ইংরেজিতে প্রচলিত একটি প্রবাদ আছে ‘Dead Men tell no tale’। অর্থাৎ মৃতব্যক্তি কোনো গল্প বলে না। তবে এই প্রবাদ যে ভিত্তিহীন তা আমাদের আরও একবার স্মরণ করিয়ে দেয় ‘তারিম মমি’; মুহূর্তেই চীনের এক অজানা ইতিহাসের সামনে নিয়ে দাঁড় করায় প্রায় চার হাজার বছর পুরনো এই মমিগুলো। তবে জানার এখনও শেষ হয়নি। গবেষণা চলছে। অদূর ভবিষ্যতে এই মমিগুলো আরো অজানা তথ্য প্রকাশের মাধ্যমে আমাদের রোমাঞ্চিত করবে, সে ব্যাপারে কারো দ্বিধা নেই।
১৯৭৮ সালের ঘটনা। চীনের ঝিংঝিয়াং অঞ্চলে অবস্থিত তারিম অববাহিকায় প্রত্নতত্ত্বের সন্ধানে অভিযান পরিচালনা করেন চীনা গবেষক ওয়াং বিংঘুয়া। সেই অভিযানে ঘটনাক্রমে তিনি মাটিতে উল্টানো একটি নৌকা আবিষ্কার করেন। কৌতূহলী বিংঘুয়া নৌকা ফের সোজা করতেই বেরিয়ে আসে কয়েকটি লাশ। নৌকাটি মূলত একটি ‘সমাধিক্ষেত্র’ ছিল। আশ্চর্য ব্যাপার হলো, লাশগুলো ছিল প্রায় অক্ষত।
তিনি তার এই অনুসন্ধানের কথা কর্তৃপক্ষকে জানান। এরপর আশেপাশের এলাকায় অভিযানের মাধ্যমে প্রায় ১০০টি লাশ উদ্ধার করা হয়। ইতিহাসবিদদের কাছে লাশগুলো ‘তারিম মমি’ নামে পরিচিতি লাভ করে। চীনের ঝিংঝিয়াং প্রদেশে আবিষ্কৃত তারিম মমিগুলো প্রায় ৪ হাজার বছর পুরাতন।
সিল্ক রোডের পাশে অবস্থিত শিংজিয়ান প্রদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এসব মমি ও বিভিন্ন নিদর্শন পাওয়া যায়। একটা সময় এখানকার সিল্ক রোডই পূর্ব ও পশ্চিমের সংস্কৃতি, সভ্যতা ও ভাষা বিনিময়ের মাধ্যম হয়ে উঠেছিল; যা অতিক্রম করেছে শিংজিয়ান প্রদেশের বুক চিরে।
শিংজিয়ান চীনের অন্যতম বড় একটি অঞ্চল। এর আয়তন ১৬ লাখ ৪৬ হাজার ৪০০ বর্গ কিলোমিটার (যা বাংলাদেশের আয়তনের ১২ গুণ)। দেশটির উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত এ এলাকা আয়তনে চীনের প্রায় এক-ষষ্ঠাংশ। এর পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিম দিকে আছে মুসলিম দেশ তাজিকিস্তান, কিরগিজস্তান ও কাজাখস্তান; আর দক্ষিণ-পশ্চিমে আছে আফগানিস্তান ও জম্মু-কাশ্মীর।
বর্তমান চীন সরকার এ অঞ্চলে বিশাল কর্মযজ্ঞ শুরু করেছে। বিশেষ করে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ওয়ান বেল্ড ওয়ান রোড ঘোষণার পর থেকেই এ অঞ্চলের গুরুত্ব বেড়ে গেছে। তবে হাজার বছর আগেই এ এলাকায় বিশাল সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। উদ্ধার করা মমিগুলো যার প্রমাণ।
তবে প্রশ্ন এতদিন ধরে লাশগুলো অক্ষত থাকল কীভাবে! যদিও এগুলো প্রাচীন মিশরের মমি বানিয়ে সংরক্ষণ করার মতো করে রাখা হয়নি। তারপরও মমির দেহ অক্ষত থাকল বছরের পর বছর। কিন্তু এদের দেহ মিশরীয় মমির মতো ব্যান্ডেজে মোড়ানো ছিল না। এ লাশগুলো ছিল প্রাকৃতিক মমি।
