উইঘুরদের সংস্কৃতি ও ইসলামিক বিশ্বাসকে পরিবর্তন করে তার জায়গায় আধুনিক বস্তুবাদী পরিচয় এবং কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি আনুগত্য চাপিয়ে দেওয়া চীনের অন্যতম উদ্দেশ্য। তবে চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে উইঘুরদেরকে চীনা হ্যান সংস্কৃতির অংশ করা। এর সূত্রপাত বেশ আগে; বেইজিংয়ে ২০১৩ সালে এবং কুনমিংএ ২০১৪ সালে পথচারী ও পরিবহনে যাত্রীদের ওপর দুটি নৃশংস আক্রমণে ঘটেছিল। এর জন্য উইঘুর ইসলামপন্থী ও বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দায়ী করা হয়। চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এই নৃশংসতার কারিগর।
এরপর ২০১৭ সাল থেকে চীনের কয়েকটি বন্দিশিবিরে উইঘুর ও অন্যান্য মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রায় ১৮ লাখ জনকে আটকে রাখা হয়েছে। উইঘুর ইস্যুতে আন্তর্জাতিক মহল থেকে বিভিন্ন সময়ে চীনের ওপর চাপ প্রয়োগ করার চেষ্টা করা হলেও তাতে খুব একটা কর্ণপাত করেনি চীন।
উত্তর পশ্চিম চীনের জিনজিয়াং প্রদেশের এই উইঘুরদের সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ। মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো বলছে, চীনা সরকার উইঘুরদের ধর্মীয় ও অন্য স্বাধীনতার ক্রমে ক্রমে হরণ করেছে এবং গণ-নজরদারি, বন্দীত্ব, মগজ ধোলাই এবং জোরপূর্বক বন্ধ্যাকরণ পর্যন্ত করানোর এক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে।
বেইজিংয়ের অধীনে থাকা জিনজিয়াং উইঘুর স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলে (এক্সইউএআর) প্রচণ্ড রকমের বৈষম্যের স্বীকার উইঘুররা। চীনা কর্তৃপক্ষ তাদের ধর্মচর্চার অধিকার কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। পাশপাশি তাদের মুখের ভাষাও কেড়ে নিতে চায় চীনা কর্তৃপক্ষ।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে উইঘুর মুসলিমদের জন্য গড়ে ওঠা ‘পুনঃশিক্ষণ’ কেন্দ্রে নারীরা পরিকল্পিতভবে ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন ও অত্যাচারের শিকার হচ্ছেন বলে এক প্রতিবেদনে জানায় বিবিসি। এই নারীদের একজন হচ্ছেন তুরসুনে জিয়াউদুন।
বিবিসিকে তিনি বলেছিলেন, “তখন কোন মহামারি চলছিল না কিন্তু ওই লোকগুলো সবসময়ই মুখোশ পরে থাকতো। তারা স্যুট পরতো, পুলিশের পোশাক নয়। কখনো কখনো তারা আসতো মধ্যরাতের পরে। সেলের মধ্যে এসে তারা ইচ্ছেমত কোন একজন নারীকে বেছে নিতো। তাদের নিয়ে যাওয়া হতো করিডোরের আরেক মাথায় ‘কালো ঘর’ বলে একটি কক্ষে। ওই ঘরটিতে নজরদারির জন্য কোন ক্যামেরা ছিল না।”
