চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসেই দক্ষিণ আমেরিকার কলোম্বিয়ায় আমাজন বনে ৪২ হাজার হেক্টর (এক লাখ পাঁচ হাজার দুই শ’ ৬৭ একর) বনভূমি ধ্বংস করা হয়েছে। কলোম্বিয়ায় বনভূমি সংরক্ষণে কঠিন আইন ও বনভূমি ধ্বংসে ১৫ বছরের কারাদণ্ডের বিধান থাকলেও অব্যাহতভাবে বিপুল বনভূমি ধ্বংস হচ্ছে। সম্প্রতি কলাম্বিয়ার পরিবেশমন্ত্রী কার্লোস এডওয়ার্ডো কোরেয়া এক বিবৃতিতে এই তথ্য জানান।
কলাম্বিয়ার কাকেটা, মেটা ও গাভিয়ারে প্রদেশের ধ্বংস করা এই বনভূমি গত বছরের একই সময় পর্যন্ত ধ্বংস বনভূমির পরিমাণ থেকে ৩৪ ভাগ কম জানায় মন্ত্রণালয়। ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত এই তিন প্রদেশে আমাজনের মোট ৬৪ হাজার পাঁচ শ’ হেক্টর (এক লাখ ৫৯ হাজার তিন শ’ ৮৩ একর) বনভূমি ধ্বংস হয়।
বিবৃতিতে পরিবেশমন্ত্রী বলেন, ‘কলাম্বিয়ার বনভূমি সংরক্ষণ আমাদের অগ্রাধিকারের বিষয়। এই বিপর্যয় (বনভূমি ধ্বংস) বন্ধ করার জন্য আমরা সবধরণের ব্যবস্থা নিচ্ছি।’
বনভূমি সংরক্ষণে কলাম্বিয়ায় নির্ধারিত আইন ও ব্যবস্থাপনার সাথে সাথে বনভূমি ধ্বংসে ১৫ বছরের কারাদণ্ডের বিধান থাকলেও দেশটিতে অব্যাহতভাবে বিপুল বনভূমি ধ্বংস হচ্ছে।
২০২০ সালে পৃথিবীর বনভূমি ধ্বংসের ৬৪ ভাগ কলাম্বিয়াসহ আমাজন বনভূমি অঞ্চল থাকা দেশগুলোতে সংগঠিত হয়।
দক্ষিণ আমেরিকার ছোট–বড় নয়টি দেশকে ঘিরে রয়েছে আমাজন অরণ্যের বিস্তার। এই দেশগুলো হলো ভেনেজুয়েলা, ব্রাজিল, পেরু, বলিভিয়া, কলাম্বিয়া, ইকুয়েডর, গায়ানা, সুরিনাম আর ফ্রান্স (ফ্রান্স গায়ানা)।
বিশ্বের ১২টি রেইনফরেস্টের মধ্যে আমাজন বেসিনের রেইনফরেস্ট বৃহত্তম। প্রকৃতপক্ষে এর আয়তন ছিল ২ দশমিক ১২৪ মিলিয়ন বর্গমাইল। দক্ষিণ আমেরিকার আয়তন ৬ দশমিক ৮৯০ মিলিয়ন বর্গমাইল।
পাঁচ দশক ধরে মানুষ এই অরণ্যকে সংকুচিত করে চলেছে অপরিণামদর্শিতার সঙ্গে। ৫৫ থেকে ৪০ মিলিয়ন বছর আগেও আমাজন অরণ্যের অস্তিত্ব ছিল বলে ভূতত্ত্ববিদদের অভিমত। এর জন্ম হয়েছিল দক্ষিণ আমেরিকান প্লেট (আটলান্টিক ওশানে মেজর টেকটোনিক প্লেট, যার মধ্যে পুরো দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশ রয়েছে এবং এটি আফ্রিকান প্লেট পর্যন্ত বিস্তৃত) এবং নাজকা প্লেটের সংঘর্ষে যখন আন্দিজ পর্বতমালার সৃষ্টি হয়।
ব্রাজিল থেকে গায়ানা পর্যন্ত এক বিরাট অঞ্চল সেই সংঘর্ষেই জেগে ওঠে। মাঝখানে বয়ে যায় আমাজন নদীসহ অসংখ্য নদনদী। এখানে প্রথম প্রাণের লীলা চাঞ্চল্য জেগে ওঠে সবুজ ঘাসের আস্তরণে। তারপর বৃক্ষরাজি, কীটপতঙ্গ, পশুপাখি আর মানুষের আশ্রয়দাতা হয়ে ওঠে আমাজন রেইনফরেস্ট।
