করোনা মোকাবিলায় পুরো বিশ্বই যখন গলদঘর্ম, তখন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আক্রান্ত রোগীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন ডাক্তার-নার্সসহ স্বাস্থ্যসেবা কর্মীরা। তাদের বলা হচ্ছে, করোনার বিরুদ্ধে অসম যুদ্ধের সম্মুখসারির যোদ্ধা। বিশ্ব মহামারী করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে এ যুদ্ধে প্রথমসারির যোদ্ধা হিসেবে ডাক্তার, নার্সসহ প্রতিটি স্বাস্থ্যকর্মী সেবায় নিয়োজিত করছেন। দায়িত্ব পালন করতে দিয়ে অনেক চিকিৎসক নার্স ইতোমধ্যেই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুকে করেছেন আলিঙ্গন।
প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে বিশ্বে এ পর্যন্ত ১ লাখ ৮০ হাজার স্বাস্থ্যকর্মীর মৃত্যু হয়েছে বলে ধারণা করছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা— ডব্লিউএইচও। বৃহস্পতিবার সংস্থাটি জানিয়েছে, ২০২০ এর জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের মে মাসের মধ্যে ৮০ থেকে ১ লাখ ৮০ হাজার স্বাস্থ্যকর্মীর মৃত্যু হয়।
এ বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিচালক জিম ক্যাম্পবেল বলেন, ‘সকল স্বাস্থ্য ও পরিচর্যা কর্মীদের রক্ষা করা, তাদের অধিকার নিশ্চিতের পাশাপাশি কাজের উপযুক্ত পরিবেশে সুযোগ তৈরি করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষার্থে টিকার দেওয়ায় অগ্রাধিকার দিতে হবে’।
তবে সময়ের সাথে সাথে স্বাস্থ্যকর্মীদের মৃত্যুর হার অনেকটাই কমে এসেছে বলেও বিবৃতিতে জানিয়েছে ডব্লিউএইচও। কিন্তু এটিও সন্তোষজনক নয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে’।
এদিকে স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের অবশ্যই ভ্যাকসিনের জন্য অগ্রাধিকার দিতে হবে উল্লেখ করেন ডব্লিউএইচও-এর প্রধান টেড্রোস অ্যাধনম ঘেব্রেইয়েসাস।এ ছাড়া, তিনি ভ্যাকসিন বিতরণের ক্ষেত্রে অসততার বিষয়েও সমালোচনা করেন। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী আনুমানিক ১৩৫ মিলিয়ন কর্মী স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান বলেন, পরিসংখ্যানের তথ্য-উপাত্ত থেকে জানা যাচ্ছে যে, ১১৯টি দেশের মধ্যে গড়ে পাঁচজনের মধ্যে দুইজন করোনা টিকার পুরোপুরি ডোজ সম্পন্ন করেছেন।
তিনি আরও বলেন, অবশ্যই এটি বিস্তর পার্থক্য আঞ্চলিক এবং ধনী দেশগুলোর তুলনায়। তিনি তুলনা করে বলেন, আফ্রিকায় ১০ জনে একজন পুরোপুরি টিকা নিয়েছেন যা অন্য আটটি ধনী দেশের তুলনায় অনেক কম।
করোনায় আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে থাকেন স্বাস্থ্যকর্মীরা। ফলে তাদের আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কা থাকে বেশি। এমন প্রেক্ষাপটে টিকাদান কর্মসূচিতে স্বাস্থ্যকর্মীদের অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত বলে মনে করে ডব্লিউএইচও।
ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল অব নার্সেসের সভাপতি অ্যানেট কেনেডি করোনায় স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রাণহানিতে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, এসব মৃত্যুর মধ্যে অনেকেরই জীবন যাওয়া অপ্রয়োজনীয় ছিল। কারণ আমরা তাদের অনেককে বাঁচাতে পারতাম।
করোনা আক্রান্ত রোগীদের সেবা দিতে গিয়ে ডাক্তার-নার্সদের আক্রান্ত হওয়ার সুযোগ অনেক বেশি। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, সাধারণ মানুষের তুলনায় ডাক্তার ও নার্সদের করোনা টেস্ট রেজাল্ট ১২ শতাংশেরও বেশি পজিটিভ হয়েছে বিশ্বজুড়ে। ফলে চিকিৎসাসেবা যারা দিচ্ছেন তাদের মৃত্যুর হারও কম নয়।
এর আগে, ডব্লিউএইচওর আরেক শীর্ষ কর্মকর্তা ড. ব্রুস এইলওয়ার্ড বলেন, টিকা বণ্টনে সমতা না আসায় মহামারি আরও একবছর স্থায়ী হতে পারে।
ড. ব্রুস এইলওয়ার্ড বলেছেন, টিকার দুষ্প্রাপ্যতার কারণে করোনা সংকট ২০২২ সালেও অনেক দিন ধরে চলতে পারে।
জানা গেছে, আফ্রিকায় জনগোষ্ঠীর পাঁচ শতাংশেরও কম টিকা পেয়েছে, যেখানে বেশিরভাগ দেশে প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ টিকা পেয়ে গেছে।
করোনার যা টিকা উৎপাদন করা হয়েছে, তার বিপুল সংখ্যক ডোজই ব্যবহার করেছে উচ্চ আয়ের এবং মধ্যম আয়ের উপরের দিকে থাকা দেশগুলো। বিশ্বে এ পর্যন্ত যত ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে, আফ্রিকা পেয়েছে তার মাত্র দুই দশমিক ছয় শতাংশ।
জাতিসংঘভিত্তিক এই সংস্থার জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ডা. ব্রুস আইলওয়ার্ড এক সাক্ষাৎকারে বিবিসিকে জানিয়েছেন, এখনও বিশ্বের অনেক দরিদ্র দেশ করোনা টিকার কোনো ডোজ পায়নি। টিকার ডোজের মজুত না থাকায় টিকাদান কর্মসূচি শুরুই করতে পারেনি- এমন দেশের সংখ্যাও কম নয়।
তার ভাষায়, ‘বিশ্বজুড়ে টিকাবণ্টনের যে বর্তমান চিত্র তাতে খুব সহজেই বোঝা যায়, ২০২২ সালের মধ্যে পৃথিবী থেকে করোনা নির্মূল হবে না।’
এদিকে শুক্রবার সকালে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত, মৃত্যু ও সুস্থতার হিসাব রাখা ওয়েবসাইট ওয়ার্ল্ডোমিটারস থেকে পাওয়া সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় সারা বিশ্বে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৭ হাজারের বেশি মানুষ। একই সময়ে নতুন করে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ৪ লাখ ৬১ হাজার।
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহানে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ২৪ কোটি ৩২ লাখ। অন্যদিকে মৃতের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ৪৯ লাখ ৪৪ হাজার।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬০৬
আপনার মতামত জানানঃ