ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে (বিএসএফ) অতিরিক্ত ক্ষমতা প্রদান করেছে দেশটির কেন্দ্রীয় সরকার। বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান সীমান্তবর্তী এলাকার তিনটি রাজ্যে সীমানার ৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত গ্রেফতার, তল্লাশি এবং জব্দ করার ক্ষমতা পাবেন বিএসএফ কর্মকর্তারা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, নরেন্দ্র মোদির এই সিদ্ধান্ত সীমান্তে পতিস্থিতিকে আরও বিপদে নিয়ে যাবে। ১০ বছর আগে সীমান্তে নিহত কিশোরী ফেলানীর পরিবার এখনো বিচার পায়নি৷ বন্ধ হয়নি সীমান্ত হত্যা৷ বাংলাদেশের মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর হিসাব অনুযায়ী, ২০২০ সালে সীমান্তে মোট ৪৮ জন বাংলাদেশিকে হত্যা করে বিএসএফ৷ এর মধ্যে ৪২ জনকে গুলি করে এবং ছয় জনকে হত্যা করা হয় নির্যাতন চালিয়ে৷ অপহরণ করা হয় ২২ বাংলাদেশিকে৷ ওই সময়ে ২৬ জন বিএসএফ-এর গুলি ও নির্যাতনে গুরুতর আহত হন৷ অপহৃতদের মধ্যে মাত্র পাঁচ জনকে ফেরত দেয়া হয়েছে৷ বাকিদের ভাগ্যে কী ঘটেছে জানা যায়নি৷
অন্যদিকে, ২০১৯ সালে সীমান্তে বিএসএফ ৩৮ জন বাংলাদেশিকে হত্যা করে৷ তাদের মধ্যে ৩৩ জনকে গুলি করে এবং পাঁচ জনকে নির্যাতনে হত্যা করা হয়৷ ২০১৮ সালে সীমান্তে ১৪ জন বাংলাদেশিকে হত্যা করা হয়৷ এই পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট যে, সীমান্তে বাংলাদেশি হত্যা বাড়ছে৷ বাড়ছে মারণাস্ত্রের ব্যবহার৷
তুর্কি বার্তা সংস্থা আনাদলু এজেন্সির ১৩ ডিসেম্বর, ২০২০-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে থেকে জানা যায়, মানবাধিকার সংস্থার মতে, ২০০০-২০১৯ সালের মধ্যে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে কমপক্ষে ১,১৮৫ বাংলাদেশিকে হত্যা করেছে বিএসএফ।
সূত্র মতে, বুধবার এক সিদ্ধান্তে ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট মন্ত্রণালয় জানায়, সীমান্তে এলাকা জুড়ে ড্রোনে করে অস্ত্র টানার ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় বিএসএফ-এর আওতাধীন এলাকা বাড়ানো হয়েছে।
আসাম, পশ্চিমবঙ্গ এবং পাঞ্জাবে রাজ্য ভারত-পাকিস্তান এবং ভারত-বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সীমান্ত থেকে ৫০ কিলোমিটার অভ্যন্তর পর্যন্ত এসব অভিযান চালাতে পারবে বিএসএফ। অনেকটা পুলিশের মতোই তল্লাশি চালাতে পারবে তারা। আগে এই আওতা ছিলো ১৫ কিলোমিটার পর্যন্ত। এর পাশাপাশি বিএসএফ নাগাল্যান্ড, মিজোরাম, ত্রিপুরা, মনিপুর এবং লাদাখে তল্লাশি ও গ্রেফতার অভিযান চালাতে পারবে বলে জানা গেছে।
সীমান্তে বিএসএফ-এর আচরণ নিয়ে বিতর্ক নতুন নয়। এবার সেই বিতর্ক আরো বাড়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। বুধবার একটি গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকার জানিয়েছে, বিশেষত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ সীমান্তে বিএসএফ-এর ক্ষমতা বাড়ানো হচ্ছে।
এর ফলে স্থানীয় পুলিশের সঙ্গে বিএসএফ-এর সংঘাত তৈরি হতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। পাঞ্জাব এবং পশ্চিমবঙ্গ কেন্দ্রের এই নোটিসের কড়া সমালোচনা করে বলেছে, বিএসএফ-এর হাতে এতটা ক্ষমতা তুলে দেওয়ার অর্থ দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে অবজ্ঞা করা।