জীবের জীবনধারণের জন্য অক্সিজেন যতটা জরুরি, পৃথিবীর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে ততটাই গুরুত্বপূর্ণ পৃথিবীর সব রেইনফরেস্ট। রেইনফরেস্ট পৃথিবীর ফুসফুস। এরা কেবল জল, বায়ু, খাদ্য আর ওষুধ উৎপাদনের উৎস নয়; হাজারো প্রাণিপ্রজাতির আশ্রয়দাতা। বায়ুমণ্ডল থেকে গ্রিনহাউস গ্যাস শুষে নেওয়ার শক্তিশালী শোষক।
একুশ শতকের পরিবর্তিত জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব রুখে দিতে সে কারণেই কিংবদন্তি ভূমিকা রয়েছে রেইনফরেস্টগুলোর। এ জন্যই আমাজন অরণ্যের ধ্বংস নিয়ে সারা পৃথিবী উদ্বিগ্ন আজ।
পৃথিবীর সবচেয়ে বেশিসংখ্যক উদ্ভিদ ও জীববৈচিত্র্য রয়েছে আমাজনের জঙ্গলে। সত্তর দশকের কিছু আগেও এর আয়তন ছিল ৫৫ লাখ বর্গকিলোমিটার (২১ লাখ ২৩ হাজার ৫৬২ বর্গমাইল)। সত্তর দশকে আয়তন পরিমাপ করা হয় ৪১ লাখ বর্গকিলোমিটার। নব্বইয়ের মধ্যভাগে মহা অরণ্যের বিরাট শরীর আরও বেশি সংকুচিত হয়ে পড়ে।
করোনার পরবর্তী ভাইরাস ছড়াতে পারে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বৃষ্টিচ্ছায় অরণ্য আমাজন থেকে। কারণ সেখানে নির্বিচারে বনভূমি ধ্বংস করা হচ্ছে। আর সেটা সব থেকে চিন্তার বিষয় এখন।
অরণ্য সুরক্ষায় তখনকার ব্রাজিলিয়ান সরকার ও আন্তর্জাতিক বিশ্ব মিলে কিছু সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করে। কিন্তু এই অসাধারণ ট্রপিক্যাল রেইনফরেস্টের করুণ পরিণতি তাতে ঠেকানো যায়নি। অবৈধ ও বৈধ—দুভাবেই ক্রমাগত বিস্তীর্ণ বনভূমি উজাড় হতে থাকে।
২০১৬ সালের নতুন পরিমাপে ধরা পড়ে ক্ষীণাঙ্গ হতে হতে আমাজনের আয়তন দাঁড়িয়েছে ১২ লাখ ৮৩ হাজার বর্গকিলোমিটার। ২০১৮ সালে ব্রাজিলের নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন জেইর বলসোনারো। তিনি এ দেশের ৩৮তম প্রেসিডেন্ট। বিভিন্ন তথ্যসূত্রের প্রকাশ, তার উৎসাহে তীব্রভাবে চলতে থাকে নতুন শিল্পকারখানা আর নতুন কৃষিজমি আবিষ্কারের পরিকল্পনা। আমাজনে ঘটতে থাকে একের পরে এক অগ্নিকাণ্ডের সব ভয়াবহ ঘটনা।
অবশ্য আমাজন বেসিনের রেইনফরেস্ট ২০১৯ সালেই যে প্রথম লেলিহান শিখায় জ্বলছে তা নয়; এখানকার প্রাচীন ইতিহাস বলছে, বাসস্থান গড়তে, কৃষিজমির প্রস্তুতিতে এই অঞ্চলের মানুষ বহুবার পুড়িয়েছে এই অরণ্যকে। এ ছাড়া, শুষ্ক মৌসুমে দাবানলের ঘটনাও রেইনফরেস্টগুলোর এক স্বাভাবিক ঘটনা।
