মেরু অঞ্চলের এবং পর্বত শিখরের হিমবাহ আগামী কয়েক দশক ধরে অপরিবর্তনীয় ধারায় গলতে থাকবে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের জলবায়ু বিষয়ক সংস্থা ইন্টার গভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি)। এদিকে, মেরু বা তুন্দ্রা অঞ্চলের বাইরে পৃথিবীর যে কোনো জায়গার তুলনায় সবচেয়ে বেশি হিমবাহ আছে পাকিস্তানে। তাই বিপদটা পাকিস্তানের জন্য বেশ বড়সড়ভাবেই হাজির হচ্ছে।
সূত্র মতে, এই হিমবাহের জলধারা নেমে আসে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যবর্তী বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন ও উর্বর উপত্যকা দিয়ে। এই জলধারা সিন্ধু অববাহিকায় গিয়ে নেমেছে। পাকিস্তানের মোট ২১ কোটি ৬০ লাখ জনসংখ্যার প্রায় ৭৫ শতাংশই সিন্ধু নদের তীরে বসতি গড়েছে।
পাকিস্তানের প্রধান পাঁচটি নগরের শিল্পকারখানা ও অভ্যন্তরীণ অন্যান্য পানির চাহিদা পূরণ সম্পূর্ণভাবে এই নদের ওপর নির্ভরশীল। দেশটির কৃষি ব্যবস্থা তার অর্থনীতিকে টেকসই করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে। আর সেই কৃষি ব্যবস্থা সিন্ধু নদীর ওপর একপ্রকার পুরোপুরি নির্ভরশীল।
আইপিসিসির প্রতিবেদনের তথ্য যদি ঠিক হয়ে থাকে (এই তথ্য প্রায় নিশ্চিত) তাহলে ২০৫০ সালের মধ্যে পাকিস্তানের এই পানি শেষ হয়ে যাবে। দশকের পর দশক ধরে বিশেষজ্ঞরা বলে আসছেন, উপত্যকার হিমবাহ দ্রুত গতিতে গলে যাচ্ছে এবং পাকিস্তানে সুপেয় পানি আসা বন্ধ হওয়া শুধু মাত্র সময়ের ব্যাপার। এখন আইপিসিসি বলছে, পাকিস্তানে অবিলম্বেই ‘পানিশূন্যতায়’ ভুগতে হবে। ক্রমবর্ধমান সংকটের আলামত দেখা যাওয়ার পরও পাকিস্তান সরকার এ বিষয়ে দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিচ্ছে না।
বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণ রোধের বিষয়টি অনেক দেশ জাতিসংঘে তুললেও পাকিস্তান তার নিজের ভবিষ্যৎ সুরক্ষায় নিম্নতম কোনো তৎপরতা দেখাচ্ছে না। পরবর্তী কয়েক দশকে গোটা পাকিস্তানকে সবচেয়ে বড় যে সংকট মোকাবিলা করতে হবে, সেটি হলো এই বৈশ্বিক উষ্ণায়ন। অথচ এই নিয়ে তার তেমন কোনো মাথা ব্যথা নেই।
পাকিস্তানকে স্বাদু পানির জন্য অ-মেরু অঞ্চলের বরফের ওপর যতখানি নির্ভর করতে হয়, অন্য কোনো দেশকে ততখানি করতে হয় না। অন্য কোনো দেশকে এতখানি ক্ষতির মুখেও পড়তে হবে না। এরপরও পাকিস্তান সরকারকে আসন্ন সংকটের বিষয়ে চরম উদাসীন দেখা যাচ্ছে।
এমনকি ২০৩০ সাল নাগাদ দেশটি তার প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎশক্তির ৬০ শতাংশ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সচেষ্ট হচ্ছে না। এই মুহূর্তে দেশটি ৬০ শতাংশ বিদ্যুৎ জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে উৎপাদন করে থাকে।
অথচ দেশটিতে দাবদাহে বহু মানুষ মারা যাচ্ছে এবং খরায় ফসল পুড়ে যাওয়ার ঘটনা নিয়মিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। চলতি বছর পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় শহর করাচি এবং রাজধানী শহর ইসলামাবাদে প্রবল বন্যা হয়েছে। এ ছাড়া ৮০৬ কিলোমিটারের কারাকোরাম মহাসড়ক (যেটি চিনের সঙ্গে পাকিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক করিডর হয়েছে ব্যবহৃত হয়ে থাকে) বারবার ভূমি ধসের কারণে বেশ কয়েক দফা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
উত্তরাঞ্চলীয় কোহিস্তান এবং দক্ষিণাঞ্চলের জাগলটের পার্বত্য বন কেটে উজাড় করার সরাসরি প্রভাব হয়েছে এসব ভূমি ধসের ঘটনা ঘটেছে। এরপরও উত্তরাঞ্চলের শিমশাল এবং পূর্বাঞ্চলীয় স্কার্দু উপত্যকায় বৃক্ষ চোরাই কারবারিরা পাহাড়ের গায়ে জন্মানো বড় বড় গাছ কেটে পার্বত্য বন উজাড় করে ফেলছে।
স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক গবেষকেরা বলছেন, পাকিস্তান যদি এই বন উজাড় করা দ্রুত বন্ধ না করে তাহলে তা শুধু পাকিস্তান নয়, গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় ভয়ানক পরিণতি ডেকে আনবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পাকিস্তান অস্তিত্ব সংকটে পড়ে গেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব শুধু কোনো নির্দিষ্ট একটি বা দুইটি খাতের ওপর পড়ছে না। এটি সমগ্র দেশের সমস্ত জনগণের জীবনযাপনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এ অবস্থায় পাকিস্তানসহ সারা বিশ্বের সামনে দুটি পথ খোলা। একটি হলো নিশ্চিত ধ্বংসের পথে এগিয়ে যাওয়া। অন্যটি হলো, সমন্বিতভাবে এই পরিবেশবিনাশী কার্যক্রমের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। আমরা কোন পথে যাব তা আমাদেরই বেছে নিতে হবে।
এসডব্লিউ/এসএস/১০৩৪
আপনার মতামত জানানঃ