কিছুতেই ছন্দে ফিরছে না আবহাওয়া। এই রোদ এই বৃষ্টি। খেয়ালি আবহাওয়ার সঙ্গে ঋতু ফাঁদে বাড়ছে সর্দি-কাশির সঙ্গে জ্বরের মতো মৌসুমি রোগ। ঘরে-বাইরে অনেকেই খুকখুক করে কাশছে। কেউবা নাক টানছে। দিনের তাপমাত্রা বাড়ছে-কমছে। কিন্তু গভীর রাত কিংবা ভোরে ঠান্ডা বাড়ছে। সাধারণত সন্ধ্যার পর থেকে গরম-গরম ভাব দেখে অনেকেই ঘরে ফ্যান বা এসি চালিয়ে রাখছেন। রাতে ঘুমানোর সময়েও তা বন্ধ করা হয় না। ফলে গভীর রাত থেকে ভোর পর্যন্ত তাপমাত্রা আরও কমলে চট করে সর্দি-কাশিতে আক্রান্ত হচ্ছেন সব বয়সি। অনেকে ঠান্ডা পানি কিংবা ফ্রিজে রাখা কোমল পানীয় খেয়েও সর্দিজ্বর ডেকে আনছেন। আর এসবে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা— বিশেষ করে খুলনায় ঠান্ডাজনিত শিশু রোগী বাড়ছে আশঙ্কাজনকভাবে।
বাগেরহাটের সরকারি হাসপাতালগুলোতে আশঙ্কাজনকহারে বাড়ছে নিউমোনিয়াসহ ঠাণ্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা। শুধু সরকারি হাসপাতালে গত এক মাসে ১০ হাজারের অধিক শিশু নিউমোনিয়াসহ ঠাণ্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছে। গত কয়েকদিনে বাগেরহাট সদর হাসপাতালসহ উপজেলা হাসপাতালে শিশু ওয়ার্ডের ধারণ ক্ষমতার তিন থেকে চারগুণ রোগী ভর্তি হচ্ছে।
শিশু ওয়ার্ডে শয্যা সঙ্কটের কারণে হাসপাতালের মেঝে ও বারান্দায় চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। জেলার ৯টি উপজেলায় গত ১৫ আগস্ট থেকে নিউমোনিয়া আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ায় সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছে স্বাস্থ্য বিভাগ। জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে, এসব শিশুর অর্ধেকই নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত।
হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডের দায়িত্বরত একাধিক নার্স জানায়, রোগীদের চাপ অনেক বেশি। মেঝে ও বারান্দায়ও চিকিৎসা নিচ্ছেন অনেকে। কষ্ট হলেও আমরা তাদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা দিচ্ছি। রোগীর পাশাপাশি তাদের স্বজনদের চাপও বেশি।
বাগেরহাট সদর হাসপাতাল শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. শিহান মাহমুদ জানান, বাগেরহাট সদর হাসপাতালে শিশু ওয়ার্ডে বেডের সংখ্যা ২৪টি। গত ১৫ আগস্ট থেকে নিউমোনিয়া আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা অস্বাভাবিকহারে বেড়ে যাওয়ায় সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছি।
বাগেরহাটের ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন ডা. মো. হাবিবুর রহমান জানান, গত একমাসে শুধু বাগেরহাট সদর হাসপাতালে সাড়ে ৪ হাজার শিশু নিউমোনিয়াসহ ঠাণ্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছে। আর এ সময়ে জেলা ও উপজেলা হাসপাতালে ১০ হাজারের বেশি শিশুকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। অভিভাবকদের আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন হওয়ার পাশাপাশি নিউমোনিয়াসহ ঠাণ্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত শিশুদের দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে আসার পরামর্শ দেন জেলার এই শীর্ষ স্বাস্থ্য কর্মকর্তা।