কিন্তু বিশ শতক থেকে যেভাবে সারা বিশ্বে অরণ্যভূমি বিনষ্ট করার প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে, অতীতে সেভাবে কোনো দিনও হয়নি। বরং প্রকৃতির সঙ্গে সম্পূর্ণ সহযোগিতা বজায় রেখে হাজার হাজার বছর ধরে অরণ্যবাসী মানুষ ও বন্য প্রাণী বসবাস করে এসেছে অরণ্যের অভ্যন্তরে। এরপর জনসংখ্যা যত বেড়েছে, জড়বিজ্ঞানের প্রবল প্রতাপ যত বেশি আকাশচুম্বী হয়েছে, ততই অরণ্য সভ্যতা বিলীন হয়ে গেছে পৃথিবী থেকে।
জড়বিজ্ঞান সভ্যতায় বছরের পর বছর ধরে সীমাহীন নগরায়ণের কারণে, শিল্পসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তৈরির কাজে, আসবাবপত্র কিংবা জ্বালানির ব্যবহারে, কৃষিজমির অনুসন্ধানে এবং আরও হাজার রকমের নিষ্ঠুর অভিপ্রায় নিয়ে বিশাল বিস্তীর্ণ বনভূমিকে মানুষ নিঃশেষিত করেছে অপূরণীয় ক্ষতিতে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, যত বেশি বনাঞ্চল ধ্বংস হবে, তত বেশি মারণ ভাইরাস মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে। কারণ, বনভূমি হল মানুষ ও ভাইরাসের মাঝে ঢাল। এমনটা আগেই জানিয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা। বন্য প্রাণীর শরীরে থাকা অজানা ভাইরাস ছড়ানো রোধ করতে হলে বনাঞ্চল ধ্বংস আটকাতে হবে সবার আগে।
তারা বলছেন, করোনার পরবর্তী ভাইরাস ছড়াতে পারে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বৃষ্টিচ্ছায় অরণ্য আমাজন থেকে। কারণ সেখানে নির্বিচারে বনভূমি ধ্বংস করা হচ্ছে। আর সেটা সব থেকে চিন্তার বিষয় এখন।
সারা বিশ্বের ২০ শতাংশ অক্সিজেনের জোগান দেয় আমাজন বনভূমি। তার থেকেও বড় কথা, এই বনভূমিতে বহু নাম না জানা প্রাণীও রয়েছে। তাদের শরীরে রয়েছে অজানা প্রাণঘাতী ভাইরাস। সেই ভাইরাস একবার মানুষের মধ্যে ছড়াতে শুরু করলে বিপদ।
ব্রাজিলের পরিবেশ বিজ্ঞানী ডেভিড লাপোলা জানিয়েছেন, বনাঞ্চলে নগরায়ন করলে বিভিন্ন প্রাণী থেকে ভাইরাস মানুষের শরীরে ছড়ানো অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। আমাজনের গভীর অরণ্যে বহু চেনা-অচেনা ভাইরাস রয়েছে। মানুষ বনাঞ্চল ধ্বংস করে গভীর জঙ্গলে প্রবেশ করলে সেই ভাইরাসে সংক্রমিত হবে। আর আমাজন যেভাবে ধংস করা হচ্ছে তাতে এর পর সেখান থেকেই নতুন কোনও ভাইরাস ছড়াতে পারে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯৪৪
আপনার মতামত জানানঃ