মনজুরুল হক
তাজরীন গার্মেন্টস-এ আগুন ধরিয়ে ১১৭ জন গার্মেন্ট শ্রমিক পুড়িয়ে কয়লা করার ৯ বছর পূর্ণ হলো। গত ৯ বছর ধরে সেই একই কাশুন্দি গাওয়া হচ্ছে যা ২০১২ সালের অক্টোবরে গাওয়া হয়েছিল। বাস্তবতা হলো নিহত ১১৭ জন শ্রমিকের বেশিরভাগের আত্মিয়-স্বজন আজও বিচার পায়নি। শুধু বিচার বলি কেন? তাদের সকলে ক্ষতিপুরণও পায়নি।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটির প্রধান মাইন উদ্দিন খন্দকার সে সময় বলেছিলেন; ‘তাজরীন ফ্যাশনসের কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাটি তাদের কাছে নাশকতা বলে মনে হয়েছে।‘ স্পষ্টভাবে অগ্নিকাণ্ডকে নাশকতা বলার পরও মালিকদের কারও শাস্তি হয়নি। বরং সরকার তাদের রক্ষা করেছে। বীমার টাকা হাতিয়েছে, অন্য কারখানায় পুঁজি ট্রান্সফার করেছে, এবং এখন শান-সওকাতে জীবন যাপন করছে।
কীভাবে? কারণ সেই প্রতিবেদনেই একটুখানি ফাঁক রেখে সেই ফাঁক দিয়ে মালিকগংকে ইনডেমনিটি পাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে! বলা হয়েছিল- ‘সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রম নস্যাৎ এবং সরকারের পতনের লক্ষ্যেই এ অগ্নিকাণ্ড ঘটানো হয়’, যদিও কমিটি দোষীদের চিহ্নিত করতে পারেনি। আবার অন্যদিকে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির মালিককে অভিযুক্ত করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুপারশিও করা হয়েছে। একইসাথে, একটি শক্তিশালী গোয়েন্দা বাহিনীর মাধ্যমে নিবিড় তদন্ত করে “গুপ্ত অপশক্তিকে” খুঁজে বের করে স্থায়ীভাবে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশের কথাও বলা হয়েছিল। ব্যাস। ওখানেই শেষ। এরপর ফাইল তামাদি হয়েছে। নটে গাছটি মুড়েছে। গল্পও শেষ হয়েছে।
আসল ব্যাপারটা শ্রেণীর। এই অগণিত মৃত মানুষ, জ্যান্ত কবর হয়ে যাওয়া মানুষগুলো গার্মেন্টস শ্রমিক না হয়ে যদি সেনা সদস্য বা কর্মকর্তা হতো তাহলে কি এটা ঘটতো? জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী কাজে গিয়ে নিহত হওয়া সেনা সদস্য, কর্মকর্তাদের মৃত্যুর পর সরকারের তোড়জোড় দেখেননি? আনুষ্ঠানিক শোক। জাতীয় শোক।
একটা গড় হিসেব করলে দেখা যাবে এ যাবত এই গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি নামক ‘মানুষ হত্যা করার কারখানাগুলোয়’ প্রায় ১০ হাজার শ্রমিক পুড়ে মরেছে। এ যাবত পয়তাল্লিশটির মত ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। যার ভয়াবহতম অগ্নিকাণ্ড হচ্ছে ২৪ নভেম্বর রাতে তাজরীনে দোজখের আগুন। তার পর সবচেয়ে ভয়াবহ রানাপ্লাজা ডিজাস্টার, যেখানে ১১০০ শ্রমিক মারা গেছিল, যা ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে নির্মমতম এবং বিশালতম শ্রমিক জনসংখ্যার মৃত্যু। এই যে প্রায় ১০ হাজার দরিদ্র শ্রমিক পুড়ে এবং ভবনচাপা পড়ে মারা গেল তার ভেতর কি এক জনও কর্মকর্তা ছিল? না। কেন ছিলনা? তারা কি বিশেষ কোন ত্বরিকা আবিষ্কার করেছে? না তাও না। এর সহজ উত্তর তারা জানত যে এখনে একটু পরে হত্যাযজ্ঞ চলবে! কি ভাবে?
