অপরাধীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে কক্সবাজারের ৩৪ রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প। খুন, অপহরণ, চাঁদাবাজি, ধর্ষণ, মাদক কিংবা মানব পাচার শরণার্থী ক্যাম্পের নিত্য ঘটনা। ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তার এবং নিজেদের অবস্থান সংহত করতে প্রায়ই অস্ত্রের মহড়া কিংবা রক্তের হোলি খেলায় মেতে ওঠে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা। মাঝেমধ্যে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অভিযানের মুখে কেউ কেউ গ্রেপ্তার হলেও থামানো যাচ্ছে না শরণার্থী ক্যাম্পের সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর অপরাধ তৎপরতা।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে প্রতিদিন কোনো না কোনো অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। ক্যাম্পে হত্যাকাণ্ড, ছিনতাই, সন্ত্রাসী কার্যক্রম, অস্ত্র উদ্ধার, ইয়াবা ব্যবসা, বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ ও অনিয়মতান্ত্রিক কাজে রোহিঙ্গাদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যাচ্ছে।
আজ কক্সবাজারের উখিয়া কুতুপালং ক্যাম্প থেকে দেশীয় আগ্নেয়াস্ত্রসহ ডাকাতির প্রস্তুতিকালে ৫ জন চিহ্নিত রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীকে আটক করেছে ১৪ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ান (এপিবিএন)। এসময় তাদের কাছ থেকে ইয়াবা ট্যাবলেটও উদ্ধার করা হয়।
শনিবার (২০ নভেম্বর) সকাল ১০টায় বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ১৪ এপিবিএন এর অধিনায়ক পুলিশ সুপার নাইমুল হক।
আটকরা হলেন, ৩ নং ক্যাম্পের ব্লক-বি/১৩ এর মো. কবির আহমদের ছেলে নুর হোসেন (৩৮), কুতুপালং ক্যাম্প ব্লক-বি এর আবদুল করিমের ছেলে আলী হোসেন (২২) একই ক্যাম্পের ব্লক-জি এর মৃত আবদুল কাদেরের ছেলে নুর কাদের (২৩), ব্লক-এ এর তোফায়েল আহম্মদের ছেলে মো. হাসান (২৫) এবং ব্লক-সি এর মৃত সৈয়দুল ইসলামের ছেলে মো. সৈয়দ (২৬)।
এসপি নাইমুল হক জানান, শুক্রবার দিবাগত রাত ২টায় গোপন সংবাদের ভিত্তিতে জানতে পারি উখিয়ার রেজিস্টার্ড কুতুপালং ক্যাম্পে কতিপয় সন্ত্রাসীরা দেশীয় অস্ত্রসহ ডাকাতির প্রস্তুতি নিচ্ছে। ওই সংবাদে এপিবিএন এর একটি দল ঘটনাস্থলে অভিযান চালিয়ে ৫ জন চিহ্নিত রোহিঙ্গা ডাকাতকে আটক করা হয়। এসময় তাদের সঙ্গে থাকা আরো ১৪/১৫ পালিয়ে যায়। পরে তাদের দেহ তল্লাশি করে ১টি দেশীয় অস্ত্র ও মাদক ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করা হয়।
তিনি জানান, আটকদের বিরুদ্ধে পরবর্তী আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য উখিয়া থানায় সোপর্দ করা হয়েছে।
এর আগে গত ০৮ নভেম্বর কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরের এক্স-৪ ক্যাম্পের গহিন পাহাড়ে অভিযান চালিয়ে ‘অস্ত্র কারখানা’ থেকে তিন জন অস্ত্রের কারিগরসহ ১০টি অস্ত্র ও বিপুল অস্ত্র তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়।
র্যাব-১৫ অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল খায়েরুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, একটি চক্র দীর্ঘ দিন ধরে এ কারখানা তৈরি করে অস্ত্র বানিয়ে আসছিল। এখান থেকে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের কাছে অস্ত্র সরবরাহ করা হচ্ছে বলে তথ্য পায় র্যাব। এমন তথ্যের ভিত্তিতে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়িয়ে কারখানাটি শনাক্ত করা হয়।
