মহাকাশের গভীর থেকে গোলার মতো ছুটে আসে পাথর বা ধাতুর তৈরি গ্রহাণু৷ সেগুলির মধ্যে কয়েকটির গতিপথ এমন যে তা পৃথিবীর জীবজগতের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে৷ প্রায় ১০ কিলোমিটার ব্যাসের এমনই একটি গ্রহাণু বহুকাল আগে আমাদের গ্রহে তাণ্ডব সৃষ্টি করেছিল৷ সেটির আঘাতে ডাইনোসার প্রজাতি লুপ্ত হয়ে যায়৷
কখনো যদি বিশাল আকারের কোনো গ্রহাণু বা ধূমকেতু পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসে, কী করবো আমরা? এই আশঙ্কা সামনে রেখে কিভাবে তা এড়ানো যায়, সে গবেষণাই করছেন বিশেষজ্ঞরা৷
দুই সপ্তাহের মধ্যেই নতুন একটি পরীক্ষামূলক অভিযান শুরু করতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা। অভিযানটির লক্ষ্য হলো পৃথিবীকে বিপজ্জনক গ্রহাণুর আঘাত থেকে সুরক্ষিত রাখা। পরীক্ষামূলক এ অভিযানের নাম ‘ডাবল অ্যাস্টারয়েড রিডাইরেকশন টেস্ট’, বা সংক্ষেপে ডার্ট।
বিশ্বে, কিংবা হয়তো গোটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডেই, এ ধরনের পরিকল্পনা এটাই প্রথম। ডিমরফস নামের একটি ঝুঁকিমুক্ত গ্রহাণুতে একটি মহাকাশযান দিয়ে ধাক্কা দেবে নাসা। ডিমরফস আদতে চাঁদের চেয়ে ছোট একটি উপগ্রহ, যার ব্যাস প্রায় ১৬০ মিটার।
অস্ট্রেলিয়ার নাইননিউজের প্রতিবেদনে বলা হয়, মহাকাশযান দিয়ে ধাক্কা দেয়ার মাধ্যমে ডিমরফসকে তার কক্ষপথ থেকে সরানো সম্ভব কি না, সেটাই এ পরীক্ষার মাধ্যমে দেখতে চান বিজ্ঞানীরা।
ইউনিভার্সিটি অফ কুইন্সল্যান্ডের গ্রহবিষয়ক বিজ্ঞানী ট্রেভার আয়ারল্যান্ড জানান, সম্ভাব্য বিপজ্জনক মহাজাগতিক বস্তুর আঘাত থেকে মানবজাতিকে রক্ষার দুটি উপায় রয়েছে। এর মধ্যে একটি হলো কৃত্রিমভাবে মহাজাগতিক বস্তুটিকে এর কক্ষপথ থেকে বিচ্যুত করা; দ্বিতীয় উপায় হলো গ্রহাণুর ওপর পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটানো।
অধ্যাপক আয়ারল্যান্ড বলেন, ‘গত কয়েক বছরে পৃথিবীর কাছাকাছি অনেকগুলো গ্রহাণু আবিষ্কার করেছি আমরা। প্রায় সবগুলোই মূলত আবর্জনার স্তুপ। তাই শক্তি প্রয়োগ করা হলে সেগুলো হয়তো স্রেফ উড়ে যাবে। স্তুপ হয়ে থাকবে না।’
বিপুল ময়লা উৎপন্ন হবে বলে পৃথিবীর কাছের কোনো গ্রহাণুতে এ আঘাত করতে চান না বিজ্ঞানীরা।
ডার্ট পদ্ধতির মাধ্যমে বিপজ্জনক গ্রহাণুর গতিপথ বদলে দেয়া পৃথিবীকে রক্ষার সেরা উপায় বলে মনে করেন অধ্যাপক আয়ারল্যান্ড। সময় বা পৃথিবী থেকে গ্রহাণুর দূরত্ব কম না হলে গ্রহাণুর ওপর পাল লাগিয়ে দিয়েও সেটিকে কক্ষপথ থেকে বিচ্যুত করা সম্ভব।
