সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে কথিত কটূক্তি করা ছবি শেয়ার করার অভিযোগে যুবলীগ নেতার করা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে ফরহাদ আসিফ টিপু (৫০) নামের এক সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গ্রেপ্তার ফরহাদ আসিফ টিপু দৈনিক যায়যায়দিন পত্রিকার কুমারখালী উপজেলা প্রতিনিধি।
কুমারখালী উপজেলা যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ফরহাদ ইমরান বাদী হয়ে মঙ্গলবার (১৯ অক্টোবর) টিপুর বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে (আইসিটি অ্যাক্ট) মামলা করলে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। তাকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানোর প্রস্তুতি চলছে।
পুলিশ ও মামলা সূত্রে জানা গেছে, ফেসবুকে অন্য আইডি থেকে প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে কটূক্তি ও বিকৃত করে পোস্ট করা ছবি নিজের ওয়ালে শেয়ার দেন ফরহাদ। সেটি উপজেলা যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ফরহাদ ইমরানের নজরে এলে তিনি বাদী হয়ে কুমারখালী থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন।
কুমারখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কামরুজ্জামান তালুকদার জানান, প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ফেসবুকে অপপ্রচার ছড়ানোর অভিযোগে ফরহাদ আসিফ টিপুকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাকে কুষ্টিয়া আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হবে।
সম্প্রতি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক গবেষণা প্রতিবেদন জানায়, মহামারি করোনাভাইরাসের মধ্যে সরকারের ভূমিকা নিয়ে লেখালেখির কারণে সারা দেশে ৮৫ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে। এছাড়া একই কারণে আটক একজন লেখকের কারাবন্দী অবস্থায় মৃত্যু হয়েছে।
টিআইবি বলছে, ২০২০ সালে ২৪৭ জন সাংবাদিক আক্রমণ ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। কোভিড–১৯ অতিমারির সময়েও ৮৫ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে। করোনা পরিস্থিতিতে সরকারের ভূমিকা নিয়ে লেখালেখির অপরাধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আটক লেখকের কারাগারে মৃত্যু হয়।
স্বাস্থ্যখাতের দুর্নীতি নিয়ে ধারাবাহিকভাবে প্রতিবেদন করা সাংবাদিক স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে তথ্য সংগ্রহের সময় নির্যাতনের শিকার ও আটক, তার বিরুদ্ধে অযৌক্তিকভাবে অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট, ১৯২৩–এ মামলা দায়ের ও কারাগারে পাঠানোর ঘটনা ঘটেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, সরকারের সমালোচনা করলেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানো হচ্ছে। এই আইনে মামলা ও গ্রেপ্তারের যেসব ঘটনা ঘটছে, পরিষ্কারভাবে তা গণমাধ্যম ও বাকস্বাধীনতার জন্য মারাত্মক হুমকি।
তারা বলেন, বাংলাদেশে হত্যার আসামির দণ্ড মওকুফ হয় অথবা দ্রুত জামিন হয়, ঋণখেলাপি ও আর্থিক খাত থেকে লুটপাটকারীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে, হাজার-কোটি টাকা বিদেশে পাচারকারী সহজেই দেশ ছাড়তে পারে, কিন্তু ফেসবুকে সরকারবিরোধী কিংবা ক্ষমতাসীন সরকারের লোকজনের বিরুদ্ধে কিছু লেখা যেন তার চাইতে বড় অপরাধ!
তারা বলেন, যে নিরাপত্তা আইন তৈরি করা হয়েছে, সে আইন নিয়ে বড় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে যে— এ আইন কার জন্য করা হয়েছে? আইন তো তৈরি করা হয় সাধারণ জনগণের জন্য। এই আইন আসলে কার নিরাপত্তা দিচ্ছে? এ আইনে যারা বাদী হয়েছেন, তাদের অধিকাংশই ক্ষমতাসীন দলের কর্মী, এমপি, মন্ত্রী ও প্রশাসনের লোকজন। আর যারা আইনের শিকার হয়েছেন তারা সাংবাদিক, লেখক ও অ্যাক্টিভিস্ট। আমাদের সাধারণ মানুষের প্রতিবাদের সাহস গড়ে তোলেন একজন লেখক, সাহিত্য, অ্যাক্টিভিস্ট ও সাংবাদিক। তারা যেন মুক্তভাবে কথা বলতে পারে সেজন্য তাদের সমর্থন করুন। আর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো একটি নিপীড়নমূলক আইন গণতন্ত্রের দেশে থাকতে পারে না।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘দেশের সংবিধানে বাকস্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে, বিশেষ করে সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে ডিজিটাল অ্যাক্টসহ যেসব আইন হয়েছে, সেগুলো রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে যে বাকস্বাধীনতা ও গণতন্ত্র অর্জন করেছি, তার সঙ্গে সুস্পষ্টভাবে বিপরীতমুখী ও সাংঘর্ষিক। এগুলো স্বাধীন সাংবাদিকতার পথকে সংকুচিত করেছে।’
তারা বলেন, সারা বিশ্ব দেখছে, এই দেশটি সাংবাদিক নিপীড়নকারী দেশ এবং গণমাধ্যমের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন করে এমন একটি দেশ। সাংবাদিকদের স্বাধীনতা চাই, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা চাই। সাংবাদিকতার স্বাধীনতা রাষ্ট্রের জন্য, সরকারের জন্য এবং সুশাসনের জন্য দরকার।’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮০২
আপনার মতামত জানানঃ