করোনার ক্ষতি যে শুধু ফুসফুসে সীমাবদ্ধ নয় তা অনেক আগেই টের পেয়েছিলেন চিকিৎসকরা। সম্প্রতি কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হবার বিষয়েও জানতে পেরেছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে সেটা কতটা বিস্তৃত ও জটিল হতে পারে তা নিয়ে সংশয় ছিল। এবার নতুন আরও একটি শঙ্কার কথা জানিয়েছেন ভারতীয় চিকিৎসকরা।
তারা বলছেন, করোনা মহামারির মধ্যে চোখে কনজাঙ্কটিভাইটিসের মতো রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যাচ্ছে। কিন্তু করোনার ফলে অন্ধত্বের প্রকোপও বাড়ছে কি না তা এখনও স্পষ্ট নয়।
বিষয়টি জানতে এরই মধ্যে গবেষণা শুরু করেছে অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল সায়েন্সেস (এইমস)। করোনায় মৃতদের চোখে ভাইরাসের উপস্থিতি রয়েছে কি না তা দেখতে চোখের নানা অংশে পরীক্ষা করবেন সংস্থাটির বিজ্ঞানীরা।
ন্যাশনাল আই ব্যাংকের ৩৬তম চক্ষুদান পক্ষকালীন উদযাপন উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এইমসের আর পি সেন্টার ফর অপথ্যালমিক সায়েন্সের প্রধান ডক্টর জে এস টিটিয়াল এসব তথ্য জানান।
তিনি বলেন, ইতোমধ্যেই পাঁচটি নেত্রগোলক সংগ্রহ করা হয়েছে। কোভিডের ফলে কর্নিয়া, অপটিক নার্ভ বা রেটিনায় কোনো প্রভাব পড়ে কি না তা খতিয়ে দেখতেই এই গবেষণা চালানো হবে।
আর পি সেন্টারের আরেক চিকিৎসক ডক্টর নম্রতা শর্মার মতে, কোভিডের সঙ্গে অন্ধত্বের এখনও পর্যন্ত কোনও সরাসরি যোগাযোগ মেলেনি। বহু আক্রান্তরা কনজাঙ্কটিভাইটিসেও ভুগেছেন। কিন্তু তার ফলে দৃষ্টিশক্তি হারানোর খবর মেলেনি। যদিও মিউকরমাইকোসিসের প্রভাবে দৃষ্টিশক্তিতে ব্যাপক প্রভাব দেখা গেছে।
মূলত ভারতে যখন কোভিড-১৯ সংক্রমণের ভয়াবহ দ্বিতীয় ঢেউ কেড়ে নিচ্ছে অনেক মানুষের জীবন, তছনছ করে দিচ্ছে জনজীবন, তখন ভারতের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো এখন ধরা পড়ছে করোনা থেকে আরোগ্যের পথে বা সুস্থ হয়ে ওঠাদের শরীরে বিরল এক সংক্রমণ; যার নাম ‘ব্ল্যাক ফাঙ্গাস’ বা বৈজ্ঞানিক নাম মিউকোরমাইকোসিস।
ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে সংক্রমিত রোগীদের সাধারণত যেসব উপসর্গ দেখা দেয় তার মধ্যে রয়েছে নাক বন্ধ হয়ে যাওয়া, নাক থেকে রক্ত পড়া, চোখে ব্যথা, চোখ ফুলে যাওয়া, চোখের পাতা ঝুলে পড়া, চোখে ঝাপসা দেখা, যার থেকে পরে দৃষ্টিশক্তি চলে যায় ও নাকের চামড়ার চারপাশে কালো ছোপ ছোপ দাগ দেখা দেয়া।
চিকিৎসকরা বলছেন, বেশিরভাগ রোগীই তাদের কাছে পৌঁছাচ্ছে দেরিতে। যখন তারা দৃষ্টিশক্তি হারাতে বসেছে। এই পর্যায়ে ডাক্তারের অস্ত্রোপচার করে চোখ ফেলে দেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। কারণ ছত্রাকের মস্তিষ্কে আক্রমণ ঠেকাতে চোখ বাদ দেয়া ছাড় তখন বিকল্প থাকে না।
ভারতের ডাক্তাররা বলছেন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে রোগীরা দু’চোখেরই দৃষ্টি হারাচ্ছেন। কিছু কিছু রোগীর ক্ষেত্রে সংক্রমণ ছড়ানো রুখতে চিকিৎসকদের রোগীর চোয়ালের হাড়ও কেটে ফেলে দিতে হয়েছে। তবে সেগুলো একেবারে মারাত্মক সংক্রমণের ক্ষেত্রে।