খুলনা শিশু হাসপাতালেও একই চিত্র। ওই হাসপাতালে থাকা ২৭৫টি শয্যার সব কটিই পরিপূর্ণ। বহির্বিভাগের চাপ এতটাই বেশি যে সকাল ৯টার দিকে সিরিয়াল দিয়েও দুপুর সাড়ে ১২টায় বাচ্চাকে দেখাতে পারেননি অভিভাবকেরা। বহির্বিভাগে যেখানে রোগী দেখা হচ্ছে, সেখানে চলাফেরার মতো কোনো অবস্থা নেই। মানুষের ভিড়। বেলা ১টার দিকে বৈরী আবহাওয়া উপেক্ষা করেও বাচ্চাকে নিয়ে আসছেন অভিভাবকেরা।
বহির্বিভাগের দ্বিতীয় তলায় ১৮ মাসের বাচ্চাকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে এসেছিলেন সোহেল রানা চৌধুরী। খুলনা নগরের দৌলতপুর থাকেন তারা। সোহেল রানা বলেন, তিন দিন আগে বাচ্চার জ্বর হয়। স্থানীয় এক চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ খাওয়ানো হয়েছে, কিন্তু জ্বর কমছে না। বাচ্চার অন্য কোনো সমস্যা হলো কি না, তা নিশ্চিত হতে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে এসেছেন।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ১ থেকে ১৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ওই হাসপাতালের বহির্বিভাগে ৭ হাজার ৪৪৭ জন রোগী চিকিৎসা নিয়েছে। ওই হিসেবে গড়ে প্রতিদিন সেখানে সেবা নিয়েছে ৫৩২ জন। আর ভর্তি থেকে সেবা নিয়েছে ৫১১ জন।
খুলনা শিশু হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক চিকিৎসক মো. কামরুজ্জামান বলেন, রোগীর চাপ অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে এমনটা হচ্ছে। এ সময় অভিভাবকদের বেশি সতর্ক থাকতে হবে। বাচ্চাদের প্রচুর তরল ও ভিটামিন সি–জাতীয় খাবার দিতে হবে। বাচ্চা ঘেমে গেলে জামাকাপড় পরিবর্তন ও ঘাম মুছে দিতে হবে।
জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ জানায়, মূলত ভাদ্র মাসের গুমোট গরম, হঠাৎ বৃষ্টিসহ আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে উপকূলীয় জেলা বাগেরহাট সদরসহ ৯টি উপজেলায় নিউমোনিয়াসহ ঠাণ্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা। প্রতিবছর আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে শিশুরা নিউমোনিয়াসহ ঠাণ্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত হলেও হঠাৎ গত ১৫ আগস্ট থেকে জেলাজুড়ে এ রোগে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা বাড়তে থাকে। এখন প্রতিদিন নিউমোনিয়াসহ ঠাণ্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত শিশুদের নিয়ে বাগেরহাট সদর হাসপাতালসহ জেলার উপজেলা হাসপাতাল ও বেসরকারি ক্লিনিকগুলোতে ছুটে আসছেন অভিভাবকরা।
জ্বর-সর্দি-কাশির তীব্রতা থাকছে চার থেকে ১০ দিন। জ্বর সেরে গেলেও শুকনো কাশি, দুর্বলতা ভোগাচ্ছে অনেককে। অন্যান্য ইনফ্লুয়েঞ্জার মতোই এ ক্ষেত্রেও একসঙ্গে পরিবারের একাধিক সদস্য জ্বর-সর্দি-কাশিতে ভুগছেন। অনেকের গলাব্যথাও হচ্ছে। তাই রোগটি না কমা পর্যন্ত নিজেকে আলাদা করে অন্তত ৬ ফুট দূরত্ব বজায় রাখার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা। একই সঙ্গে ঘরে ও বাইরে অবশ্যই মাস্ক পরার ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করেন তারা।
