চীনে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নেওয়ার চর্চা বহু পুরোনো। তবে দেশটি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, ২০১৫ সালের মধ্যে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদিদের অঙ্গ ব্যবহার বন্ধ করবে। এই নৃশংসতা বন্ধ তো হয়ইনি। বরং এখন মানবাধিকার সংস্থাসমূহের দাবি অনুসারে, চীনে সরকারি নির্দেশনায় চালিত ‘কিল টু অর্ডারে’র সঙ্গে জড়িয়ে আছে মানব অঙ্গ-পাচারকারীদের বিশাল এক নেটওয়ার্ক। এ ঘটনাকে শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহ নৃশংসতার সঙ্গেও তুলনা করেছে তারা৷
সূত্র মতে, চীনের কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিবছর প্রায় এক লাখ রাষ্ট্রদোহী, সংখ্যালঘু ও রাজনৈতিক কারাবন্দির হৃদপিণ্ড, কিডনি, লিভার এবং কর্নিয়া অপসারণ করে থাকে।
কিন্তু, তা সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করতে অক্ষম, কেননা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) একদলীয় রাষ্ট্রের ‘অপর্যাপ্ত এবং বিভ্রান্তিকর’ হাসপাতাল নথি ও তথ্য বিনা প্রশ্নে গ্রহণ করতে বাধ্য।
সম্প্রতি জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের অফিস থেকে প্রচারিত এক বিবৃতিতে বলা হয়, চীন নির্দিষ্ট জাতিগত, ভাষাগত কিংবা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের টার্গেট করে বছরে কয়েক বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য করছে। তবে, বেইজিং এই রাষ্ট্রচালিত অঙ্গ-অপসারণ প্রকল্পের অস্তিত্বের কথা অস্বীকার করে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের নয়জন বিশেষ প্রতিবেদক এক বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রত্যক্ষদর্শীদের অনুসন্ধান, সাক্ষ্যগ্রহণ এবং চীনের সন্দেহজনকহারে উচ্চমাত্রার অঙ্গদাতার পরিসংখ্যান ঘেটে ভয়ঙ্কর এই অঙ্গ-পাচার বাজারের ওপর নতুন করে আলোকপাত করেন।
বিবৃতিতে বলা হয়, “জাতিসংঘের মানবাধিকার রক্ষাকারী বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, তারা চীনের ডিটেনশন ক্যাম্পে ফালুন গঙ অনুসারী, উইঘুর, তিব্বতি, মুসলিম ও খ্রিস্টানসহ সংখ্যালঘুদের ‘অঙ্গ-অপসারণের’ অভিযোগগুলো নিয়ে ভীষণভাবে শঙ্কিত।”
বলা হয়, “সম্মতি ছাড়াই জোর করে আটককৃতদের রক্ত ও অঙ্গ পরীক্ষা যেমন আলট্রাসাউন্ড, এক্সরে ইত্যাদি পরিচালনা করার নির্ভরযোগ্য তথ্য পেয়েছেন বিশেষজ্ঞ দল। সকল কারাবন্দিদের ক্ষেত্রে এসব পরীক্ষা করানো হয় না।”
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, “মেডিকেল পরীক্ষার এসব ফলাফল অঙ্গদানের জন্য তৈরি ‘লিভিং অর্গান সোর্সে’র তালিকায় নথিভুক্ত করা হয়। অভিযোগ অনুসারে, বন্দিদের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি নেওয়া অঙ্গগুলোর মধ্যে আছে হৃদপিণ্ড, কিডনি, লিভার, কর্নিয়া এবং লিভারের কিছু অংশ (অপেক্ষাকৃত কম)।”
অঙ্গ-পাচারের এই প্রক্রিয়ায় সঙ্গে সার্জন, এনেস্থেটিস্টসহ চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ ও দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মীদের পাশাপাশি বিভিন্ন সরকারি খাতের কর্মকর্তারাও যুক্ত।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, “কারাবন্দিদের অনেকে নিজেদের বিশ্বাস ত্যাগ করতে সম্মত না হলে বা পুলিশকে সহযোগিতা করতে রাজি না হলে, তাদের হত্যা এবং অঙ্গ-অপসারণের হুমকি দেয় পুলিশ।”
