ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের মামলায় অপেক্ষা করতে হয় বছরের পর বছর। আর নির্যাতিতাকে শিকার হতে হয় পদে পদে হয়রানি আর অবমাননার। যৌন নিপীড়নের ঘটনা আদালতে পরিচালনাকারী আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মীদের অভিজ্ঞতা এমনই।
তারা বলছেন, ধর্ষণ মামলায় মাত্র ৩ থেকে ৪ শতাংশের শেষ পর্যন্ত সাজা হয়। যদিও নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০-এর ধারা ২০(৩)-এ বলা আছে, বিচারের জন্য মামলা প্রাপ্তির তারিখ থেকে ১৮০ দিনের মধ্যে ট্রাইব্যুনাল কার্য শেষ করতে হবে। এমন যখন পরিস্থিতি তখন প্রশ্ন উঠছে এদেশে কতটা নিরাপদ নারী ও শিশুরা?
সাক্ষীর অনীহা
২০১৯ সালে শুধুমাত্র গণমাধ্যমে ধর্ষণের ঘটনা এসেছে এক হাজারের উপর। কিন্তু দ্রুত বিচার বা রায়ের সংখ্যা মাত্র দু থেকে তিনটি। অথচ, আইন অনুযায়ী ১৮০ দিনের মধ্যে এসব মামলা শেষ করার কথা থাকলেও তা গড়ায় বছরের পর বছর, কখনো দশক।
দেশে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের মামলা যে হারে বাড়ছে, সে অনুযায়ী নিষ্পত্তির হার একেবারেই কম। যার ফলে বিচার না পেয়ে উল্টো হয়রানির শিকার হচ্ছে ভুক্তভোগী পরিবার।
মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, আইনের ত্রুটি, ফরেনসিক পরীক্ষার সীমাবদ্ধতা, প্রভাবশালীদের চাপ, সাক্ষী না পাওয়া, অর্থের দাপট এবং সামাজিক কারণে বিচারের এই ধীরগতি।
মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান আমরাই পারি পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ জোট (উই ক্যান) বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাসে ধর্ষণের ঘটনায় ৩৪৭টি মামলা হয়েছে। তবে এসব মামলার বিচার শুরু হয়েছে মাত্র ৭টির; অর্থাৎ মাত্র ২ শতাংশ। বিচার শুরু হয়নি ৯৮ শতাংশ মামলার।
মামলার বিচারিক কার্যক্রম সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ধর্ষণের মামলায় আদালতে অভিযোগ প্রমাণের ক্ষেত্রে সাক্ষ্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ধর্ষণের মামলায় বেশির ভাগ অভিযুক্ত খালাস পেয়ে যাওয়ার মূল কারণ সাক্ষীর অভাব।
মামলার অভিযোগপত্র দেওয়ার পরপরই সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। প্রথম সাক্ষ্য নেওয়া হয় ভুক্তভোগীর। তারপর যিনি মেডিকেল করেছেন, সেই ডাক্তার। জবানবন্দি নেওয়া ম্যাজিস্ট্রেট, সংশ্লিষ্ট সরকারি অন্য কর্মকর্তা। সাক্ষ্য নেওয়া হয় ভুক্তভোগীর পরিবার বা যারা ঘটনার বিষয়ে জানেন। কিন্তু দু-একবার আদালতে আসার পর কোনো সাক্ষীই আর আসতে চান না।
আদালত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাক্ষীর গাফিলতির কারণেই মামলার কার্যক্রম আর এগোনো যায় না। কেননা, এ কাজে তাদের কোনো জবাবদিহি থাকে না। তবে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বলেন, মামলা নিষ্পত্তি করার প্রধান বাধা সাক্ষী হলেও তদন্ত সংস্থাও কম যায় না। দুর্বল তদন্তে ভরা থাকে প্রতিটি মামলা।
তদন্ত প্রক্রিয়া
ধর্ষণ মামলার তদন্ত নিয়েও অভিযোগের শেষ নেই। নারী অধিকার নিয়ে আন্দোলনকারীরা বলেছেন, বিচারের জন্য আলাদা ট্রাইবুনাল থাকলেও তদন্তের ব্যাপারে বিশেষায়িত কোন ব্যবস্থা নেই। পুলিশ অন্য অনেক মামলার সাথে ধর্ষণ বা নারী নির্যাতনের মামলা তদন্ত করে থাকে এবং সেজন্য লম্বা সময় লেগে যায়।
চাজশিট দেয়ার পর সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। এর মধ্যে সরকারি কর্মকর্তা যারা সাক্ষী হন, দিনের পর দিন তারাও আসতে গাফিলতি করেন। এখানে কোন জবাবদিহিতা নাই। গাফিলতির কারণে শুধু দেরি হয়, তা নয়, প্রসিকিউশনের গাফিলতির কারণে মামলার সবল দিকগুলো আদালতে ঠিকমত তুলে ধরা সম্ভব হয় না।