তার আগে টেকনাফের ১৫ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এইচ/২ ব্লক থেকে আরসা সদস্য সন্দেহে দুই রোহিঙ্গাকে আটক করে কয়েকজন মাঝি। তারা হলেন ইমন হোসাইন (২১) ও ইদ্রিস (৩০)। তাদের ঘর তল্লাশি করে ৩টি ছোরা পাওয়া গেছে। পরে তাদের জামতলী পুলিশ ক্যাম্পে হস্তান্তর করা হয়।
এরপর টেকনাফের ২৪ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের টাওয়ারের সামনে থেকে সি ব্লকের রোহিঙ্গা সাদেককে (১৮) ৬০০ পিস ইয়াবাসহ আটক করে এপিবিএন পুলিশ।
একই দিন টেকনাফের চাকমারকুল ২১ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এ/৫ ব্লকে নিজ ঘর থেকে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী তোহা গ্রুপের সদস্য মো. হারুনকে (৩৩) আটক করে এপিবিএন পুলিশ। পরে তাকে টেকনাফ থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। জানা গেছে, গত ৫ নভেম্বর হারুনের নেতৃত্বে ওই ক্যাম্পের ডি ব্লকে আরসার বিরুদ্ধে ৭০/৮০ জন রোহিঙ্গার উপস্থিতিতে একটি মিটিং অনুষ্ঠিত হয়েছে।
একই দিন উখিয়া উপজেলার কুতুপালং ২ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ই/২ ব্লকে নিজ ঘর থেকে আরসার সদস্য মো. আনোয়ার প্রকাশ পুতিয়াকে (২৭) ২ হাজার ২৫০ ইয়াবা ও ৯টি দা-ছুরিসহ আটক করে এপিবিএন।
আজ কক্সবাজারের উখিয়া কুতুপালং ক্যাম্প থেকে দেশীয় আগ্নেয়াস্ত্রসহ ডাকাতির প্রস্তুতিকালে ৫ জন চিহ্নিত রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীকে আটক করেছে ১৪ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ান (এপিবিএন)। এসময় তাদের কাছ থেকে ইয়াবা ট্যাবলেটও উদ্ধার করা হয়।
জানা যায়, গত চার বছরে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ১২ ধরনের অপরাধে ১ হাজার ২৯৮টি মামলা হয়েছে। এতে আসামি হয়েছে ২ হাজার ৮৫০ রোহিঙ্গা। ক্যাম্পগুলোর ভেতরে ১৫ থেকে ২০টি সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে উঠেছে। তাদের নিয়ন্ত্রণে চলছে মাদক ব্যবসাসহ নানা অবৈধ কর্মকাণ্ড।
অভিযোগ উঠেছে, এখানে প্রতিদিন প্রায় শতকোটি টাকার ইয়াবার লেনদেন হয়। শুধু তাই নয়, দেশের সব ইয়াবা ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নাকি এসব ক্যাম্প থেকেই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও স্থানীয় বিভিন্ন সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
২০১৭ সালে নানা অপরাধে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা ছিল ৭৬টি; আসামি ছিল ১৫৯ রোহিঙ্গা। অথচ চলতি বছর মাত্র ছয় মাসেই ৫৬৭টি মামলায় রোহিঙ্গা আসামির সংখ্যা এক হাজার ছাড়িয়ে গেছে।
বিভিন্ন অপরাধজনিত কারণে বর্তমানে কক্সবাজার কারাগারে রয়েছে চার শতাধিক রোহিঙ্গা। মাদক পাচারের মতো অপরাধে জড়িয়ে এদের অনেকে বিপুল অর্থসম্পদের মালিকও হয়েছে।
স্থানীয় অধিবাসীরা বলছেন, নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে রোহিঙ্গারা।
অপহরণ, ধর্ষণ, ডাকাতি, মাদক চোরাচালানসহ নানা অপরাধ কর্মকাণ্ড রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে দিন দিন বাড়ছে বলে নানা পক্ষ থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করা হচ্ছে। সর্বশেষ আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের (এআরএসপিএইচ) চেয়ারম্যান মুহিবুল্লাহকে গুলি করে হত্যার পর রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর তৎপরতার বিষয়টি আবার সামনে এসেছে।
