে আসতে পারে বলে মনে করেন দলটির নীতিনির্ধারকরা৷ আর সে কারণে খালেদা জিয়া মানসিকভাবে কতটা দৃঢ় আছেন সংবাদমাধ্যমে বা দলীয় কর্মসূচীতে সেই বার্তাটি বারবার দেয়ার চেষ্টা করেন তারা৷
দ্বিতীয়ত, ঐ সাংবাদিক মনে করেন, বিএনপির উচ্চ পর্যায়ের নেতাদের অনেকে আসলে নিজেরাও ভালো করে খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা জানেন না৷
এদিকে, দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সুচিকিৎসার দাবিতে রাজপথে আন্দোলন করছেন বিএনপির নেতারা। তবে তারা নিজেরাও ভালো করে খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা জানেন না। এমনকি দলীয় প্রধানকে দেখতে হাসপাতালে যেতেও পারছেন না তারা। এ বিষয়ে আলাপকালে চাপা ক্ষোভ প্রকাশ করেন নেতারা। তারা বলেন, ইচ্ছা থাকলেও হাসপাতালে যাওয়ার অনুমতি নেই আমাদের। পরিবারের সদস্যরা সব কিছুর মধ্যে আমাদের জড়াতে চান না।
তবে খালেদা জিয়াকে দেখতে হাসপাতালে যেতে সিনিয়র নেতাদের অনুমতি না মিললেও অন্যান্য ছোট দলের বড় নেতারা ঠিকই যাচ্ছেন। নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, রেজা কিবরিয়া, ভিপি নূর, জোনায়েদ সাকি, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীসহ অনেকেই খালেদা জিয়াকে হাসপাতালে দেখে এসে তার শারীরিক অবস্থা তুলে ধরে তাকে সুচিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর দাবি জানিয়েছেন।
তথ্য বিভ্রাট
গত ২০ নভেম্বর বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে খবর বের হয় এন্ডোসকোপি পরীক্ষায় খালেদা জিয়ার ‘লিভার সিরোসিস ধরা পড়েছে’৷ বিএনপির চেয়ারপার্সনের সাবেক প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান সোহেল তার এক ফেসবুক পোস্টেও এই তথ্য দেন৷
সেখানে তিনি লিখেন, ‘‘তার রোগ ও শারীরিক অবস্থার কথা প্রচার করা না হলেও আমি সাংবাদিকতার কলাকৌশল প্রয়োগে বিভিন্নভাবে খোঁজ-খবর করে নিশ্চিত হয়েছি যে, তিনি তার পুরনো জটিল রোগগুলো ছাড়াও ডিকমপেন্স্যাটেড লিভারসিরোসিস-এ আক্রান্ত হয়েছেন৷’’
তবে একদিন পর খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক এজেডএম জাহিদ হোসেন জানান, এই খবর সঠিক নয়৷ তিনি বলেন, ‘‘ম্যাডাম লিভার, কিডনি, হার্টের জটিলতায় ভুগছেন৷ রয়েছে ডায়াবেটিসও৷ এখন গণমাধ্যম কোথা থেকে লিভার সিরোসিসের সংবাদ পেলেন, সেটা আমার জানা নেই৷’’
অন্যদিকে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রতিদিন অনেকটা একই সুরে বলে যাচ্ছেন, ‘‘ম্যাডাম অত্যন্ত গুরুতরভাবে অসুস্থ৷ যে কথা আমি বলেছিলাম প্রথম দিনে, জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে৷ এই কথাটাই অ্যাপ্রোপ্রিয়েট কথা৷’’ একইদিন বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীও বলেন, ‘তিনি এখন হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন৷’’