অধ্যাপক আয়ারল্যান্ডের মতে, ‘গ্রহাণুর সঙ্গে ঠিকঠাকভাবে একটি প্যারাশুট যুক্ত করে দেয়া গেলে সেটি সৌর বাতাস ব্যবহার করে গ্রহাণুকে ঠেলতে পারবে। কিন্তু ভারী কিছুর ধাক্কা দিয়ে সরানো বাদে বাকি পদ্ধতিগুলোতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অনেক সময়ের প্রয়োজন।’
সম্ভাব্য বিপজ্জনক মহাজাগতিক বস্তুর আঘাত থেকে মানবজাতিকে রক্ষার দুটি উপায় রয়েছে। এর মধ্যে একটি হলো কৃত্রিমভাবে মহাজাগতিক বস্তুটিকে এর কক্ষপথ থেকে বিচ্যুত করা; দ্বিতীয় উপায় হলো গ্রহাণুর ওপর পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটানো।
মাঝেমধ্যেই বিশাল আকারের সব পাথরখণ্ড পৃথিবীর গা ঘেঁষে চলে যায়৷ ২০১৮ সালের এপ্রিলে ২০১৮জিইথ্রি নামের ৫০ মিটার ব্যাসের একটি গ্রহাণু বিপজ্জনকভাবে পৃথিবীর কাছে চলে আসে৷ মাত্র ২১ ঘণ্টা আগে জ্যোতির্বিদরা এটির উপস্থিতি টের পান৷
এরও পাঁচ বছর আগে ২০ মিটার দৈর্ঘ্যের একটি উল্কা রাশিয়ার চেলিয়াবিনস্কে আঘাত হানে৷ আকারের তুলনায় বিপর্যয় কম মাত্রারই হয়েছিল৷ কয়েক হাজার বাড়িঘর এর প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, প্রায় এক হাজার মানুষ আহত হয়েছিলেন৷ তবে ভাগ্যক্রমে এর আঘাতে কেউ প্রাণ হারাননি৷
মহাকাশ গবেষকরা অবশ্য সবচেয়ে প্রাণঘাতী বস্তুগুলোর অবস্থান নিশ্চিত করার বিষয়ে বেশ আত্মবিশ্বাসী৷ এই গ্রহাণুগুলো কয়েক কিলোমিটার ব্যাসেরও হতে পারে৷ তবে আগামী ১০০ বছরের মধ্যে এত বড় কোনো গ্রহাণু পৃথিবীতে আঘাত করবে না বলে মোটামুটি নিশ্চয়তা দিচ্ছেন গবেষকরা৷
নাসার গ্রহবিষয়ক প্রতিরক্ষা সমন্বয় কার্যালয়ের ব্যবস্থাপক ও গ্রহবিষয়ক প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ কেলি ফাস্টের মতে, নিশ্চিতভাবেই পৃথিবীতে আবারও কোনো গ্রহাণু আঘাত করবে।
নাসার ওয়েবসাইটে তার উদ্ধৃতি দিয়ে লেখা আছে, ‘পৃথিবীতে ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন গ্রহাণুর আঘাত করার ইতিহাস আছে। এটা আবারও ঘটবে। ময়লার স্তুপ, উল্কাখণ্ড, এমনকি ছোট ছোট গ্রহাণু তো সারাক্ষণই পৃথিবীকে আঘাত করছে। তবে ভূপৃষ্ঠে গ্রহাণুর আঘাতের ছাপ বিরল ঘটনা এবং কয়েক শ থেকে হাজার, এমনকি শতকোটি বছরের বিরতিতে একবার এ ধরনের ঘটনা ঘটে।
পৃথিবীর জন্য বিপজ্জনক বিবেচিত একটি গ্রহাণু হলো বেনু। মহাজাগতিক এই পাথুরে খণ্ডটির ব্যাস ৪৯২ মিটার। তবে ১০০ বছরের মধ্যে বেনু পৃথিবীতে আঘাত হানছে না।