পরে গবেষণার মাধ্যমে জানা যায়, শুষ্ক আবহাওয়ার কারণেই মমিগুলো হাজার বছর ধরে অক্ষত ছিল। বিশেষ করে তারিম অববাহিকায় অবস্থিত তাকলামাকান মরুভূমির আবহাওয়া অত্যন্ত শুষ্ক। আবহাওয়ার শুষ্কতার কারণে লাশগুলোর দেহ পচন থেকে রক্ষা পায়।
তবে গবেষকদের মতে, লাশগুলো দেখতে স্থানীয় চীনাদের মতো না। এমনকি শিংজিয়ান বা এ অঞ্চলের মানুষের মতোও না। এশিয়ার কোনো জাতির সঙ্গেও এদের কোনো মিল পাওয়া যায়নি। অক্ষত লাশগুলোর অনেকেরই চুল ছিল পশ্চিমাদের মতো সোনালী। চোখের মণি ইউরোপীয়দের মতো নীল। পরনের পোশাকও পশ্চিমাদের মতো। তাই গবেষকরা ধারণা করছেন, লাশগুলো ইউরোপীয় পর্যটকদের। যারা সিল্ক রোড ধরে এ অঞ্চলে এসেছিলেন।
বেইজিং বিশ্ববিদ্যালয়ে মমিগুলোর কার্বন ডেটিং টেস্ট করে জানা যায়, সেগুলো প্রায় তিন হাজার ৯৮০ বছরের পুরনো।
বেশ কয়েকটি মমির মাথায় এক ধরনের টুপি ছিল। যেগুলো দেখতে অনেকটা প্রাচীন টাইরোলিয়ান টুপির মতো। লাশের কফিনের ভেতর বেশ কিছু গুল্ম পাওয়া যায়। গুল্মগুলো প্রাচীনকালে ইউরোপে শেষকৃত্যে মঙ্গলের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হতো। আর নৌকার মাধ্যমে সমাধিস্থ করার রীতি ভাইকিংদের মধ্যে প্রচলিত ছিল।
মমি প্রাপ্তিস্থানের আশেপাশে কোনো বসতির সন্ধান পাওয়া যায়নি। এ থেকে বোঝা যায় এরা নৌকায় করে এই অঞ্চল দিয়ে ভ্রমণ করছিলেন। এক্ষেত্রে জানিয়ে রাখা ভালো, এই অববাহিকায় প্রাচীনকালে একটি ছোট নদী প্রবাহিত হতো। কিন্তু চার হাজার বছর পূর্বে যখন মমিগুলো জীবিত ছিল, তখন সেই নদীর অবস্থা মৃতপ্রায় ছিল।
সমাধিস্থলে তোখারিয়ান ভাষায় রচিত কিছু পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায়। প্রাচীন চীনে তোখারিয়ান ভাষার প্রচলন থাকলেও ইউরোপের বেশ কিছু অঞ্চলের এর ব্যবহারের কথা জানা যায়। এছাড়াও মমিগুলো ককেশীয় ছিল বলে তিনি মনে করেন। মেয়ারের মতে, তাদের মাতৃভাষা ছিল ইন্দো-ইউরোপীয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সিল্ক রোডের পাশের ওই জনবসতি পূর্ব ও পশ্চিমের বণিকদের সম্মিলন স্থান হয়ে উঠেছিল বলে মনে করা হয়। এশিয়া ও ইউরোপের যোগাযোগের ওই পথে বিভিন্ন সময়ে ইউরোপীয়, সাইবেরীয়, মঙ্গোলীয় ও চীনা হান সাম্রাজ্যের বণিকরা যাতায়াত করেছে। চার হাজার বছর আগেও যে বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন গোত্রের মানুষ তাদের ব্যবসা ও সাংস্কৃতিকচর্চা প্রসারে দূরদূরান্তে যাতায়াত করেছে তার জীবন্ত প্রমাণ শিংজিয়াঙের ওই মমিগুলো।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৯২২
আপনার মতামত জানানঃ