কানাডার এক হাসপাতালে চিকিৎসাকর্মীদের বর্ণবাদী মানসিকতার বলি হলেন দেশটির আদিবাসী রক নারী। এরপর মন্ট্রিলে আদিবাসী নারী জয়েস ইচাকুয়ানের মৃৃত্যুতে বিক্ষোভ করা হয়।
সূত্র মতে, কানাডার কুইবেক অঙ্গরাজ্যে হাসপাতালে আদিবাসী ওই নারীর মৃত্যু হয়েছে। তার মৃত্যুতে বর্ণবাদ ও কুসংস্কার ভূমিকা রাখে বলে প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। স্থানীয় সময় গতকাল শুক্রবার ওই প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় বলে আল জাজিরার প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।
ইচাকুয়ানের মৃত্যুর পর তার পার্টনার ক্যারল দিউব সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘আমি নিশ্চিত, জলিয়েট হাসপাতালের কাঠামোগত বর্ণবাদী আচরণ ইচাকুয়ানের মৃত্যুতে দায়ী।’
মৃত ৩৭ বছর বয়সী জয়েস ইচাকুয়ান সাত সন্তানের মা। কানাডার আদিবাসী আতিকামেক সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন তিনি। প্রতিবেদনে বলা হয়, পালমোনারি ইডিমায় (ফুসফুসে অতিরিক্ত পানি) ভুগে ইচাকুয়ানের মৃত্যু হয়েছে।
মৃত্যুর আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি ভিডিও পোস্ট করেন ইচাকুয়ান। ওই পোস্টে দেখা যায়, চিকিৎসা সহায়তা চাওয়ায় হাসপাতালের কর্মকর্তারা তাকে গালাগাল ও অপমান করছেন।
ভিডিওটি ভাইরাল হওয়ার পর আদিবাসীদের ওপর চলমান দুর্ব্যবহার ও নির্যাতন বন্ধের দাবিতে কানাডাজুড়ে প্রতিবাদ হয়। একই সঙ্গে ‘কাঠামোগত বর্ণবাদ’ চিহ্নিত করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এর চর্চা বন্ধে কুইবেক সরকারের প্রতি আহ্বান জানায় হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘ইচাকুয়ান নিশ্চিতভাবে বর্ণবাদ ও সংস্কারের শিকার হন। চিকিৎসা সহায়তা চাওয়ার একপর্যায়ে দ্রুত ইচাকুয়ানকে মাদকাসক্ত তকমা দেয় ওই হাসপাতাল। এ ধরনের কুসংস্কারের কারণে ইচাকুয়ানের সহায়তার আবেদন দুর্ভাগ্যজনকভাবে গুরুত্বের সঙ্গে নেয়নি হাসপাতালের কর্মকর্তারা।
জানা যায়, কুইবেকের মন্ট্রিল শহরের জলিয়েট হাসপাতালে পেটের ব্যথার চিকিৎসা চেয়েছিলেন ইচাকুয়ান।
কানাডায় আদিবাসীদের উপর নির্যাতন নিপীড়নের ঘটনা নতুন নয়। দেশটির ইতিহাসের সুদীর্ঘ এক অন্ধকার অধ্যায় জুড়েই আছে আদিবাসীদের হাহাকার। সাম্প্রতিক সময়ে দেশটির সাসকাটচেওয়ানে সাবেক এক আবাসিক স্কুলের জমিতে ৭৫১টি বেওয়ারিশ কবর পাওয়া যায়।
দেশটিতে আদিবাসীদের একটি সংগঠন কাউয়েসেস ফার্স্ট নেশন এই কবরগুলো খুঁজে পায় এবং জানান, কানাডায় এত বিশাল সংখ্যক অচিহ্ণিত কবর পাওয়ার এই ঘটনা বিরল।
এর পর একইধরনের একটি বোর্ডিং স্কুলের প্রাঙ্গণে আবারও ২১৫টি মৃত শিশুর হাড়গোড় খুঁজে পাওয়া যায়। সূত্র মতে, এটি গণ কবরস্থান নয়। এগুলো সব অচিহ্ণিত কবর।
সূত্র মতে, ওই এলাকায় মারিভেল ইন্ডিয়ান রেসিডেনশিয়াল স্কুল নামের আবাসিক শিক্ষায়তনটি ১৮৯৯ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত পরিচালনা করত রোমান ক্যাথলিক গির্জা।
সাসকাটচেওয়ানের এই এলাকাতেই এখন কাউয়েসেস ফার্স্ট নেশন সংস্থার দপ্তর। তবে যে ২১৫টি শিশুর দেহাবশেষ সেখানে খুঁজে পাওয়া গেছে তারা সবাই সেই স্কুলের শিক্ষার্থী ছিল কিনা তা এখনও স্পষ্ট জানা যায়নি।
কানাডায় ১৩০টির বেশি বাধ্যতামূলক আবাসিক স্কুল আছে, যেগুলোর অর্থায়ন করে দেশটির সরকার। দেশটির আদিবাসী সম্প্রদায়ের শিশুদের সভ্য করে তুলে কানাডার মূলধারার সাথে সম্পৃক্ত করার লক্ষ্য নিয়ে উনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দী ধরে এই স্কুলগুলো পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয় ধর্মীয় কর্তৃপক্ষের ওপর।
এসব স্কুলে পড়ালেখা করার সময় মারা যায় আনুমানিক ছয় হাজার শিশু। মূলত স্কুলের ভেতর খুবই অস্বাস্থ্যকর নোংরা পরিবেশে বাস করার কারণেই এই মৃত্যু হয়। শিক্ষার্থীদের প্রায়শই রাখা হতো এমন সব ভবনে যা খুবই নিম্নমানের, সেখানে ঘর গরম রাখার তেমন ব্যবস্থা ছিল না এবং ছিল না শৌচকাজের জন্যও ব্যবস্থা।
এছাড়া দেশটিতে ধর্মীয়বিদ্বেষও চরমে। চলতি বছরের জুন মাসে কানাডার লন্ডন শহরে বর্ণবাদী এক চালক গাড়িচাপা দিয়ে হত্যা করা পাকিস্তান বংশোদ্ভূত মুসলিম পরিবারের চার সদস্যকে।
দক্ষিণ-পশ্চিম অন্টারিওর ইসলামিক সেন্টারের মাঠে গাড়ি হামলায় নিহত হন সৈয়দ আফজাল (৪৬), তার ৭৪ বছর বয়সি বৃদ্ধ মা, সৈয়দ আফজালের স্ত্রী মাদিহা সালমা (৪৪) এবং তাদের মেয়ে ইয়ুমনাহ আফজালের (১৫)।
হত্যাকাণ্ডের পর পালিয়ে যাওয়ার সময় ঘটনাস্থল থেকে সাত কিলোমিটার দূরে তাকে আটক করে পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদের পর তাকে আদালতের মাধ্যমে জেলে প্রেরণ করা হয়। গ্রেফতারের পর পুলিশের কাছে চালক স্বীকার করেন, মুসলিম বলেই তাদের তিনি ইচ্ছে করে গাড়িচাপা দিয়ে হত্যা করেছেন।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৬১৪
আপনার মতামত জানানঃ