এমন অবস্থায় খালেদা জিয়ার চিকিৎসা আর অসুস্থতা নিয়ে সাধারণ মানুষ তো বটেই এমনকি বিএনপির ভিতরে দলীয় কর্মীদের মধ্যেও বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে বলে জানালেন একটি সংবাদপত্রে দীর্ঘদিন বিএনপি বিটে কাজ করা প্রতিবেদক৷ প্রতি রাতেই খালেদা জিয়ার মৃত্যুর গুজব রটছে উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, এই পরিস্থিতি তৈরি হতো না যদি মেডিকেল বোর্ডের সদস্যরা বা তার ব্যক্তিগত চিকিৎসকরা নিয়মিত আপডেট দিতেন৷ যদিও তিনি বলেছেন, রোগীর প্রাইভেসি রক্ষা করতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আইনগতভাবে বাধ্য৷ তাই তারা এ নিয়ে কথা বলবেন না৷
অন্যদিকে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ছাড়া খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা নিয়ে অন্য কেউ কথা না বলতে দলের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানা গেছে৷ তাই দলের গুরুত্বর্পূণ পদে থাকা ব্যক্তিগত চিকিৎসকরাও এখন সংবাদমাধ্যমে মুখ খুলছেন না৷
এমন পরিস্থিতিতে খালেদা জিয়ার চিকিৎসার চেয়ে রাজনৈতিক জল ঘোলাই যেন বেশি হচ্ছে৷ বিএনপি মহাসচিব যা বলেন তা নিয়ে পরদিন পাল্টা বক্তব্য দেন সরকার দলীয় নেতারা৷ দুই দলের কথার মারপ্যাচে খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার দিনকে দিন অবনতির আশঙ্কা থাকছে৷
গত বুধবার ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীও উদ্বেগজনক চিত্র তুলে ধরেছেন৷ তিনি জানান, হাসপাতালে খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় নিয়োজিত ছয় ডাক্তার তাকে বিস্তারিত জানিয়েছেন এবং তিনি নিজেও প্রতিদিনের ফাইলের প্রতিটি লেখা পড়েছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘খালেদা জিয়া অত্যন্ত কঠিন অবস্থায় আছেন৷ যেকোনো মুহূর্তে চলে যেতে পারেন৷ যেকোনো দিন চলে যেতে পারেন৷ তার অবস্থা অত্যন্ত ক্রিটিক্যাল৷ আমার কাছে আশ্চর্য লাগছে, বিএনপি এত দিন এই কথা জানায়নি! হয়তো তারা জানতেনই না৷’’
খালেদা জিয়ার চিকিৎসা বাংলাদেশে সম্ভব নয় উল্লেখ করে অবিলম্বে তাকে দেশের বাইরে পাঠানোর দাবি জানান তিনি৷ তবে সরকারের পক্ষ থেকে এখনও ইতিবাচক সাড়া মেলার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না৷ বিএনপি এখন পর্যন্ত যেসব কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে তাও যথেষ্ট চাপ তৈরি করতে পারছে না৷ শুরুতে যে টেলিভিশন সাংবাদিকের কথা বলেছিলাম তার বক্তব্য, এর আগেও খালেদা জিয়ার জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার ক্ষেত্রে দল কোন ভূমিকা রাখতে পারেনি৷ বরং সরকারের সঙ্গে পরিবারের আলোচনার মাধ্যমেই তা সম্ভব হয়েছে৷ এবারও হয়ত তেমন চেষ্টাই করা হচ্ছে৷
বিশেষজ্ঞদের মতে, কেবল সাবেক প্রধানমন্ত্রী হিসেবেই নয়, সাজাপ্রাপ্ত আসামি হিসেবেও খালেদা জিয়ার চিকিৎসা নিশ্চিত করার দায় সরকারের উপর বর্তায়৷ প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি থেকে শুরু করে মন্ত্রী-এমপিরা যখন স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্যেও বিদেশ ছোটেন তখন প্রয়োজন হলে খালেদা জিয়াকেও উন্নত চিকিৎসার জন্য সেই সুযোগ দেওয়া উচিত৷ সরকার চাইলে নিয়মের মধ্যেই সেটি সম্ভব হতে পারে, যেমনটা তার শর্তসাপেক্ষে মুক্তির ক্ষেত্রে হয়েছে৷
এসডব্লিউ/এসএস/১৩৫৮
আপনার মতামত জানানঃ