এরপর এটি ভূপৃষ্ঠে আঘাত হানলে সৃষ্ট গর্তটি হবে বেনুর আয়তনের চেয়ে ১০ থেকে ২০ গুণ পর্যন্ত বড়। আর এর ধ্বংসযজ্ঞ হবে গর্তের আয়তনের চেয়েও ১০০ গুণ বেশি।
অধ্যাপক আয়ারল্যান্ড বলেন, মানবজাতিকে ধ্বংস করে দেয়ার মতো গ্রহাণুর আঘাত বিরল। গ্রহাণুর ব্যাস কমপক্ষে এক কিলোমিটার না হলে এ ধরনের আঘাত সম্ভব নয়।
এমনিতেই করোনা মহামারির ধাক্কায় টালমাটাল গোটা পৃথিবী। এর মধ্যে বিশাল আকারের গ্রহাণু পৃথিবীর কাছাকাছি আসার খবরে অনেকেই ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছেন। পৃথিবীর কাছ দিয়ে সব সময়ে বিভিন্ন আকারের গ্রহাণু অতিক্রম করে। তবে নাসার পক্ষ থেকে সব গ্রহাণু নিয়ে বিবৃতি দেওয়া হয় না। তবে সম্প্রতি নাসা জানিয়েছে, নভেম্বরের মধ্যে বিশাল সাতটি গ্রহাণু উড়ে যাবে পৃথিবীর আশপাশ দিয়ে। এগুলোর কোনো কেনোটি আকারে গিজার পিরামিডের চেয়েও বড় হবে।
এরমধ্যে সবচেয়ে কাছ দিয়ে যে পাথরখণ্ডটি উড়ে যাবে তার নাম রাখা হয়েছে ১৯৯৬ ভিবিথ্রি। ২০ অক্টোবর পৃথিবী থেকে এর দূরত্ব থাকবে ২১ লাখ মাইলের মতো। এর ব্যাস প্রায় ৭৫৪ ফুট।
মহাকাশ বিজ্ঞানীদের মতে, ৪৬০ ফুট বা এর চেয়ে বড় দুই-তৃতীয়াংশ গ্রহাণু আবিষ্কার করা যায়নি। এসব গ্রহাণু পৃথিবীর দিকে ধেয়ে এসে আঘাত করলে যথেষ্ট ক্ষতি হতে পারে। তাই মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসাসহ অন্যান্যরা এমন পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাদের গবেষণার লক্ষ্য হলো পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসা গ্রহাণু ঠেকানো। এ লক্ষ্যেই সম্প্রতি একটি মহড়ার আয়োজন করে নাসা। এতে বিজ্ঞানীদের সাড়ে তিন কোটি মাইল দূর থেকে একটি গ্রহাণুর পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসা ঠেকাতে দেওয়া হয়েছিল।
গ্রহাণু এবং পৃথিবীর কক্ষপথে ভেসে বেড়ানো আবর্জনা শুধু পৃথিবী নয় বরং অন্যান্য সব জ্যোতিষ্কের জন্যেও হুমকিস্বরূপ। আর মহাশূন্যে মনুষ্যসৃষ্ট আবর্জনার পরিমাণ যতই বাড়ছে ততই এই হুমকি বেড়ে চলছে। কিন্তু প্রযুক্তির কল্যাণে মানুষ এখন যেভাবে আবর্জনা থেকেই তৈরি করছে শক্তি, তেমনভাবে এই মহাকাশের আবর্জনাকেও রিসাইক্লিং করা যেতে পারে বলে মনে করেন কিছু বিজ্ঞানী। এমনকি এসব গ্রহানুতে খনি তৈরি করে তা থেকে মুল্যবান ধাতু আহরণও করা যেতে পারে। কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন এই ক্ষেত্রে আরও বিশদ গবেষণা এবং প্রযুক্তি তৈরি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭১৯
আপনার মতামত জানানঃ