তালিবানের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ এনেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। দেশটির সংখ্যালঘু হাজারা সম্প্রদায়ের ওপর হত্যাযজ্ঞ ও নির্যাতন চালিয়েছে গোষ্ঠীটি। আফগানিস্তানের সংখ্যালঘু হাজারা সম্প্রদায়ের কমপক্ষে ১৩ সদস্যকে হত্যা করেছে দেশটির ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী তালিবান। নিহতদের মধ্যে ১৭ বছর বয়সী এক কিশোরীও রয়েছে। গত আগস্ট মাসে ক্ষমতা দখলে নেওয়ার অল্পসময় পরই দেশটির মধ্যাঞ্চলীয় প্রদেশ দেইকুন্ডিতে এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।
সম্প্রতি প্রকাশিত নতুন একটি প্রতিবেদনে এই তথ্য সামনে এনেছে লন্ডনভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। মঙ্গলবার (৫ অক্টোবর) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা।
আফগানিস্তানে তৃতীয় বৃহত্তম ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী হলো হাজারা। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, মঙ্গোলিয়ান শাসক চেঙ্গিস খানের উত্তরসূরি হলো এই হাজারা সম্প্রদায়। ১৩ শতাব্দীতে চেঙ্গিস খান ও তার বাহিনী আফগানিস্তানে আক্রমণ করে। হাজারারা মূলত শিয়া মুসলিম। আফগানিস্তান ও প্রতিবেশি পাকিস্তানে দীর্ঘদিন ধরেই তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ সুন্নি মুসলিমদের হাতে বৈষম্য ও নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন।
মঙ্গলবার প্রকাশিত নতুন এক প্রতিবেদনে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার এই সংস্থাটি জানিয়েছে, গত ৩০ আগস্ট আফগানিস্তানের খিদর জেলায় প্রবেশ করে ৩০০ তালিবান যোদ্ধা। এসময় তারা আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর (এএনএসএফ) কমপক্ষে ১১ জন সদস্যকে হত্যা করে। এদের ৯ জন নিহত হওয়ার আগে তালিবানের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। কিন্তু আত্মসমর্পণের পরও তাদেরকে পার্শ্ববর্তী একটি নদীর তীরে নিয়ে হত্যা করা হয়।
আলজাজিরা জানিয়েছে, সেদিনের সেই হত্যাকাণ্ডের সময় আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর সাবেক কয়েকজন সদস্য প্রাণে বাঁচতে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে তালিবান যোদ্ধারা তাদেরকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। এতে মাসুমা নামে ১৭ বছর বয়সী এক কিশোরী নিহত হন। এছাড়া তালিবানের ক্রসফায়ারে সেদিন ফয়েজ নামে আরও এক বেসামরিক ব্যক্তি নিহত হয়েছিলেন। বয়সে বিশের কোঠায় থাকা ফয়েজ মাত্র কিছুদিন আগে বিয়ে করেছিলেন।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলছে, তালিবানের হাতে নিহত আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর সাবেক ওই সদস্যদের বয়স ২৬ থেকে ৪৬ বছরের মধ্যে। তারা সবাই দেশটির সংখ্যালঘু হাজারা সম্প্রদায়ের মানুষ। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তালিবানের প্রথম শাসনামলেও হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন হাজারা জনগোষ্ঠীর সবাই।
আফগানিস্তানের সংখ্যালঘু হাজারা সম্প্রদায়ের কমপক্ষে ১৩ সদস্যকে হত্যা করেছে দেশটির ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী তালিবান। নিহতদের মধ্যে ১৭ বছর বয়সী এক কিশোরীও রয়েছে। গত আগস্ট মাসে ক্ষমতা দখলে নেওয়ার অল্পসময় পরই দেশটির মধ্যাঞ্চলীয় প্রদেশ দেইকুন্ডিতে এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।
তবে চলতি বছর হাজারাদের ওপর তালিবানের চালানো হত্যাকাণ্ড এটিই প্রথম নয়। গত ১৯ আগস্ট প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জানায়, আফগানিস্তান দখলে নেওয়ার আগে গত জুলাই মাসে দেশটির গজনি প্রদেশে হাজারা সম্প্রদায়ের ৯ ব্যক্তিকে হত্যা করে তালিবান।
তবে হাজারাদের বিরুদ্ধে চালানো সর্বশেষ ওই হত্যাকাণ্ডের কথা গত সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দিনেই অস্বীকার করে তালিবান। দেইকুন্ডি প্রদেশে তালিবানের নিযুক্ত নতুন পুলিশ প্রধান শফিকুল্লাহ আবেদ সেদিন দাবি করেছিলেন যে, বিরোধী বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে তাদের কেবল এক জন যোদ্ধা আহত হয়েছেন।
