ইসরায়েলের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আইলেদ সাকেদ বলেছেন, ফিলিস্তিন নামে কোনো রাষ্ট্রই হতে দেবো না আমরা। সম্প্রতি সংযুক্ত আরব আমিরাত সফরে গিয়ে এ মন্তব্য করেছেন ইহুদিবাদী দেশটির এ মন্ত্রী।
আমিরাতে অনুষ্ঠিত দুবাই এক্সপো-২০২০ এর অনুষ্ঠানে সোমবার দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ সাইফ বিন জায়েদ আল-নাহিয়ানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ইসরায়েলের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আইলেদ সাকেদ।
বুধবার সকালে তিনি ফিলিস্তিন নিয়ে তার সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি আমিরাত সরকারের কাছে তুলে ধরেন। এ সময় তিনি বলেন, ইসরায়েলের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের ঘোর বিরোধী।
বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেত এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইয়াইর ল্যাপিদ তাদের শাসনামলে কোনো ভাবেই ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠন করতে দেবেন না বলে ঘোষণা দিয়েছেন।
উল্লেখ্য, গত বছর আরব দেশগুলোর সমালোচনা উপেক্ষা করে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় ইহুদিবাদী দেশ ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে সংযুক্ত আরব আমিরাত।
ফিলিস্তিনিরা এ ঘটনাকে মুসলিম উম্মাহর সঙ্গে আমিরাতের বিশ্বাসঘাতকতা বলে উল্লেখ করে নিন্দা জানিয়েছেন।
প্রসঙ্গত, মধ্যপ্রাচ্যের ফিলিস্তিন নামের যে এলাকা, সেটি ছিল অটোমান সাম্রাজ্যের অধীন। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোমানদের পরাজয়ের পর ব্রিটেন ফিলিস্তিনের নিয়ন্ত্রণ নেয়। তখন ফিলিস্তিনে যারা থাকতো তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল আরব, সেই সঙ্গে কিছু ইহুদী, যারা ছিল সংখ্যালঘু।
কিন্তু এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে উত্তেজনা বাড়তে শুরু করলো যখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ব্রিটেনকে দায়িত্ব দিল ইহুদী জনগোষ্ঠীর জন্য ফিলিস্তিনে একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার।
ইহুদীরা এই অঞ্চলকে তাদের পূর্বপুরুষদের দেশ বলে দাবি করে। কিন্তু আরবরাও দাবি করে এই ভূমি তাদের এবং ইহুদীদের জন্য সেখানে রাষ্ট্র গঠনের চেষ্টার তারা বিরোধিতা করে।
উনিশশো বিশ থেকে ১৯৪০ দশকের মধ্যে ইউরোপ থেকে দলে দলে ইহুদীরা ফিলিস্তিনে যেতে শুরু করে এবং তাদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। ইউরোপে ইহুদী নিপীড়ন এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভয়ংকর ইহুদী নিধনযজ্ঞের পর সেখান থেকে পালিয়ে এরা নতুন এক মাতৃভূমি তৈরির স্বপ্ন দেখছিল।
ফিলিস্তিনে তখন ইহুদী আর আরবদের মধ্যে সহিংসতা শুরু হলো, একই সঙ্গে সহিংসতা বাড়ছিল ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধেও। উনিশশো সাতচল্লিশ সালে জাতিসংঘে এক ভোটাভুটিতে ফিলিস্তিনকে দুই টুকরো করে দুটি পৃথক ইহুদী এবং আরব রাষ্ট্র গঠনের কথা বলা হলো।
সেখানে জেরুজালেম থাকবে একটি আন্তর্জাতিক নগরী হিসেবে। ইহুদী নেতারা এই প্রস্তাব মেনে নেন, কিন্তু আরব নেতারা প্রত্যাখ্যান করেন। জাতিসংঘের এই পরিকল্পনা কখনোই বাস্তবায়িত হয়নি।
ব্রিটিশরা এই সমস্যার কোন সমাধান করতে ব্যর্থ হয়ে ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিন ছাড়ে। ইহুদী নেতারা এরপর ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়। বহু ফিলিস্তিনি এর প্রতিবাদ জানান এবং এরপর যুদ্ধ শুরু হয়। প্রতিবেশী আরব দেশগুলোর সৈন্যরাও যেখানে যায় যুদ্ধ করতে।
হাজার হাজার ফিলিস্তিনিকে তখন হয় তাদের ঘরবাড়ি ফেলে পালাতে হয় অথবা চলে যেতে বাধ্য করা হয়। ফিলিস্তিনিরা এই ঘটনাকে ‘আল নাকবা’ বা ‘মহা-বিপর্যয়’ বলে থাকে।
পরের বছর এক যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে যখন যুদ্ধ শেষ হলো, ততদিনে ইসরায়েল ফিলিস্তিনের বেশিরভাগ অঞ্চল দখল করে নিয়েছে। জর্ডান দখল করেছিল একটি অঞ্চল, যেটি এখন পশ্চিম তীর বলে পরিচিত। আর মিশর দখল করেছিল গাজা।
জেরুজালেম নগরী ভাগ হয়ে যায়, ইসরায়েলি বাহিনী দখল করে নগরীর পশ্চিম অংশ, আর জর্ডানের বাহিনী পূর্ব অংশ। দু’পক্ষের মধ্যে যেহেতু কখনোই কোন শান্তি চুক্তি হয়নি, তাই উভয় পক্ষই অপর পক্ষকে দোষারোপ করতে থাকে। দুই পক্ষের মধ্যে পরের দশকগুলোতে এরপর আরও বহু যুদ্ধ হয়েছে।
ইসরায়েল এখনো পশ্চিম তীর দখল করে আছে। গাজা থেকে তারা যদিও সৈন্য প্রত্যাহার করে নিয়েছে, জাতিসংঘের দৃষ্টিতে এটি এখনো ইসরায়েলের দখলে থাকা একটি এলাকা।
ইসরায়েল এখন পুরো জেরুজালেম নগরীকেই তাদের রাজধানী বলে দাবি করে। অন্যদিকে ফিলিস্তিনিরা পূর্ব জেরুজালেমকে তাদের ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে চায়। পুরো জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে কেবল যুক্তরাষ্ট্রসহ হাতে গোনা কয়েকটি দেশ।
গত ৫০ বছর ধরে ইসরায়েল এসব দখলীকৃত জায়গায় ইহুদী বসতি স্থাপন করে যাচ্ছে। ছয় লাখের বেশি ইহুদী এখন এসব এলাকায় থাকে।
পূর্ব জেরুজালেম, গাজা এবং পশ্চিম তীরে যে ফিলিস্তিনিরা থাকেন, তাদের সঙ্গে ইসরায়েলিদের উত্তেজনা প্রায়শই চরমে উঠে।
গাজা শাসন করে কট্টরপন্থী ফিলিস্তিনি দল হামাস। ইসরায়েলের সঙ্গে তাদের অনেকবার যুদ্ধ হয়েছে। গাজার সীমান্ত কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে ইসরায়েল এবং মিশর, যাতে হামাসের কাছে কোন অস্ত্র পৌঁছাতে না পারে।
গাজা এবং পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিরা বলছে, ইসরায়েলের নানা পদক্ষেপ এবং কঠোর বিধিনিষেধের কারণে তারা খুবই দুর্দশার মধ্যে আছে। অন্যদিকে ইসরায়েল দাবি করে যে, ফিলিস্তিনিদের সহিংসতা থেকে নিজেদের রক্ষার জন্য তাদের এই কাজ করতে হয়।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩০৭
আপনার মতামত জানানঃ