যদি ধরে নেয়া হয় যে প্রত্যেকটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পেছনে যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা আছে বা যথাযথ কারণ আছে। খুব সহজেই এই ধরণের ডিজাস্টারের পর ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা বিবৃতি দেন-‘সর্ট সার্কিট থেকে অগ্নিকাণ্ডের সূচনা।‘ যদি ধরে নেয়া যায় এই বিবৃতিই সঠিক তাহলে প্রশ্ন উঠবে সর্ট সার্কিট যে ঘটবে সেটা কর্মকর্তারা কিভাবে আগে থেকে জানল? যদি না জানবে তাহলে তারাও কেন ভিকটিম হলো না? কেন শত শত শ্রমিকের সাথে দু একজন কর্মকর্তা নিহত হলো না? এর উত্তর নেই। অনুমান করতে কষ্ট হয়না এই সব আগুন লাগার ঘটনার অধিকাংশই সংঘটিত। খুব ঠাণ্ডা মাথায় মালিকপক্ষের প্রচ্ছন্ন বা অপ্রচ্ছন্ন মদদে আগুন লাগানো হয়। প্রধানত যে সব কারণে আগুন লাগানো হয়- এক. কারখানা দেনাগ্রস্থ হলে। দুই. স্টক লট হলে, অর্থাৎ অর্ডার সময়মত শিপমেন্ট করতে না পারলে সেই বিরাট লট অবিক্রিত পড়ে থাকলে। তিন. বিদেশে টাকা পাচার সম্পন্ন হলে। চার. শ্রমিকদের কয়েক মাসের বেতন-বোনাস বাকি পড়লে। এবং পাঁচ. যদি কোনো কারণে ওই কারখানার শ্রমিকরা আন্দোলন করে ওই মালিকের কাছ থেকে ন্যায্য দাবী আদায় করে নেয় এবং মালিক সেই দাবী পুরণ করতে বাধ্য হয় তখন প্রতিশোধের জিঘাংসা থেকে আগুন লাগানো হতে পারে।
এর পর প্রশ্ন আসে প্রতি বছর কিংবা মাঝে মাঝেই যখন একই ধরণের ঘটনায় শত শত শ্রমিকের মৃত্যু ঘটে তার পরও কেন সরকারের তরফে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়না? প্রতিকার প্রশ্নে যে বিষয়গুলো উঠে আসে কেন তার যথাযথ বাস্তবায়ন হয় না? কেন এসব মনিটরিংয়ের জন্য বিশেষ সেক্টর খোলা হয়না? কেন সংশ্লিষ্ট মালিকদের আইনের আওতায় এনে শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়না? কেন কারখানাগুলো নিরাপদ হয়না? কেন কাকে ঘুষ দিয়ে কারখানাগুলো মৃত্যুকূপ হিসেবে বছরের পর বছর টিকে থাকে? সংশ্লিষ্ট কারখানাটি চালু করার আগে সংশ্লিষ্ট সরকারী দফতর থেকে স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তাজনিত সার্টিফিকেট নিতে হয়েছিল, সেটা কিভাবে ইস্যু হয়েছিল? তদন্ত করে সরকারী কর্মকর্তা সে সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন। তা কি আইনসম্মত ছিল? সেই কর্মকর্তারা কারা?
তাদের কি কখনো গ্রেপ্তার করা হবে? আজ থেকে প্রায় এক দশকেরও বেশী আগে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট কারখানা শ্রমিকদের নিরাপত্তার জন্য যে বিশদ দিক নির্দেশনা প্রদান করেছিল সেটির ঠিক কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে? যদি না হয়ে থাকে, তাহলে সংশ্লিষ্ট সরকারী আমলা, মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে এখনো আদালত অবমাননার জন্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না কেন?
সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন ডেভেলপমেন্ট এবং ডিজাস্টার নাকি হাত ধরাধরি করে আসে। যে যে কাজে দেশ-জাতির ডেভেলপমেন্ট হয় সেই সেই ডেভেলপমেন্টের দায় মেটাতে ডিজাস্টারও হয়। এবং তার নিশ্চিত বলি সাধারণ শ্রমিক। বিশেষ করে নারী এবং শিশু শ্রমিক। আজ অবধি কেন কোনো মালিক মরলো না আগুনে পুড়ে? সহজ উত্তর- মালিকরা পুড়ে মরার মতো জায়গায় থাকে না। তাদের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে আগুন প্রবেশ করে না। কেবল অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত হাভাতে শ্রমিকরাই (নারী এবং শিশু) আগুনে পুড়ে মরার জায়গাতে কাজ করে। তাদের পুড়ে মরাটাই যেন নিয়তি। এই সেক্টরের কারণে এ দেশে একটা নব্য এলিট শ্রেনী পয়দা হয়েছে, এবং তারা প্রয়োজনে বেশ্যার দালালের মতো উভয়পক্ষের মুনাফা লুটতে কুণ্ঠা বোধ করে না, এটা পরিসংখ্যান ছাড়াই বলে দেওয়া যায়। এই শ্রেণীর কোনো কোনো বুগর্জ মন্তব্য করেছেন গার্মেন্টস উঠে গেলে নাকি হাজার হাজার নারী ম্রমিক বেকার হয়ে বেশ্যাবৃত্তি করবে! দেখুন কী বিশ্লেষণের পাণ্ডিত্য! তার মানে বাংলাদেশে বেশ্যাবৃত্তিরও ভালো বাজার তৈরি হয়েছে! মাশাল্লাহ।
একটা দেশে সভ্য মানুষের (!) শহরে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর একই কায়দায় মানুষ পুড়ে মরছে। সরকার, সুশীল, বিবেকবান মানুষ বলাবলি করছে। বিবৃতি দিচ্ছে। সেমিনার হচ্ছে। আইন হচ্ছে। নীতি নির্ধারণ হচ্ছে। কর্মশালা হচ্ছে, কিন্তু কিছুতেই অসহায় শ্রমিকদের মৃত্যু বন্ধ হচ্ছে না। পরদিন কারখানা খুলছে। এই মেগাসিটির এক কোটি মানুষ ধান্ধায় নেমে যাচ্ছে। হাসছে, খাচ্ছে, ঘুমুচ্ছে, সংবাদপত্র পড়ছে এবং প্রতিকারহীন মৃত্যু কেবলই তার সংখ্যা বাড়িয়ে চলেছে।
………………………….
মনজুরুল হক
২৪ নভেম্বর, ২০২১
আপনার মতামত জানানঃ