মানুষের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাও ক্রমশ বিবর্তন ঘটাচ্ছে বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা। কারণ ‘হিউম্যান ইমিউনোডেফিসিয়েন্সি ভাইরাস’ বা এইচআইভি সংক্রমিত এক তরুণীর শরীর থেকে হঠাৎই উধাও ভাইরাস। পুরোপুরিই সুস্থ ওই তরুণী।
প্রাণঘাতী অ্যাকোয়ার্ড ইমিউনো ডেফিসিয়েন্সি সিনড্রোম (এইডস) রোগে আক্রান্ত ওই নারীর দেহে এ রোগের জন্য দায়ী ভাইরাস নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে, এইডস থেকে বর্তমানে সম্পূর্ণ সুস্থ তিনি। অভূতপূর্ব এই ঘটনাটি ঘটেছে কানাডায়।
৩০ বছর বয়সী ওই নারী বর্তমানে কানাডায় বসবাস করলেও তার আদি নিবাস আর্জেন্টিনায়। সেখান থেকে ২০১৩ সালে কানাডায় এসে বসবাস শুরু করেন তিনি।
ওই বছরই এইডস ধরা পড়েছিল তরুণীর। তার স্বামীরও এইডস ছিল। তিনি মারা যান। কিন্তু ভাইরাসকে ‘হারিয়ে’ দিয়েছেন তরুণী। বিস্মিত চিকিৎসকেরা। তাদের দাবি, প্রাকৃতিক ভাবে কারও এইচআইভি-মুক্ত হওয়ার ঘটনা বিশ্বে এই প্রথম।
আর্জেন্টিনার এসপেরানজা শহরের বাসিন্দা ৩০ বছর বয়সি এইচআইভি আক্রান্ত তরুণী আর পাঁচজন সংক্রমিতের মতো ছিলেন না। চিকিৎসকদের পরিভাষায় ‘এলিট কন্ট্রোলার’ ছিলেন তরুণী। অর্থাৎ সংক্রমিত হওয়ার বহু বছর পড়ে এইচআইভি-র উপস্থিতি ধরা পড়ে শরীরে।
অসুখ ধরা পড়ার পরে ওষুধ খেতে শুরু করেন তিনি। তার পরে আচমকাই এই ঘটনা। এক সময়ে তিনি ওষুধ খাওয়া বন্ধ করে দেন। কিন্তু অসুখ আর ফিরে আসেনি। যেটা সাধারণত হয় না। সম্প্রতি এই সংক্রান্ত একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে আমেরিকান জার্নাল ‘অ্যানালস অব ইন্টারনাল মেডিসিন’-এ।
মানব শরীরে যে কোনও ভাইরাস সংক্রমণের পরে দেখা যায়, ভাইরাসটি শরীরে প্রতিলিপি গঠন করতে থাকে। এই আর্জেন্তিনীয় তরুণীর ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, তার ডিএনএ-তে ভাইরাসের উপস্থিতির কোনও ছাপ নেই। অর্থাৎ ‘প্রোভাইরাস’ গঠন হয়নি।
‘প্রোভাইরাস’ হল— যখন ভাইরাসের জেনেটিক মেটেরিয়াল মানব কোষের (হোস্ট সেল) ডিএনএ-র মধ্যে ঢুকে যায় এবং মানব কোষের জিনোমের সঙ্গেই প্রতিলিপি গঠন করতে থাকে। এ ক্ষেত্রে গবেষকেরা বহু ‘তল্লাশির’ পরেও ভাইরাসের অস্তিত্ব খুঁজে পাননি তরুণীর দেহে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটিকে বলে ‘স্টেরিলাইজিং কিওর’। অর্থাৎ, ওই তরুণীর শরীরের ভাইরাসের কোনও প্রতিলিপি নেই।
কিন্তু কী ভাবে এই ঘটনা ঘটল? বিজ্ঞানীরা বলছেন— ‘রহস্য’। এর আগেই দু’জন এইচআইভি রোগীর সুস্থ হয়ে ওঠার নজির রয়েছে। কিন্তু তাদে রক্তের ক্যানসার ছিল। সে জন্য তাঁদের দীর্ঘ চিকিৎসা চলেছিল। স্টেম সেল প্রতিস্থাপণও করা হয়েছিল। তার পরে এক সময়ে তারা এইচআইভি-মুক্ত হন।