বাংলাদেশ পিস অবজারভেটরির (বিপিও) ‘রোহিঙ্গা শিবিরে নিরাপত্তা: সহিংসতার মাত্রা’ শীর্ষক প্রতিবেদনের সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত গত চার বছরের টেকনাফ ও উখিয়ার শিবিরগুলোতে ১০৮ জন নিহত হয়েছেন।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কর্মরত এনজিও কর্মীদের দাবি, অপরাধ জগৎ নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভেতরেই অন্তত ১৫ থেকে ২০টি সক্রিয় সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে উঠেছে। এর বাইরে ক্যাম্পকেন্দ্রিক রয়েছে আরও একাধিক সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাহিনী। প্রত্যেক বাহিনীতে ৩০ থেকে ১০০ জন পর্যন্ত সদস্য রয়েছে। সন্ধ্যার পর থেকে ক্যাম্পগুলো হয়ে ওঠে অপরাধের অভয়ারণ্য। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে গোলাগুলি ও খুনাখুনিতে জড়িয়ে পড়ে রোহিঙ্গারা। ক্যাম্পগুলোতে দিনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর নজরদারি থাকলেও রাতে তা অনেকটাই ঝিমিয়ে পড়ে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের সামনে ‘রোহিঙ্গা’ বিষয় একটি বড় ধরনের জটিল চ্যালেঞ্জ হতে যাচ্ছে, যা দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় সমাধান সম্ভব নয়। কূটনৈতিক আলোচনার পাশাপাশি রোহিঙ্গা নেতৃত্বের বিকাশ ঘটিয়ে বিকল্প পথের সরকারের সব আন্তরিক প্রচেষ্টা সহজে কার্যকর হচ্ছে না। রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশেরই নয়, সমগ্র বিশ্বের উদার গণতান্ত্রিক এবং মানবাধিকার রক্ষাকারী চ্যাম্পিয়নদের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ।
সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা বলেন, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যত দেরি করবে, খুনসহ নানা রকম সমস্যা তত বাড়বে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত হবে মিয়ানমার সরকারের ওপর বড় ধরনের চাপ তৈরি করে এ সমস্যার সমাধান করা।
কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের চার বছর পূর্তিতে এসে এটা স্পষ্ট যে মিয়ানমারের সংখ্যালঘু মুসলমানদের রাখাইনে ফেরত পাঠানো শুরুর কোনো সম্ভাবনা এই মুহূর্তে নেই। মিয়ানমারের সামরিক শাসন,আফগানিস্তানে তালিবান ক্ষমতায় থাকার পর এ অঞ্চলসহ ভূরাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের বিষয়টি আন্তর্জাতিক মনোযোগের কেন্দ্রে এখন আর নেই। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের সামনে এখন রোহিঙ্গা সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি সমাধানে জোর দেওয়া ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই। রোহিঙ্গা সংকট দক্ষিণ এশিয়াসহ এ অঞ্চলের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার জন্য বড় ঝুঁকি— বিষয়টি আন্তর্জাতিকভাবে সামনে নিয়ে আসতে হবে বাংলাদেশকে। এর পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের টেকসই প্রত্যাবাসনের জন্য এককভাবে চীনের ওপর নির্ভর না করে জাতিসংঘসহ আঞ্চলিক বিভিন্ন পক্ষকে সঙ্গে নিতে জোরালো কূটনৈতিক প্রচেষ্টা দরকার। প্রত্যাবাসন এবং রাখাইনে গণহত্যার জবাবদিহি নিশ্চিতে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন পক্ষের উদ্যোগে বাংলাদেশের সক্রিয় যুক্ততা জরুরি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৪৯
আপনার মতামত জানানঃ