মানবদেহের এমন কোনও অঙ্গ নেই যার ক্ষতি করছে না করোনা। ফুসফুস, লিভার, হৃদপিণ্ড, এমনকি কিডনিকেও ছাড়ছে না করোনা ভাইরাস। সব থেকে বড় সমস্যা হচ্ছে— অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শরীরের এই ক্ষতিটা বোঝা যাচ্ছে করোনা নেগেটিভ হওয়ার সপ্তাহখানেক পর থেকে। এই সমস্যা কারো কারো আরও পরে হয়। অতি সন্তর্পণে কোষের মধ্যে ঢুকে এই ভাইরাস আত্মগোপন করে থাকে। ধীরে ধীরে কোষগুলোর ক্ষতি করতে থাকে। তাই করোনা নেগেটিভ হওয়া মানেই কিন্তু পুরোপুরি রোগমুক্তি নয়।
এমন নীরবেই কিডনির ক্ষতি করে দিয়ে যাচ্ছে করোনা ভাইরাস। সম্প্রতি কিডনি রোগবিষয়ক সাময়িকী দ্য জার্নাল অব দ্য আমেরিকান সোসাইটি অব নেফ্রোলজিতে প্রকাশিত একটি গবেষণায় এমনটি বলা হয়েছে।
গবেষণায় বলা হয়, বাড়িতে চিকিৎসা নিয়ে যারা করোনা থেকে সেরে উঠেছেন তাদের রক্ত শোধন করা অঙ্গগুলো ক্ষতি হতে পারে। এতে কোনো ধরনের ব্যথা থাকে না এবং নীরবেই এটি হয়। এমনকি যে সব করোনা রোগীদের মূত্রাশয়ের কোনো সমস্যা নেই তাদেরও শেষ পর্যায়ের কিডনি রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে যদি হাসপাতালে তারা ভর্তি না হয়।
গবেষণায় আরও বলা হয়, প্রতি ১০ হাজারের মধ্যে অতিরিক্ত ৭ দশমিক ৮ শতাংশ মানুষকে কিডনির ডায়ালাইসিস অথবা প্রতিস্থাপন করতে হচ্ছে। যারা মৃদু থেকে মাঝারি উপসর্গ নিয়ে করোনায় ভুগছেন।
দেশের করোনা পরিস্থিতি
গতকাল বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে পাঠানো করোনাবিষয়ক নিয়মিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় ৫৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ পর্যন্ত করোনায় মোট মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৬ হাজার ৭৯৪ জনে।
২৪ ঘণ্টায় নতুন করে করোনা শনাক্ত হয়েছে ২ হাজার ৫৮৮ জনের। এতে মোট শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৫ লাখ ২৪ হাজার ৮৯০ জনে। এর আগে, বুধবার ৫২, মঙ্গলবার ৫৬ ও সোমবার ৬৫ জনের মৃত্যু হয়।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ২৪ ঘণ্টায় করোনা থেকে সুস্থ হয়েছেন ৩ হাজার ৬১৭ জন। এ পর্যন্ত মোট সুস্থ হয়েছেন ১৪ লাখ ৬৮ হাজার ২১১ জন।
গত ২৪ ঘণ্টায় ২৯ হাজার ৪৯৫ জনের নমুনা সংগ্রহ করা হয়। পরীক্ষা করা হয় ২৯ হাজার ৫৪১টি নমুনা। পরীক্ষার বিপরীতে রোগী শনাক্তের হার ৮ দশমিক ৭৬ শতাংশ। এ পর্যন্ত মোট ৯১ লাখ ৭৫ হাজার ৯১২টি নমুনা পরীক্ষায় শনাক্তের হার ১৬ দশমিক ৬২ শতাংশ।
গত ২৪ ঘণ্টায় যে ৫৮ জন মারা গেছেন তাদের মধ্যে নারী ২৩ জন এবং পুরুষ ৩৫ জন। এ সময়ের মধ্যে ঢাকা বিভাগে সবচেয়ে বেশি ২২ জনের মৃত্যু হয়েছে। এরপর চট্টগ্রাম বিভাগে ১৯ জন মারা গেছেন। রাজশাহীতে ৩, খুলনায় ৫, সিলেটে ৮ এবং রংপুরে ১ জন মারা গেছেন।
গত বছরের ৮ মার্চ দেশে প্রথম ৩ জনের দেহে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। এর ১০ দিন পর ওই বছরের ১৮ মার্চ দেশে এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে প্রথম একজনের মৃত্যু হয়।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৪১০
আপনার মতামত জানানঃ