জ্বর-সর্দি-কাশির তীব্রতা থাকছে চার থেকে ১০ দিন। জ্বর সেরে গেলেও শুকনো কাশি, দুর্বলতা ভোগাচ্ছে অনেককে। অন্যান্য ইনফ্লুয়েঞ্জার মতোই এ ক্ষেত্রেও একসঙ্গে পরিবারের একাধিক সদস্য জ্বর-সর্দি-কাশিতে ভুগছেন। অনেকের গলাব্যথাও হচ্ছে। তাই রোগটি না কমা পর্যন্ত নিজেকে আলাদা করে অন্তত ৬ ফুট দূরত্ব বজায় রাখার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা। একই সঙ্গে ঘরে ও বাইরে অবশ্যই মাস্ক পরার ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করেন তারা।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের নবজাতক ইউনিটের সাবেক বিভাগীয় প্রধান শিশুবিশেষজ্ঞ প্রফেসর ডা. আবিদ হোসেন মোল্লা জাতীয় এক দৈনিককে জানান, শিশুদের জ্বর-কাশি, হাঁচি-সর্দি বেশি হচ্ছে। তবে সব বয়সির মধ্যেই এ উপসর্গগুলো দেখা যাচ্ছে। এ ধরনের উপসর্গ নিয়ে আসা অনেক শিশুর ডেঙ্গু শনাক্ত হচ্ছে। এছাড়া অনেক রোগী ভাইরাল ইনফ্লুয়েঞ্জা নিয়ে আসছেন। এ ধরনের ইনফ্লুয়েঞ্জারও মহামারি ঘটানোর ক্ষমতা রাখে।
তিনি বলেন, লক্ষণগুলো দেখা দিলেই দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। বাসায় পর্যাপ্ত তরল খাবার নিশ্চিত করতে হবে। রোগী দুর্বল হলে পরিস্থিতি কঠিন হয়ে উঠতে পারে। এক-দুদিন হলেই পরীক্ষার ব্যবস্থা করা উচিত। তবে ভাইরাল ইনফ্লুয়েঞ্জা বর্ষায় বাড়ে, একই সঙ্গে ঋতু পরিবর্তনের কারণেও এমনটা হয়। এটা নিয়ে ভয়ের তেমন কোনো কারণ নেই।
ডা. আবিদ হোসেন মোল্লা বলেন, এ সময়ে বিশেষ করে শূন্য থেকে দেড়-দুই বছর বয়সি শিশুদের মধ্যে উপসর্গগুলো বেশি দেখা দিচ্ছে। তবে যেসব শিশু মায়ের দুধ খায় তাদের খুব বেশি কাবু করতে পারে না।
তিনি বলেন, অনেক শিশু চার-পাঁচ দিনের মধ্যে সুস্থ হয়ে ওঠে। তবে মনে রাখতে হবে, উপসর্গগুলো থাকলেও অনেক শিশু প্রাণচাঞ্চল্য থাকে। কিন্তু নাক দিয়ে পাতলা সর্দি পড়ে। বুকের ভেতর এক ধরনের আওয়াজ হয়। অক্সিজেন কমে যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। অক্সিজেন কমে গেলে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে। অভিভাবকদের ভয় পাওয়ার কারণ নেই। তিনি বলেন, শিশুর প্রতি যত্ন নিতে হবে, অবহেলা নয়। শিশুকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
চিকিৎসকরা জানান, গলাব্যথা, খুসখুস ভাব, নাক বন্ধ বা অনবরত হাঁচি, মাথাব্যথা, মাংসপেশিতে ব্যথা, শরীর ম্যাজম্যাজ, দুর্বল লাগা ও ক্ষুধামন্দা দেখা দিলে চিকিৎসা করাতে হবে। উপসর্গে সাইনাস, টনসিলে প্রদাহ হতে পারে। সতেজ ও পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ এবং পর্যাপ্ত পানি পানের পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা। একই সঙ্গে আদা-লং-এলাচ-লেবু চা, তুলসী পাতা, মধু ও লেবুর রসসহ দেশীয় ফলের রস পান করার জন্যও বলা হয়েছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪১৪
আপনার মতামত জানানঃ