মানবাধিকার কর্মীদের অভিযোগ, পুলিশী তদন্তে দিনের পর দিন সময় চলে যায়। অবশেষে তদন্ত শেষ হলে কোন মামলার বিচার প্রক্রিয়া শুরু হলেও তখন সরকার পক্ষের সাক্ষী হাজির করা নিয়ে চলে টালবাহানা।
কোন ক্ষেত্রেই কোন জবাবদিহিতা নাই। ফলে ধর্ষণের শিকার একজন নারী এবং তার পরিবারকে দীর্ঘসূত্রিতার ভোগান্তিতে পড়তে হয়।
ডিএনএ টেস্ট
এখন ধর্ষণ আইনে মৃত্যুদণ্ডের বিধান আনার পাশাপাশি আরেকটি বড় পরিবর্তন করা হয়েছে। বাধ্যতামূলক করা হয়েছে ধর্ষণের শিকার নারী এবং অভিযুক্তের ডিএনএ পরীক্ষা।
অনেকের মতেই এই ডিএনএ পরীক্ষার বিষয়টি দ্রুত বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে আরেকটি অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিষয়টি হওয়া উচিত এমন যে, একজন বিচারক যদি মনে করেন যে, এই সুনির্দিষ্ট মামলাটির ক্ষেত্রে ডিএনএ টেস্টের প্রয়োজন রয়েছে। তখন একজন বিচারক চাইলে ডিএনএ টেস্টের জন্য বলতে পারেন।
কিন্তু যদি সব মামলাতেই ডিএনএ টেস্ট করা লাগে, সেটা আসলে কতটুকু যৌক্তিক? কারণ যেসব মামলায় ডিএনএ টেস্টের প্রয়োজন নাই, সেখানে ডিফেন্স থেকে স্বাভাবিকভাবেই সুযোগ নিতে পারে। যতক্ষণ না ডিএনএ টেস্ট করানো হচ্ছে, ততক্ষণ মামলার বিচার সহজে পেছানো যাবে।
আরেকটা বিষয় হচ্ছে, ডিএনএ পরীক্ষা কেন্দ্রগুলো আসলে কতটা রিসোর্সফুল। ঢাকার যে কোন একটা ট্রাইবুনালে অন্তত সাড়ে তিন থেকে চার হাজার মামলা ঝুলে আছে। এর মধ্যে যদি অন্তত দুই হাজার মামলাও ডিএনএ টেস্টের জন্য যায়, ল্যাবগুলোর সেই সক্ষমতা আছে কিনা সেটাও বিবেচনা করার বিষয়।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ঢাকায় নারী ও শিশু নির্যাতন মামলার বিচারকাজ পরিচালনার জন্য ট্রাইব্যুনাল ঢাকা-১, ২, ৩, ৪ ও ৫ কাজ করেন। যেখানে নারী ও শিশু ট্রাইব্যুনাল ঢাকা-১-এ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ২০১৭ সালে ৬ হাজার ২২৭টি মামলা আসে। চার বছর পর এখনো ওই মামলার ২ হাজার ৯০২টির বিচার চলমান রয়েছে।
ঢাকা-২-এ ২০১৭ সালে মোট মামলা আসে ৫ হাজার ২৭২টি, এখনো বিচারাধীন ৯৪৭টি মামলা। একইভাবে ঢাকা-৩-এ একই বছর মামলা আসে ৫ হাজার ৯৩২টি, এখনো বিচারাধীন ১ হাজার ১০৪টি। ঢাকা-৪-এ মামলা আসে ৬ হাজার ৮২৯টি, বিচারাধীন ৩ হাজার ৭২৩টি। ঢাকা-৫-এ মামলা আসে ৬ হাজার ১০১টি, বিচারাধীন ২ হাজার ৩৯৪টি মামলা।
কেন এই মামলাগুলো বছরের পর বছর ঝুলছে— এই প্রশ্নের উত্তরে সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল ফারহানা আফরোজ বলেন, তদন্ত হতে দেরি হওয়া, ভুল প্রতিবেদন দেওয়া, মেডিকেল প্রতিবেদনে অতিরিক্ত সময় লাগা, ঘটনাস্থলের দূরত্ব, আসামি পালিয়ে যাওয়া, পুলিশ সদস্যদের বদলি, নির্যাতনের শিকার মেয়েটির পরিবারের সদস্যদের আর্থসামাজিক অবস্থান প্রভৃতি কারণে নারী ও শিশু নির্যাতন মামলার নিষ্পত্তি হতে দেরি হয়।
বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের পরিচালক সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ গোলাম কিবরিয়া বলছেন, নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলা ১৮০ দিনের মধ্যে সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। কেননা, ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা অনুযায়ী মামলার চাপ অনেক বেশি।
সূত্র মতে, একটি ট্রাইব্যুনালে দেড় থেকে দুই হাজার মামলা থাকে। আবার মামলার চার্জশিট অনুযায়ী সাক্ষী পাওয়া যায় না। থাকলেও তাদের সময়মতো হাজির করা সম্ভব হয় না। ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা বাড়ানো, তদন্ত নির্ভুল ও দ্রুতগতিতে করা গেলে এবং সাক্ষীদের আদালতে আনা নিশ্চিত করতে পারলে এই জট কিছুটা কমতে পারে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৬২০
আপনার মতামত জানানঃ