সাধারণত ধর্ষণের আলামতের ফরেন্সিক টেস্টের সুবিধার জন্য ৭২ ঘণ্টার মধ্যে মামলা করার পরামর্শ আইনজীবীরা দিয়ে থাকেন। ধর্ষণের ঘটনা ঘটলে দ্রুত মামলা করা ভালো। তবে পুলিশকে ৭২ ঘণ্টার পরে কোনো মামলা না নেওয়ার কথা বলা কোনো বিচারকের এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে কি না সেই প্রশ্ন আজ দেশ জুড়ে। একই সাথে প্রশ্ন উঠেছে, ৭২ ঘণ্টা পার হলে কি ধর্ষণ ন্যায্যতা পেয়ে যাবে? ধর্ষক বেকসুর হয়ে যাবে?
প্রসঙ্গত, গত বৃহস্পতিবার বনানীর রেইনট্রি হোটেলে শিক্ষার্থী ধর্ষণের ঘটনায় দায়ের করা মামলায় সাফাত আহমেদসহ পাঁচজনকে খালাস দিয়েছেন আদালত। ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭ এর বিচারক বেগম কামরুন্নাহারের আদালত এ রায় ঘোষণা করেন। পাশাপাশি তিনি এমন বিতর্ক মন্তব্যও করেন।
কী বলেছেন ওই বিচারক?
রায়ের পর্যবেক্ষণে পুলিশের জন্য বিশেষ বার্তা দেন বিচারক বেগম কামরুন্নাহার। পর্যবেক্ষণে তিনি বলেন, ধর্ষণের ৭২ ঘণ্টার বেশি সময় পেরিয়ে গেলে পুলিশ যেন মামলা না নেয়।
তিনি বলেন, এই মামলাটি ৯৩ দিন ট্রায়ালে সময় নিয়েছে। এই সময়ে অন্যান্য অনেক মামলার বিচার করা সম্ভব হতো। এই মামলায় দুইজন ভিকটিম, তারা স্বেচ্ছায় হোটেলে গিয়েছেন। সেখানে গিয়ে সুইমিং করেছেন।
তিনি আরও বলেন, ঘটনার ৩৮ দিন পর তারা বললেন ‘আমরা ধর্ষণের শিকার হয়েছি’। এই মামলাটি একটি অহেতুক মামলা। এই অহেতুক মামলায় রাষ্ট্রের অনেক সময় অপচয় হয়েছে।
পর্যবেক্ষণে তিনি আরও বলেন, মূলত আসামি সাফাতের সাবেক স্ত্রী পিয়াসা এই মামলাটি করতে সহায়তা করেন ভিকটিমকে। পুলিশ অহেতুক মামলাটি গ্রহণ করেছে। পরবর্তীতে ট্রায়ালে পাঠিয়ে বিচার বিভাগের অযথা সময় নষ্ট করেছে।
উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের ২৮ মার্চ রাতে রাজধানীর বনানীর রেইনট্রি হোটেলে ডেকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া দুই তরুণীকে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা হয়। এ মামলায় ওই বছরের ৮ জুন পাঁচজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। পরের মাস অর্থাৎ ২০১৭ সালের ১৩ জুলাই পাঁচজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে ৪৭ জন সাক্ষীর মধ্যে ২২ জনকে আদালতে হাজির করা হয়।
বাদীপক্ষের আইনজীবী ইতিমধ্যে বলেছেন, তারা এই রায়ে অসন্তুষ্ট ও উচ্চ আদালতে আপিল করবেন। কিন্তু রায় প্রদানকালে বিচারক যেসব মন্তব্য করেছেন, তা অবান্তর। এই মন্তব্যে ফৌজদারি অপরাধের বিষয়ে তার জ্ঞানের সীমাবদ্ধতাই প্রকাশ পেয়েছে। কোনো বিচারক পুলিশকে বলতে পারেন না তারা কত দিন পর মামলা নেবেন বা নেবেন না। কারণ, ফৌজদারি অপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে সময় বেঁধে দেওয়া নেই। ফৌজদারি অপরাধ কখনো তামাদি হয় না।
এছাড়া বিচারক ভুক্তভোগীদের সম্পর্কে ‘সেক্সুয়ালি হ্যাবিচুয়েটেড’ বলে মন্তব্য করেন; যা অত্যন্ত আপত্তিকর। এ কথা চিকিৎসক তার মেডিকেল রিপোর্টে কেবল লিখতে পারেন; বিচারক কখনো এ ধরনের কথা বলতে পারেন না। কে সেক্সুয়ালি হ্যাবিচুয়েটেড, সে সম্পর্কে বিচারক মন্তব্য করতে পারেন না। বিচারকের আসন থেকে এমন মন্তব্য সমীচীন নয়, যাতে বিচারব্যবস্থার প্রতি জনগণের অনাস্থা প্রকাশ পায়।
বিচারিক ক্ষমতা প্রতাহার
ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭ এর বিচারক বেগম কামরুন্নাহারকে আজ সকাল সাড়ে ৯টা থেকে আদালতে না বসার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। রোববার (১৪ নভেম্বর) সকালে সুপ্রিম কোর্টের স্পেশাল অফিসার স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, প্রধান বিচারপতি ও সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ বিচারপতিরা আলোচনাক্রমে ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭ এর বিচারক বেগম মোছা. কামরুন্নাহারকে রোববার সকাল সাড়ে ৯টা থেকে হতে আদালতে না বসার নির্দেশ দিয়েছেন।
তার ফৌজদারি বিচারিক ক্ষমতা সাময়িকভাবে প্রত্যাহার করে তাকে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগে সংযুক্ত করার জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে।
