২০১৯ সাল থেকেই সারা পৃথিবীতে চলছে করোনাভাইরাসের মহামারি। মরছে লাখ লাখ মানুষ। বিধ্বস্ত হচ্ছে একের পর এক জনপদ। লকডাউনের নামে বিশ্বব্যাপী চলছে তাণ্ডব। একের পর এক লকডাউন, জরুরি অবস্থা ও শত বিধিনিষেধেও কোনো কাজ হচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে কোটি কোটি মানুষের জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছে করোনার টিকা। ইতোমধ্যে হাজার হাজার মানুষকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে এনেছে। একই সঙ্গে প্রকৃতিতে ফিরিয়ে দিচ্ছে স্বাভাবিক জীবন। তবে এই টিকায় যে করোনা একেবারে প্রতিরোধ করে ফেলা যাচ্ছে, তা নয়। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, করোনা দূর করা সম্ভব নয়। বর্তমান টিকাকে অকার্যকারিতার চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে আসছে একের পর এক নতুন ধরন।
ভারত থেকে শুরু হওয়া প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের ডেলটা ধরনের কারণে অনেক দেশে এখনো সংক্রমণ-মৃত্যু তুঙ্গে। মহামারি করোনা ভাইরাসের ডেলটা ধরনের তাণ্ডবের পর আবারও গোটা বিশ্বকে মাতাতে আসছে করোনার দ্রুত রুপান্তরিত আরও এক ধরন।
ভারতের ইন্দোরে এওয়াই.৪ নামে করোনার নতুন একটি ধরনে আক্রান্ত সাতজনকে শনাক্ত করা হয়েছে। এটি করোনার অতিসংক্রামক ধরন ডেলটা গোত্রের। ভারতের জাতীয় রোগ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র (এনসিডিসি) জিনোম সিকোয়েন্সিং করে সাতজনের নমুনায় এ ধরন শনাক্ত করেছে বলে টাইমস অব ইন্ডিয়ার খবরে বলা হয়েছে।
ভারতের মধ্যপ্রদেশ রাজ্যের বড় শহর ইন্দোরের প্রধান চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বি এস সাতিয়া জানান, এসব নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছিল গত সেপ্টেম্বরে। আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে দুজন সেনা কর্মকর্তা। এ ছাড়া মহারাষ্ট্রের ১ শতাংশ নমুনাতেও এওয়াই.৪-এর সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছিল।
এনসিডিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, সেপ্টেম্বরে ইন্দোরে ঊর্ধ্বমুখী করোনা সংক্রমণের নেপথ্যে ছিল ডেলটার এ ধরন। আগস্টের তুলনায় তখন ৬৪ শতাংশ বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছিল। আর্মি কলেজে প্রশিক্ষণরত ৪৪ জন সেনা কর্মকর্তা করোনা পজিটিভ হন। এর পরই কর্তৃপক্ষ তাদের নমুনা জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের জন্য পাঠায়।
বি এস সাতিয়া বলেন, এনসিডিসি ১ অক্টোবরের মধ্যে সাতজনের প্রতিবেদন প্রকাশ করে এবং অন্যদের প্রতিবেদন প্রকাশ করে ১৬ অক্টোবর।
নতুন এ ধরনের ব্যাখ্যায় এমজিএম কলেজের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অনিতা মুথা টাইমস অব ইন্ডিয়াকে বলেন, এওয়াই.৪ হলো করোনার ডেলটা গোত্রের একটি ধরন। তবে এটা ডেলটা কিংবা ডেলটা প্লাস—কোনোটিই নয়।
টাইমস অব ইন্ডিয়া বলছে, এটা (এওয়াই.৪ ধরন) এখন ‘কৌতূহলোদ্দীপক’ একটা ধরন। এ ধরনের সংক্রমণ ক্ষমতা কেমন কিংবা এতে আক্রান্ত রোগীর গুরুতর পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার ঝুঁকি কতটুকু, তা নিয়ে খুব কমই জানা যাচ্ছে। এ ছাড়া এটা সংক্রমণের ক্ষেত্রে যুগান্তকারী কোনো প্রভাব ফেলতে পারবে কি না, সেটাও নিশ্চিত নয়।
