একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে পাকিস্তানের অবস্থান সবসময়ই বিতর্কিত। বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যা দেশটি চিরকালই চাপা দিয়ে এসেছে। পাকিস্তানের পাঠ্যপুস্তকেও এড়িয়ে যাওয়া হয় তাদের নৃশংসতার অধ্যায়টিকে। তরুণ প্রজন্মকে সবসময় রাখা হয়েছে অন্ধকারে।
তবে এবার দেশটির মুক্তির অপেক্ষায় থাকা একটি সিনেমা বদলে দিতে চলেছে পাকিস্তানের সেই অবস্থানকে। ইতোমধ্যে সিনেমাটির ট্রেলার প্রকাশ হয়েছে। প্রকাশিত ট্রেলারে দেখে ধারণা করা হচ্ছে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাই এ ছবির মূল উপজীব্য। আর এতে একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতার দিকটি তুলে ধরা হয়েছে, যা দেখে মনে করা হয়, চলচ্চিত্রটি পাকিস্তানের সরকারি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অনেকটাই সরে আসতে পেরেছে।
‘খেল খেল মে’ নামের এই সিনেমাটি আগামী ১৯ নভেম্বর মুক্তি পাবে। পাকিস্তানে করোনা মহামারির পর প্রেক্ষাগৃহে মুক্তিপ্রাপ্ত প্রথম সিনেমা হতে চলেছে এটি। সম্প্রতি এর ট্রেইলার প্রকাশ পেয়েছে। এরপরই মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টি দর্শকদের নজরে আসে।
ট্রেইলারটির শুরুতেই উল্লেখ রয়েছে সিনেমাটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত। এতে ৫০ বছর ধরে চলে আসা অবিশ্বাস, স্মৃতি ও মিথের রহস্য উন্মোচন করা হবে। সিনেমার দৃশ্যে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থান দেখানো হয়েছে। এছাড়া একটি দৃশ্যে কপালে বাংলাদেশের পতাকা বেঁধে রাইফেল হাতে একজনকে যুদ্ধও করতে দেখা গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, বর্তমানের প্রজন্মের কাছে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা তুলে ধরতে চেয়েছেন নির্মাতা।
যদিও ট্রেইলার প্রকাশের পর বাংলাদেশি নেটিজেনদের মধ্যে এ নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। এই সিনেমায় প্রকৃত ঘটনা কতটুকু নিখুঁতভাবে তুলে ধরা হবে তা নিয়েও অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।
এ ছাড়া জানা গেছে, বাংলাদেশের দৃশ্য দেখানো হলেও এই সিনেমার জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগের কাছে কোনো অনুমতি নেওয়া হয়নি। প্রকৃত সত্য তুলে ধরার কথা বলা হলেও নির্মাতাদের এমন লুকোচুরিতে অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করছেন— হয়তো সিনেমায় নিজেদের মতো করেই মহান মুক্তিযুদ্ধে উপস্থাপন করতে চলেছেন নির্মাতা।
সিনেমাটির ট্রেলারে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অডিটরিয়াম’ লেখা দেখা গেছে। এ ছাড়া বাংলাদেশের পতাকা মাথায় বাঁধা মুক্তিযোদ্ধা, ঢাকার সদরঘাট, ঢাকা লেখা শব্দটি দেখা গেছে। ট্রেলারের শুরুতেই একটি কণ্ঠে শোনা গেছে, ‘আমরা কখনোই ভাবিনি যে একটি স্ফুলিঙ্গ পুরো বনকে পুড়িয়ে ফেলবে।’ ট্রেলারে আরও লেখা হয়েছে, ‘৫০ বছরের অবিশ্বাসের স্মৃতি ও মিথ।’
আর ট্রেলারের শেষে একজন তরুণ নারী কণ্ঠে শোনা যায়, ‘আমরা কেন প্রশ্ন করছি না? একটা মিথ্যা অভিযোগ কেন বয়ে বেড়াচ্ছি আমরা? কেন প্রশ্ন করছি না যে কী হয়েছিল? নাকি আমরাও সেই মিথ্যার অংশীদার হয়ে গেছি, যেটা ষড়যন্ত্রকারীরা চেয়েছিল?’ এমন সব সংলাপ থেকে ধারণা করা যায়, হয়তো সিনেমায় মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশকে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখা হয়েছে সিনেমায়।
ট্রেলারে এটা স্পষ্ট যে দুটি ভিন্ন সময় ও প্রজন্মের গল্প বলা হয়েছে সিনেমায়। একটিতে দেখানো হয়েছে যুদ্ধের বর্বরতা, অপরটিতে মিথ্যা তথ্যের নিচে চাপা পড়া ইতিহাসের ওই অধ্যায়টি খুঁড়ে তুলে আনা একদল তরুণের গল্প। ওই তরুণদের সঙ্গেই যুক্ত করা হয়েছে পুরোনো সময়কে। যাদের মাধ্যমে হয়তো উঠে আসবে নতুন কোনো বার্তা।
নাবিল কুরেশির পরিচালনায় সিনেমার প্রধান দুই চরিত্রে অভিনয় করেছেন অভিনেত্রী সজল আলি ও অভিনেতা বিলাল আব্বাস খান। দুজন শিল্পীই এখন তুমুল জনপ্রিয় পাকিস্তানে।
‘খেল খেল মে’ সিনেমার অন্যতম মিডিয়া পার্টনার এআরওয়াই নিউজ। সিনেমার নির্মাতা নাবিল কুরেশি সংবাদমাধ্যমটিকে বলেছেন, ‘ক্ষমতার বিপরীতে ভালোবাসা কীভাবে বিরাজ করে এবং কীভাবে দেশের সৃজনশীল তরুণ-তরুণীদের মানসিকতায় পরিবর্তন আনতে পারে, তা দেখানো হবে সিনেমাটিতে।’
বিনোদন ও এর মূল্যায়ন নিয়ে পাকিস্তানের জনপ্রিয় ওয়েবসাইট রিভিউউইট ডট পিকে-তে সিনেমাটি নিয়ে লেখা প্রকাশ হয়েছে। সেখানে ট্রেলারটি নিয়ে দর্শকেরা প্রশংসিত মন্তব্য করেছেন। ভালো কিছুর প্রত্যাশা করেছেন। একজন দর্শক লিখেছেন, ‘সিনেমাটি বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের ভাগ হয়ে যাওয়ার গল্প নিয়ে নির্মিত। কী ঘটেছিল সে সময়। অপেক্ষা করছি দেখার জন্য।’
ধারণা করা হচ্ছে, গত ৫০ বছর ধরে ইতিহাস বিকৃতির যে চর্চা পাকিস্তান করে এসেছে, দেশটির সরকার সম্প্রতি নিজেদের এই অবস্থানে কিছুটা নমনীয়তা প্রদর্শন করছেন। দেশটির তরুণরা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অন্ধকারেই আছে সেই শুরু থেকে। তবে ইতিহাসকে চেপে রাখা যায় না। আর তাই দুই দেশের মানুষই আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে ‘খেল খেল মে’ সিনেমাটির জন্য।
এসডব্লিউ/এসএস/১৪০৬
আপনার মতামত জানানঃ