চীনের অঙ্গ-প্রতিস্থাপন ব্যবস্থার সবচেয়ে সন্দেহজনক বিষয়টি হলো অঙ্গ-প্রত্যাশীরা নির্দিষ্ট সময় ও স্থানে সার্জারির জন্য বুকিং দিতে পারেন। অথচ মরণোত্তর দানের ক্ষেত্রে অঙ্গ-দাতার মৃত্যু কবে হবে, তা চিকিৎসকরা আগে থেকে বলতে পারেন না।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক অনুমোদিত প্রক্রিয়ায়, প্রতিস্থাপনের তালিকায় থাকা রোগীদের মধ্যে যার সবচেয়ে জরুরি ভিত্তিতে প্রতিস্থাপন প্রয়োজন ও যিনি হাসপাতালে সহজেই আসতে পারবেন, এমন রোগীকেই মিলে যাওয়া মৃত ব্যক্তির অঙ্গদান করা হয়।
বহু অঙ্গ-প্রত্যাশী ব্যক্তিকে প্রতিস্থাপনের জন্য বছরের পর বছর ধরে অপেক্ষা করতে হয়। কেননা, একই রক্তের গ্রুপ এবং একই সাইজের অঙ্গ এতসব মিল সহজে খুঁজে পাওয়া যায় না।
২০১৯ সালে চীনের স্বাধীন ট্রাইবুনাল শুনানিতে হাসপাতালগুলোর গোপন ফোনকল থেকে দেখা যায় যে, রোগীরা খুব দ্রুতই ‘কিল টু অর্ডার’ ব্যবস্থায় প্রতিস্থাপন সার্জারি করাতে পারেন। চীনের শ্যানডং প্রদেশের সামরিক হাসপাতালের চিকিৎসক ড. ফেং জেংডং তদন্তকারীদের ফোনে বলেন যে, ‘প্রতি মাসে’ হাসপাতালে ‘অসংখ্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ’ আসে।
চীনের এই ভয়ংকর রাষ্ট্র-চালিত অঙ্গ-পাচারের কয়েক দশকের প্রমাণাদি থাকা সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তা বন্ধ করতে ব্যর্থ হয়েছে। প্রতিস্থাপনের ভুল তথ্য উপস্থাপন করে বেইজিং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কাছে মানবাধিকার লঙ্ঘনের তথ্য ধামাচাপা দিতে সমর্থ হয়েছে।
জাতিসংঘের বিবৃতিকে চীন বারবার ‘বানোয়াট’ ও ‘মানহানিকর’ তথ্য বলে আখ্যা দিয়েছে। এমনকি, সাক্ষ্যপ্রমাণ থাকা সত্ত্বেও চীনা সরকার এসব সাক্ষ্যদাতা স্রেফ ‘অভিনয়’ করেন বলে ব্যাখ্যা দিয়ে আসছে।
চীনের জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর কোনো মানবতাবিরোধী অপরাধ হয়েছে কিনা, তা খতিয়ে দেখতে একটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছিল। ওই ট্রাইব্যুনালের কাউন্সেল হামিদ সাবি জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলকে (ইউএনএইচআরসি) জানিয়েছিলেন, বহু বছর চীন জুড়ে জোর করে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংগ্রহ করা হয়েছিল এবং আজও তা অব্যাহত আছে৷ নিষিদ্ধ ঘোষিত ফালুন গং-এর বন্দি এবং উইগুর সংখ্যালঘুদের এই লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হয়, এতে লাখ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে৷
তিনি বলেন, শিকারের জন্য শিকার, মৃত্যুর জন্য মৃত্যু, হার্ট ও অন্যান্য অঙ্গ জীবিত অবস্থায় কেটে ফেলা; নির্দোষ, নিরীহ মানুষ এই শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহ গণ-অত্যাচারের শিকার হয়েছেন৷
ট্রাইব্যুনালের চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, চীনের বন্দি এবং ফালুন গং ও উইগুর সংখ্যালঘুদের ওপর মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রমাণ পেয়েছে তারা৷ দীর্ঘ ২০ বছর ধরে চীন সরকার সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর লোকদের হত্যা করে তাদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নিয়ে বিক্রি করছে৷
বন্দি ও সংখ্যালঘু ছাড়াও জীবিত বা মৃত ব্যক্তির কিডনি, লিভার, হার্ট, ফুসফুস, কর্নিয়া এবং ত্বকের চামড়া বিক্রির জন্য অপসারণ করা হয় বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
এসডব্লিউ/এসএস/১২৫৮
আপনার মতামত জানানঃ