কিন্তু এ ক্ষেত্রে এ সব কিছুই হয়নি। সবটাই ঘটেছে প্রকৃতির নিয়মে। এবং কী ভাবে হল, তার কোনও উত্তর নেই চিকিৎসকদের কাছে। একটি বিষয়েই শুধু তারা দ্বিধাহীন। তা হল— ‘‘এই রোগ থেকে সেরে ওঠা সম্ভব।’’
বস্টনের ‘রেগন ইনস্টিটিউট’-এর বিশেষজ্ঞ শু ইউ এবং বুয়েনেস আইরেসের ‘ইনস্টিটিউট অব বায়োমেডিক্যাল রিসার্চ ইন রেট্রোভাইরাস অ্যান্ড এইডস’-এর নাতালিয়া লুফের বলেন, ‘‘ওই ‘এলিট কন্ট্রোলার’-এর রক্ত ও কলাকোষে ব্যাপক পপরীক্ষা-নিরীক্ষার পরেও ভাইরাসটি খুঁজে পাওয়া যায়নি। এতে মনে হচ্ছে, প্রাকৃতিক ভাবেই ওই রোগী সুস্থ হয়ে উঠেছেন।’’
বিশেষজ্ঞদের পর্যবেক্ষণ, ‘‘এই ভাবে প্রাকৃতিক নিয়মে শরীর থেকে ভাইরাসের অবলুপ্তির ঘটনা বিরল। কিন্তু এমনটা হওয়াও যে সম্ভব, তা এই প্রথম জানা গেল।’’
এইডস মহামারি শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত ৮ কোটি মানুষ এইচআইভি সংক্রমিত হয়েছেন। ৩ কোটি ৬৩ লক্ষ মানুষ মারা গিয়েছেন। ২০২০ সালের পরিসংখ্যান বলছে, ওই বছর গোটা বিশ্বে অন্তত ৩ কোটি ৭৭ লক্ষ মানুষ এইচআইভি নিয়ে জীবিত ছিলেন। এইচআইভি সংক্রমিত কেউ দীর্ঘদিন বিনা চিকিৎসায় থাকলে তা এইডস (অ্যাকোয়ার্ড ইমিউনোডেফিসিয়েন্স সিন্ড্রোম)-এ পরিণত হয়।
গত শতকের ১৯৮১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম এইডসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। ওই বছরই দেশটির রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল (সিডিসি) এই রোগের জন্য দায়ী ভাইরাস এইচআইভিও শনাক্ত করে।
অনিরাপদ যৌনতা, সিরিঞ্জের সূঁচের মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করে এইচআইভি ভাইরাস। এছাড়া, মায়ের মাধ্যমেও এইডসে আক্রান্ত হয় শিশুরা। কোনো গর্ভবতী নারীর দেহে এইডসের জীবাণু থাকলে তা অনাগত সন্তানকেও সংক্রমিত করে।
সাহারা ও নিম্ন আফ্রিকার অঞ্চলগুলোতে এইডসের প্রকোপ সবচেয়ে বেশি। প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে লাখ লাখ মানুষ মারা যান এইডসে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেব অনুযায়ী, ২০১৮ সালে বিশ্বে এইডসে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিলেন ১০ লাখ মানুষ।
এ পর্যন্ত এইচআইভি-র কোনও চিকিৎসা নেই। এত দিন জানা ছিল, একবার কেউ সংক্রমিত হলে, সারা জীবন এই ভাইরাস নিয়েই বাঁচতে হবে তাকে। দশকের পর দশক গবেষণার পরেও পথ খুঁজে পাননি চিকিৎসকেরা। এ অবস্থায় এমন এক জন এইচআইভি জয়ীর খবর পেয়ে উচ্ছ্বসিত চিকিৎসক-বিশেষজ্ঞ মহল।
এসডব্লিউ/এসএস/১৪১৩
আপনার মতামত জানানঃ