জিনজিয়াং প্রদেশে চীনের এইসব গোপন বন্দী শিবিরের একটিতে তুরসুনে জিয়াউদুন বাস করেছেন মোট ৯ মাস। জিয়াউদুন বলেন, বেশ কয়েক রাতে তাকে এভাবেই নিয়ে গিয়েছিল ওরা। তিনি বলেন, “হয়তো এটি আমার জীবনে এমন এক কলঙ্ক, যা আমি কখনো ভুলতে পারবো না। এসব কথা আমার মুখ দিয়ে বের হোক; এটাও আমি কখনো চাইনি।”
বন্দিদের চীনা ভাষা শিক্ষা দিতে যাদের বাধ্য করা হতো তাদের একজন ছিলেন কেলবিনুর সেদিক। তিনি পরে চীন থেকে পালিয়ে যান, এবং তার অভিজ্ঞতা প্রকাশ্যে বর্ণনা করেন। বিবিসিকে তিনি বলেন, নারীদের ক্যাম্পগুলো কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত হলেও তিনি ধর্ষণের কথা শুনতে পেতেন, এর আভাসও পেতেন।
একদিন পরিচিত একজন চীনা মহিলা পুলিশকে তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন যে ব্যাপারটা সত্যি কিনা। সেই মহিলা পুলিশটি তাকে জানায় যে হ্যাঁ, গণধর্ষণ এখানকার সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। চীনা পুলিশ শুধু যে ধর্ষণ করে তাই নয়, মেয়েদের ইলেকট্রিক শক দেয়, ভয়াবহ সব নির্যাতন করে।
উইঘুর হিউম্যান রাইটস প্রজেক্টের সামনে দেয়া এক জবানবন্দীতে সেদিক বলেন, তিনি মেয়েদের নির্যাতনের জন্য ইলেকট্রিক স্টিক নামে একটা জিনিসের কথা শুনেছেন; যা মেয়েদের শরীরে ঢুকিয়ে দেয়া হতো। সেদিক জানান, “চার রকম করে ইলেকট্রিক শক দেয়া হতো। চেয়ার, দস্তানা, হেলমেট আর পায়ুপথে স্টিক দিয়ে ধর্ষণ।”
তিনি বলেন, “পুরো ভবন জুড়ে মেয়েদের আর্তনাদের প্রতিধ্বনি শোনা যেতো। আমি দুপুরের খাবারের সময়, বা কখনো কখনো ক্লাস থেকেও তা শুনতে পেতাম।”
ক্যাম্পে শিক্ষক হিসেবে কাজ করতে বাধ্য হওয়া আরেক নারী সায়রাগুল সাউৎবে বিবিসিকে বলেন, ধর্ষণ ছিল খুবই সাধারণ ঘটনা। রক্ষীরা যাকে চাইতো, তাকেই তুলে নিয়ে যেতো।
তিনি বলেন, তিনি একটি ভয়াবহ ও প্রকাশ্য গণধর্ষণের ঘটনা দেখেছেন। তিনি বলেন, “একটি ২০-২১ বছরের মেয়েকে ১০০ জন বন্দীর সামনে নিয়ে আসা হয়, তাদের বাধ্য করা হয় স্বীকারোক্তি দিতে। এবং তারপর পুলিশ পালাক্রমে মেয়েটিকে ধর্ষণ করে সবার সামনে। সে সময় তারা অন্য বন্দীদের ওপর নজর রাখছিল। তাদের কেউ বাধা দেবার চেষ্টা করলে, চোখ বন্ধ করলে, অন্যদিকে তাকালে, বা হাতের মুঠি শক্ত করলেই তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল শাস্তি দেবার জন্য।”
এমন নৃশংস অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাওয়া আর একজন জিয়াউদুন। বয়স ৪২। বন্দীশিবিরে আনার পর নারীদের অলংকার খুলে ফেলা হয়। জিয়াউদুনের কানের দুল ছিঁড়ে নেয়া হলে তার কান দিয়ে রক্ত পড়তে থাকে। এ সময় একজন বয়স্ক মহিলার মাথার হিজাব টেনে খুলে নেয়া হয়, রক্ষীরা লম্বা পোশাক পরার জন্য তার প্রতি চিৎকার করতে থাকে।
