২০২১ সালে এসেও দেশকে পুরোপুরি নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে মুক্ত করা সম্ভব হলো না। এখনও দেশের ২৪ দশমিক ৪ শতাংশ মানুষ নিরক্ষর। ২০০৮ সালের নির্বাচনি ইশতেহারে আওয়ামী লীগের ঘোষণা ছিল ২০১৪ সালের মধ্যে দেশ থেকে নিরক্ষরতা দূর করা হবে। তবে ৭ বছর পেরিয়ে গেলেও প্রতি ১০০ জনের মধ্যে ২৭ জন নর নারী এখনও নিরক্ষর।
সর্বশেষ সমীক্ষা অনুযায়ী দেশের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯১ লাখ ১ হাজার। এ হিসাবে দেশে নিরক্ষর মানুষের সংখ্যা ৪ কোটি সাড়ে ১২ লাখ। সরকারি হিসাবে এক বছরে দেশে সাক্ষরতার হার বেড়েছে দশমিক ৯ শতাংশ। এ হারে সাক্ষরতা বাড়তে থাকলে শতভাগ সাক্ষরতা অর্জন করতে আরও ২৭ বছর লাগবে।
আজ ৮ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক স্বাক্ষরতা দিবস। ইউনেস্কোর সাধারণ সম্মেলনে ১৪তম অধিবেশনে ১৯৬৬ সালের ২৬ অক্টোবর ইউনেস্কো কর্তৃক আন্তর্জাতিক স্বাক্ষরতা দিবস ঘোষণা করা হয়। এটি ১৯৬৭ সালে প্রথমবারের মতো উদযাপিত হয়। এর লক্ষ্য ছিল ব্যক্তি সম্প্রদায় এবং সমাজের কাছে স্বাক্ষরতার গুরুত্ব তুলে ধরা। জাতিসংঘের সকল সদস্য রাষ্ট্র দিবসটি পালন করে থাকে।
আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবসকে সামনে রেখে গত সোমবার সংবাদ সম্মেলন করেছিলো প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। এতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন জানান, বর্তমানে দেশে সাক্ষরতার হার ৭৫ দশমিক ৬০ দশমিক।
গত বছর এ হার ছিল ৭৪ দশমিক ৭০ শতাংশ। এক বছরে সাক্ষরতা বেড়েছে দশমিক ৯ শতাংশ। জনগোষ্ঠীর ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারে সাক্ষরতার প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, এজন্য সবার আগে প্রয়োজন সাক্ষরতা-জ্ঞান। দেশের সব মানুষকে সাক্ষর-জ্ঞান সম্পন্ন করা গেলে ডিজিটাল প্রযুক্তির বিকাশ হবে। এর ফলে নিরক্ষর ও সাক্ষরতা-জ্ঞানসম্পন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যেকার বিভাজন কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।
বেসরকারি পর্যায়ে সাক্ষরতা নিয়ে কাজ করছে গণসাক্ষরতা অভিযান (ক্যাম্পে)। বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাকে (এনজিও) সঙ্গে নিয়ে সারা দেশে গণসাক্ষরতা অভিযান কাজ করছে। গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, এবারে সাক্ষরতা দিবসের প্রতিপাদ্য হলো- ‘ডিজিটাল বৈষম্য দূর করা।’ কিন্তু করোনাভাইরাসের বাস্তবতা বলছে, স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম এগিয়ে নিতে আগামী দিনে সরাসরি পদ্ধতির সঙ্গে অনলাইন পাঠদান ও একাডেমিক কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে হবে। তিনি বলেন, এটাকে ‘ব্লেন্ডেড এডুকেশন’ বলা হয়। যেহেতু শিক্ষার মতো বিষয় ফেলে রাখার মতো নয়, তাই সব ধরনের শিক্ষার্থীর কাছে স্মার্টফোন, ট্যাব, ল্যাপটপসহ ডিজিটাল ডিভাইস থাকতে হবে। তা না হলে বৈষম্য বেড়ে যাবে। গত দেড় বছরে দেখা গেছে- শহরাঞ্চলের প্রায় সব শিক্ষার্থী অনলাইনের সুবিধা নিয়ে লেখাপড়া চালিয়ে গেছে। কিন্তু সুবিধাবঞ্চিত মফস্বলের শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে আছে।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা বিশেষজ্ঞ কেএম এনামুল হক এক জাতীয় বলেন, নিয়মিত কাজের অংশ হিসাবে অন্যসব তথ্যের পাশাপাশি বিবিএস সাক্ষরতার একটি তথ্য সংগ্রহের পাশাপাশি তা প্রকাশ করে। এটাকে আমরা বলে থাকি ‘সেল্ফ রিপোর্টেড’ তথ্য। সাক্ষরতার প্রকৃত চিত্র বের করতে হলে তা ‘টেস্টেড’ প্রতিবেদন হতে হবে। দেশে ২০১১ সালে এ ধরনের সমীক্ষা হয়েছে। ইউনেস্কোর বৈশিষ্ট্য পূরণ করে ২০১৬ সালে ক্যাম্পে একটি সমীক্ষা করেছে। সেটির তথ্য অনুযায়ী দেশে সাক্ষর মানুষ ৫১ দশমিক ৩০ শতাংশ।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী- দেশে ১৯৭১ সালে সাক্ষরতার হার ছিল ১৬ দশমিক ৮ ভাগ। ১৯৯১ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৩৫ দশমিক ৩ এবং ২০০১ সালে ৪৭ দশমিক ৯। ২০০৮ সালে ৪৮ দশমিক ৮ ভাগ এবং ২০০৯ সালের হিসাবে ৫৩ ভাগ। আগামী বছর দেশে আদমশুমারি হবে। আদমশুমারি থেকে এ ব্যাপারে তথ্য বেরিয়ে আসতে পারে।