বুধবার কেন্দ্র যে গেজেট প্রকাশ করেছে, তাতে বলা হয়েছে, আসাম, পশ্চিমবঙ্গ, পাঞ্জাবের মতো রাজ্যগুলিতে সীমান্তে বিএসএফ-এর ক্ষমতা বাড়ানো হচ্ছে। এতদিন তারা সীমান্ত থেকে ১৫ কিলোমিটার অঞ্চলের মধ্যে নজরদারি চালাতো পারতো। গ্রেপ্তার বা তল্লাশি চালাতো পারতো। নতুন নিয়মে তারা সীমান্ত থেকে ৫০ কিলোমিটার অঞ্চল পর্যন্ত নজরদারি চালাতে পারবে। স্থানীয় পুলিশকে উপেক্ষা করে বিনা ওয়ারেন্টে তল্লাশি চালাতে এবং গ্রেপ্তার করতে পারবে। সীমান্তে চোরাচালান এবং অনুপ্রবেশ রুখতেই এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে কেন্দ্রের দাবি।
তবে দিল্লির এই সিদ্ধান্তে তাৎক্ষণিকভাবে রাজ্যগুলোর স্বায়ত্তশাসন নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী ইতিমধ্যে এর প্রতিবাদ জানিয়েছেন। অবিলম্বে এই সিদ্ধান্ত বাতিল করতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
নতুন এই সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গে ভারতের এক ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা জানান, ‘রাজনৈতিকভাবে খুবই স্পর্শকাতর একটি পদক্ষেপ। বিএসএফ এর প্রধান লক্ষ্য সীমান্ত পাহারা এবং অনুপ্রবেশ ঠেকানো। সাম্প্রতিক বেশকিছু ঘটনায় দেখা গেছে তারা লাইন পাহারা দিতে সক্ষম নয়।’
এছাড়া সীমান্তে পাচারের সাথে বিএসএফ যুক্ত, এমন অভিযোগ এর আগেও উঠেছে। কিছুদিন আগে বিএসএফের এক অফিসার পশ্চিমবঙ্গে ধরাও পড়েছেন। এ ছাড়াও সীমান্ত হত্যার অভিযোগও বারবার উঠেছে বিএসএফর বিরুদ্ধে। সীমান্ত হত্যার অভিযোগ বাংলাদেশ যেমন তুলেছে, তেমনই ভারতে সীমান্তে বসবাসকারী নাগরিকরাও তুলেছেন। বিএসএফের ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়ার ফলে এই বিতর্ক আরো বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে।
সমাজকর্মী কিরিটি রায় জানান, ‘সীমান্ত থেকে ৫০ কিলোমিটার ভেতরে ঢোকার অর্থ সম্পূর্ণ লোকালয়ে ঢুকে পড়া। সেখানে স্থানীয় পুলিশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করার কথা। বিএসএফ সেখানে ঢুকলে বিতর্ক বাড়বেই। বিএসএফের অত ভেতরে ঢুকে কাজ করার কথাও নয়। তাদের কাজ কেবলমাত্র সীমান্ত রক্ষা করা।
ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, নতুন গেজেটে বিএসএফ-কে যে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে তা অভূতপূর্ব। স্থানীয় পুলিশকে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে তারা অভিযান চালাতে পারবে। রাজ্য সরকারগুলোর প্রতি নরেন্দ্র মোদির সরকারের আস্থাহীনতার কারণেই এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে থাকতে পারে বলেও মত অনেকের। তারা বলছেন, সঙ্গতকারণেই এমন সিদ্ধান্তে কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে রাজ্য সরকারগুলোর বৈরিতা আরো বাড়বে।
পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী সরাসরি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে জানিয়েছেন, যত দ্রুত সম্ভব এই নোটিফিকেশন ফিরিয়ে নেয়া হোক। কারণ এই গেজেট ফেডারেল কাঠামোর বিরোধী। কেন্দ্রীয় সরকার বিএসএফ-কে ব্যবহার করে রাজ্যের ক্ষমতায় হস্তক্ষেপ করতে চাইছে।
পশ্চিমবঙ্গের মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম বলেন, কেন্দ্রীয় এজেন্সি রাজ্যের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার আরো এক উদাহরণ তৈরি করল কঠোর হিন্দুত্ববাদী গেরুয়া মোদি সরকার। আমরা এর বিরোধিতা করছি।
এসডব্লিউ/এসএস/১৬৫০
আপনার মতামত জানানঃ