এর আগে, এ রকম কয়েকটি ধরনকে করোনাভাইরাসের প্রধান ও প্রতিনিধিত্বশীল ধরন হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করেছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এগুলো হলো— আলফা, বিটা, গ্যামা, ডেলটা, কাপ্পা ও ল্যাম্বডা, মিউ।
গত প্রায় দেড় বছরে বিবর্তনের ফলে মূল করোনাভাইরাসের যে পরিবর্তিত ধরনসমূহের আবির্ভাব ঘটেছে সেগুলোকে দু’টি তালিকায় ভাগ করেছে ডব্লিউএইচও— পর্যবেক্ষণ তালিকা (ভ্যারিয়েন্ট অব ইন্টারেস্ট) এবং উদ্বেগজনক তালিকা (ভ্যারিয়েন্ট অব কনসার্ন)।
বর্তমানে ডব্লিউএইচওর উদ্বেগজনক ধরনের তালিকায় রয়েছে আলফা ও ডেলটাসহ ভাইরাসের চারটি পরিবর্তিত ধরন। বিশ্বের ১৯৩টি দেশে আলফায় আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে, আর ডেলটায় আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেছে ১৭০ দেশে।
অন্যদিকে, মিউসহ আরও ৫টি পরিবর্তিত ধরনকে পর্যবেক্ষণ তালিকাভূক্ত করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। সাপ্তাহিক বুলেটিনে ডব্লিউএইচও বলছে, কলম্বিয়া, দক্ষিণ আমেরিকার কয়েকটি দেশ এবং ইউরোপে ইতোমধ্যে এই ধরনে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে। এছাড়া কলম্বিয়ায় বর্তমানে সক্রিয় করোনা রোগীর ৩৯ শতাংশ মিউয়ে আক্রান্ত।
ভারতে করোনাভাইরাসে দৈনিক সংক্রমণের সংখ্যা কিছুটা কমেছে। দেশটির কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, শনিবার ১৬ হাজার ৩২৬ জন শনাক্ত হলেও গত ২৪ ঘণ্টায় ভারতে ১৫ হাজার ৯০৬ জন করোনায় আক্রান্ত বলে শনাক্ত হয়েছেন। একইসঙ্গে দৈনিক মৃত্যুর সংখ্যাও সামান্য কমেছে। গত ২৪ ঘণ্টায় দেশটিতে করোনায় আক্রান্ত হয়ে ৫৬১ জন প্রাণ হারিয়েছেন।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, দেশটির দৈনিক মৃত্যুর ৮২ শতাংশই হয়েছে দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য কেরালায়। গত ২৪ ঘণ্টায় রাজ্যটিতে ৪৬৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর তথ্য সংশোধন ও পরিমার্জনের ফলেই রাজ্যটিতে মৃত্যুর সংখ্যা এত বেশি বলে মনে করা হচ্ছে।
দৈনিক প্রাণহানির তালিকায় এরপই রয়েছে মহারাষ্ট্র। রোববার সকাল ৮টা পর্যন্ত রাজ্যটিতে ৩৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। তামিলনাড়ুতে মারা গেছেন ১৭ জন। পশ্চিমবঙ্গে ১২ জন এবং কর্নাটক ও মিজোরামে দৈনিক মৃত্যুর সংখ্যা ৭ জন।
এদিকে গত ২৪ ঘণ্টায় ৭৭ লক্ষ ৪০ হাজার ৬৭৬ জনকে টিকা দেওয়া হয়েছে। রোববার পর্যন্ত দেশটিতে মোট ১০২ কোটি ১০ লাখ ৪৩ হাজার ২৫৮ ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে। গত একদিনে ১৩ লাখ ৪০ হাজার ১৫৮ জনের করোনা পরীক্ষা করা হয়েছে। মোট পরীক্ষায় সংক্রমণের হার ছিল ১ দশমিক ১৯ শতাংশ।
ভারতে সক্রিয় রোগী সংখ্যা এখন এক লাখ ৭২ হাজার ৫৯৪ জন। শনিবারের তুলনায় সক্রিয় রোগীর সংখ্যা এক হাজার ১৩৪ জন কমেছে। গত ২৪ ঘণ্টায় দেশটিতে সুস্থ হয়ে উঠেছেন ১৬ হাজার ৪৭৯ জন করোনা রোগী।
ভারতে ইতোমধ্যেই ১০০ কোটি ডোজ টিকাদান সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু তারপরও নতুন করে সংক্রমণ মাথাচাড়া দেওয়ায় উৎসবের মৌসুম এবং বহু রাজ্যে করোনা বিধিনিষেধের শিথিলতাকেই দায়ী করা হচ্ছে। উৎসবের মৌসুমে আরও বেশি করে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছিলেন চিকিৎসক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩২৮
আপনার মতামত জানানঃ