তবে আলজাজিরার কাছে তালিবানের ওই হত্যাকাণ্ডের তথ্য নিশ্চিত করেছেন দেইকুন্ডি প্রদেশের আইনসভার সাবেক সদস্য রাইহানা আজাদ। আগস্টের ৩০ তারিখে সেখানে তালিবান যোদ্ধাদের চালানো ওই হত্যাকাণ্ডকে তিনি ‘অমানবিক’ বলেও আখ্যায়িত করেন।
কাবুল দখলে নেওয়ার পর তালিবান প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, বিদেশি বাহিনীর হয়ে কাজ করা কোনো আফগান নাগরিকের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক আক্রমণ চালাবে না তারা। শরিয়া আইনে মেনে নারীদের অধিকার সমুন্নত রাখারও কথা দিয়েছে তারা। তবে হাজারা সম্প্রদায়ের ওপর চালানো হত্যাযজ্ঞের বিষয়ে তালিবানের পক্ষ থেকে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
আফগানিস্তানের ২০ শতাংশ মানুষ হাজারা সম্প্রদায়ের। হাজারারা চেঙ্গিস খানের বংশধর হিসেবে পরিচিত। দিনের পর দিন এ সম্প্রদায়ের মানুষ পশতুনদের কাছে বঞ্চনা ও নিগৃহের শিকার হচ্ছে।
আফগানিস্তানের প্রতাপশালী পশতুন জনগণ হাজারাদের কখনো তাদের সমতুল্য মনে করতে পারেনি। হাজারারা শিয়া। পশতুনরা সুন্নি। ধর্মকেন্দ্রীক এ মতভেদ এবং হাজারাদের নিজস্ব জীবন ব্যবস্থার কারণে কখনো আফগানিস্তানের ক্ষমতার কেন্দ্রে আসতে পারেনি সংখ্যালঘু হাজারা সম্প্রদায়।
হাজারাদের নিগৃহীত হওয়ার ইতিহাস আরো দীর্ঘ।আফগানিস্তানের মধ্যাঞ্চলে রয়েছে বামিয়ান প্রদেশ। এ প্রদেশে হাজারাদের বসবাস। দিন যায় দিন আসে, সরকার বদলায়, শাসক বদলায় কিন্তু হাজারাদের জীবনযাত্রার তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি, লাগেনি আধুনিকতার ছোঁয়া। বামিয়ানের অধিকাংশ এলাকায় এখনো বিদ্যুৎ নেই। শিল্পায়ন নেই বললেই চলে।
হাজারারা নিজেদেরকে মোঙ্গল সম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা চেঙ্গিস খানের বংশধর বলে দাবি করে থাকে। মোঙ্গল সৈন্যরা খ্রিষ্টীয় ১৩ শতকে আফগানিস্তানে ছড়িয়ে পড়ে। দৈহিক গড়নে ভিন্নতা এবং ফারসি ভাষায় কথা বলার কারণে আফগানিস্তানের পশতুভাষীদের চেয়ে সহজে আলাদা করা যায় তাদের।
পশতুভাষীরা বলে থাকে, হাজারারা আফগানিস্তানের বাইরে থেকে এসেছে। ফলে এ দেশে তাদের কোনো অধিকার নেই।
হাজারাদের ওপর সবচেয়ে বড় আঘাত আসে ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দের প্রথম দশকে। পশতুন রাজা আমির আবদুল রহমান খান মধ্য-আফগানিস্তানের শিয়াদের হত্যার হুকুম দেন। নৃবিজ্ঞানী থমাস বারফিল্ডের মতে, সে সময় কয়েক হাজার হাজারাকে হত্যা করা হয়। ১৯ শতকে হাজারাদের দাস হিসেবে বিক্রি করা হতো।
রাজা রহমান খানের নির্দেশিত হত্যা মিশনের পরও মধ্য-আফগানিস্তানের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বেঁচে ছিল হাজারা সম্প্রদায়ের একাংশ। কিন্তু তারা শুধু বেঁচেই ছিল, রাষ্ট্রেযন্ত্রে কোনো অধিকার ছিল না তাদের। ২০০৪ সালে নাগরিক হিসেবে সাংবিধানিক অধিকার পেলেও এখনো পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় এবং সরকারের ঊর্ধ্বতন পদে হাজারাদের উপস্থিতি আনুপাতিক হারে কম।
আফগানিস্তানে কর্মরত বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘আফগানিস্তান এনালিস্ট নেটওয়ার্ক’-এর উপ-পরিচালক থমাস রুটিং বলেছেন, আফগান যুদ্ধের আগে পশতুন ও অন্যদের দ্বারা হাজারারা সুকৌশলে বৈষম্যের শিকার হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত জঙ্গিপ্রবণ আফগানিস্তানে হাজারারা নিষ্পেষিত— এ কথা প্রমাণ দিয়ে বলা যাচ্ছে। সেই সঙ্গে এমন আশঙ্কাও তৈরি হচ্ছে যে, আফগানিস্তানে আসলে কারা সুরক্ষিত? কেউ নয়। জোর দিয়ে বলা যায়, যত দিন ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে মানুষ হত্যা বন্ধ না হবে, ততদিন শান্তি ফিরবে না আফগান মুল্লুকে। আর ততদিন শান্তিতে ঘুমাতে পারবে না হাজারারা। ফলে শান্তির জন্য আফগানিস্তানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু বহু বিভক্ত আফগানিস্তানে সেই সম্প্রীতি কবে হবে, তা সময়ই বলে দেবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩২২
আপনার মতামত জানানঃ