সাক্ষরতার হার নিরূপণে এক দশকে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। তবে ২০১১ সালে সাক্ষরতা নিরূপণ করা শুরু হয়। এরপর ২০১৪ সাল থেকে বছরে একবার পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকল্প প্রস্তাব পাঠিয়ে আর পরিকল্পনা কমিশন সেটিতে মতামত দিয়ে দায়িত্ব শেষ করছে। কাজের মধ্যে আছে শুধু বিবিএসের জনসংখ্যা সংক্রান্ত নিয়মিত সমীক্ষায় ‘পড়তে পারেন কিনা’ শীর্ষক প্রশ্নভিত্তিক সাক্ষরতা নিরূপণ। আর ঢাকঢোল পিটিয়ে এ তথ্য প্রচার করে যাচ্ছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। সাক্ষরতা নিরূপণে সরকারি সংজ্ঞা এবং বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক সংজ্ঞার মধ্যে মস্ত বড় ফারাক রয়েছে। দেশকে নিরক্ষরমুক্ত করার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়েও প্রশ্ন আছে।
একটি দেশ ডিজিটাল হওয়ার আগে শিক্ষিত হওয়া জরুরি। শিক্ষা ছাড়া কোনোভাবেই ব্যক্তিগত মনস্তাত্ত্বিক উন্নতি কিংবা সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নতি করা সম্ভব না।
ইউনেস্কোর সংজ্ঞা অনুযায়ী সাক্ষরতা হলো- পড়া, অনুধাবন করা, মৌখিকভাবে এবং লেখার বিভিন্ন পদ্ধতিতে ব্যাখ্যা করা, যোগাযোগ স্থাপন করা এবং গণনা করার দক্ষতা। অর্থাৎ সাক্ষরতা বলতে লিখতে, পড়তে, গণনা করতে ও যোগাযোগ স্থাপন করার সক্ষমতাকে বোঝায়। এর সঙ্গে নতুন যুক্ত হয়েছে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার করতে জানা। জুনে ‘বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিক-২০২০’ প্রকাশ করে পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। এতে সাক্ষরতার হার ৭৫ দশমিক ৬ শতাংশ উল্লেখ করা হয়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সেল্ফ রিপোর্টেড সমীক্ষায় ‘আপনি কী লিখতে পারেন’- এমন প্রশ্ন এবং ‘ইয়েস’ ও ‘নো’ উত্তরের ওপর ভিত্তি করে সাক্ষরতার হার নির্ণয় করা হয়। আর ‘টেস্টেড’ সমীক্ষায় ব্যক্তিকে লেখানো ও পড়ানো হয়। এর ভিত্তিতে গণনাকারী সাক্ষর ব্যক্তিকে শনাক্ত করেন।
এ কারণে বিশেষজ্ঞরা বিবিএস প্রকাশিত হারের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন। পাশাপাশি তারা বলেন, এসডিজির (টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা) যুগে এ ধরনের সাক্ষরতা কোনো কাজে আসবে না। এমডিজির (সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা) যুগে সংখ্যাগত উন্নয়নে জোর দেওয়া হয়েছিল।
গুণগত উন্নয়নের কথা বলছে বিশ্ব। তাই সাক্ষরতা নিরূপণের সংজ্ঞা ধরেই প্রকৃত সাক্ষর মানুষ বের করা প্রয়োজন। এ জন্য বেসরকারিভাবে সমীক্ষা পরিচালনার অনুমতি দেওয়া দরকার বলে মনে করেন তারা। এসডিজির ৪ (৬.১) নম্বর অনুচ্ছেদে সাক্ষরতা সম্পর্কে সুস্পষ্ট নির্দেশনা উল্লেখ করা হয়েছে।
মুজিববর্ষ উপলক্ষ্যে ২১ লাখ লোককে সাক্ষর করার কথা থাকলেও সেটা শুরু করাই যায়নি। পরিস্থিতির উন্নতি হলে এ কার্যক্রম শুরু করা হবে বলে জানান প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী।
বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি দেশ ডিজিটাল হওয়ার আগে শিক্ষিত হওয়া জরুরি। শিক্ষা ছাড়া কোনোভাবেই ব্যক্তিগত মনস্তাত্ত্বিক উন্নতি কিংবা সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নতি করা সম্ভব না।
এদিকে করোনাকালে দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের কারণে অনেক নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানেরা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে সরে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। দেশের অর্থনৈতিক অবকাঠামো ভেঙে যাবার কারণেও অনেকে শিক্ষাজীবনে সময় না দিয়ে কর্মজীবনে সময় দিতে বাধ্য হবে। এতে নিরক্ষরতার হার বৃদ্ধি পাবে বলে তীব্র আশঙ্কা রয়েছে।
এসডব্লিউ/এমএন/ডব্লিউজেএ/২০০৯
আপনার মতামত জানানঃ