গত ১১ নভেম্বর রাজধানীর বনানীর রেইনট্রি হোটেলে দুই শিক্ষার্থী ধর্ষণের অভিযোগে দায়ের করা মামলার রায় ঘোষণার পর গতকাল শনিবার আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানিয়েছিলেন, রেইনট্রি হোটেলে দুই শিক্ষার্থী ধর্ষণের অভিযোগে দায়ের করা মামলার বিচারকের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে প্রধান বিচারপতিকে চিঠি দেওয়া হবে।
আইনমন্ত্রী আরও বলেছেন, অবজারভেশনে তিনি (আইনজীবী) যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা সম্পূর্ণ বেআইনি ও অসাংবিধানিক। বিচারক হিসেবে তার দায়িত্ব পালন নিয়ে যেন ব্যবস্থা নেওয়া হয়, সেজন্য প্রধান বিচারপতিকে একটি চিঠি লিখছি।
ক্ষুব্ধ গোটা দেশ
বনানীর রেইনট্রি হোটেলে দুই শিক্ষার্থী ধর্ষণ মামলায় পাঁচ আসামিকে খালাস দেন ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭-এর বিচারক মোছা. কামরুন্নাহার। প্রধান দুই আসামির খালাসের রায় শোনার পর, বলা বাহুল্য, এই দুই ভুক্তভোগী তরুণী চরমভাবে হতাশ হয়েছেন। তারা কান্নায় ভেঙে পড়েন। তাদের পক্ষের আইনজীবী এই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আবেদন করবেন। কারণ এই রায় মেনে নেওয়া যায় না। এবং আমরা আশা করব উচ্চ আদালত বিষয়টি গুরুত্বের সাথেই বিবেচনা করবেন। ভুক্তভোগীরা ন্যায়বিচার পাবেন।
শুধু ভুক্তভোগী দুজন তরুণী নয়, হতাশ হয়েছেন সারাদেশের নারীসমাজও। হতাশ হয়েছেন নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সারাদেশের বিবেকবান মানুষ; তারা ক্ষুব্ধ হয়েছেন আরও বেশি এই কারণে যে, রায়ে একইসঙ্গে ধর্ষণের ঘটনার ৭২ ঘণ্টা অতিক্রান্ত হওয়ার পর পুলিশ যেন মামলা গ্রহণ না করে, সে ব্যাপারে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
নারী অধিকার কর্মী ফরিদা আখতার বলেন, ধর্ষণ এমন এক নির্যাতন, যাকে স্রেফ শারীরিক নির্যাতন হিসাবে বিবেচনা করা যায় না। এর সঙ্গে নারীর নিজের চোখে নিজের মানবিক সত্তার উপস্থিতি এবং অপরদিকে সেই সত্তার সামাজিক স্বীকৃতি বা অস্বীকৃতির প্রশ্ন জড়িত। নিজের কাছে তার আপন সত্তার অবমাননা তীব্র হয়ে হাজির হয়।
তিনি বলেন, ধর্ষণের শিকার নারীকে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ একটি বিশেষ খোপে পুরে দেয় এবং পুরুষতান্ত্রিক সমাজ তাকে আরও কঠোরভাবে বুঝিয়ে দেয় সে কতটা অধঃপতিত হয়েছে। এইসব সহ্য করা সব নারীর পক্ষে সম্ভব হয় না। তাই অনেক নারী আত্মহননের পথ বেছে নেয়। কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক সংস্কৃতি যেভাবে বোঝায়, এই সত্তাহানি মোটেও নারীর ইজ্জত বা আত্মসম্মানহানির ব্যাপার নয়। আমাদেরকে এই মনোভাব থেকে বের হতে হবে এবং একইসাথে ধর্ষকের বিচার চাইতে হবে।
তিনি আরও বলেন, আমাদের দেশ এখন ধনী-গরিব দুভাগে ভাগ হয়েছে। মাত্র ৫ শতাংশ ধনী ২৫ শতাংশ সম্পদের মালিক হয়ে ৯৫ শতাংশ মানুষের ওপর নানাভাবে নির্যাতন চালাচ্ছে। তাদের হাত থেকে নিস্তার পাচ্ছে না গরিব ও নিম্নবিত্ত নারীরা। তাই তারা ধর্ষণ করলেও খালাস পেয়ে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, ভবিষ্যতেও তাদের রক্ষার জন্যে বিশেষ নির্দেশনা আসবে। সমাজের অন্যায়-অবিচার এখন নগ্নভাবে প্রকাশিত হতে শুরু করেছে।
ধর্ষণের দেশ বাংলাদেশ
বাংলাদেশের পুলিশ মহাপরিদর্শকের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১৬ থেকে ২০২০ সালের অক্টোবর মাস পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশের থানাগুলোয় ২৬ হাজার ৬৯৫টি ধর্ষণের মামলা করা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে ২০১৯ সালে।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালে ধর্ষণের মামলা হয়েছে ৪,৩৩১টি। ২০১৭ সালে মামলা হয়েছে ৪,৬৮৩টি। ২০১৮ সালে ৪,৬৯৫টি।
২০১৯ সালে মামলা হয়েছে ৬ হাজার ৭৬৬টি এবং ২০২০ সালের অক্টোবর পর্যন্ত মামলা হয়েছে ৬ হাজার ২২০টি।
এগুলো শুধুমাত্র থানায় দায়ের হওয়া মামলা। এর বাইরে ট্রাইব্যুনালেও মামলা দায়ের হয়, কিন্তু সেখান থেকে এখনো প্রতিবেদন আসেনি।
এই বছরের জানুয়ারি মাসে ১০৮ জন নারী ধর্ষণের শিকারসহ ২৫৯ নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ। এর আগে ২০২০ সালে দেশে এক হাজার ৩৪৬ জন নারী ও কন্যা শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ জানিয়েছে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৫৩০
আপনার মতামত জানানঃ