জিয়াউদুন বলেন, “সেই বয়স্ক মহিলাটির অন্তর্বাস ছাড়া আর সব কাপড় খুলে নেয়া হয়। মহিলাটি দু হাত দিয়ে তার লজ্জা ঢাকা চেষ্টা করতে থাকেন। তিনি অঝোরে কাঁদছিলেন, আর তার অবস্থা দেখে আমিও কাঁদছিলাম।”
বাংকবেড-বিশিষ্ট একেকটি কারাকক্ষে ১৪ জন নারীকে রাখা হতো। তাতে ছিল একটি বেসিন ও একটি টয়লেট। প্রথম দিকে যখন রাতে মেয়েদের তুলে নিয়ে যাওয়া হতো তখন জিয়াউদুন ব্যাপারটা বুঝতে পারেননি। তিনি ভেবেছিলেন হয়তো এই মেয়েদের অন্য কোথাও নিযে যাওয়া হচ্ছে।
পরে ২০১৮ সালের মে মাসের কোন এক দিন, জিয়াউদুন এবং আরেকটি মেয়েকে, যার বয়স ছিল ২০এর কোঠায়, তুলে নিয়ে একজন মুখোশপরা চীনা পুরুষের হাতে তুলে দেয়া হয়। দুজনকে নেওয়া হয় দুটি আলাদা ঘরে।
যে মহিলাটি তাদের সেল থেকে নিয়ে এসেছিল, সে ওই লোকদের জানায় যে সম্প্রতি জিয়াউদুনের রক্তপাত হয়েছে। একথা বলার পর একজন চীনা লোক তাকে গালাগালি করে। মুখোশ পরা লোকটি বলে “ওকে অন্ধকার ঘরে নিয়ে যাও”।
জিয়াউদুন বলেন, “মহিলাটি আমাকে সেই অন্ধকার ঘরে নিয়ে যায়। তাদের হাতে একটা ইলেকট্রিক লাঠির মত ছিল; সেটা কি জিনিস আমি জানি না। সেটা আমার যৌনাঙ্গে ঢুকিয়ে দেয়া হলো, আমাকে বৈদ্যুতিক শক দিয়ে নির্যাতন করা হলো।”
সেই মহিলাটি তখন আমার শারীরিক অবস্থার কথা বলে বাধা দেয়ায় নির্যাতন বন্ধ হলো, আমাকে সেলে ফেরত পাঠানো হলো। ঘন্টাখানেক পর দ্বিতীয় মেয়েটিকেও সেলে ফিরিয়ে আনা হলো, যাকে জিয়াউদুনের পাশের ঘরে পাঠানো হয়েছিল। তার পর থেকে মেয়েটি একেবারে অন্যরকম হয়ে যায়। সে কারো সাথে কথা বলতো না। এক একা বসে শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো। ওই সেলের অনেকেই এমন হয়ে গিয়েছিল।
জিয়াউদুন বলেন, “নির্যাতনকারীরা শুধু ধর্ষণই করতো না, সারা শরীরে কামড়াতো। আপনি বুঝবেন না যে তারা মানুষ না পশু। শরীরের কোন অংশই তারা বাকি রাখতো না, সবখানে কামড়াতো আর তাতে বীভৎস সব দাগ হয়ে যেতো। তিনবার আমার এ অভিজ্ঞতা হয়েছে।”
তার সেলে থাকা আরেকটি মেয়ে জিয়াউদুনকে বলেছিল, তাকে আটক করা হয়েছিল বেশি বেশি সন্তান জন্ম দেয়ার কারণে। এই মেয়েটিকেও তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল এবং তিনদিন বাদে সেলে ফিরে আসার পর দেখা যায় – তার শরীরেও একই রকম কামড়ের দাগ।
কিছু মেয়ে যাদের সেল থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তারা আর কখনো ফিরে আসেনি। যারা ফিরে এসেছিল তাদের হুমকি দেয়া হয়েছিল যেন কি ঘটেছে তা যেন তারা কাউকে না বলে। এসব বন্দী শিবিরে কোন কোন অনুমান অনুযায়ী ১০ লাখেরও বেশি নারী পুরুষকে রাখা হয়েছে। যদিও চীনের বক্তব্য, উইঘুর ও অন্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকদের পুনঃশিক্ষণের জন্যই এসব শিবির।
এসডব্লিউ/এসএস/১৬৪৮
আপনার মতামত জানানঃ