ঢাকাবাসীর নিত্যদিনের দুর্ভোগের নাম যানজট। এই যানজটের কারণে অতিষ্ঠ শুধু সাধারণ মানুষের জীবন নয়, প্রতিনিয়ত শূন্য হচ্ছে রাষ্ট্রের পকেটও। নষ্ট হচ্ছে মূল্যবান কর্মঘণ্টা। পাশাপাশি যানজটে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষায় তৈরি হয় মানসিক অবসাদ। গবেষণা বলছে, যানজটের কারণে শুধু ঢাকায় দিনে ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। যার আর্থিক ক্ষতি বছরে প্রায় ৩৭ হাজার কোটি টাকা। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, যেভাবে যানজট পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হচ্ছে, তাতে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণও আরও বাড়বে।
নষ্ট হচ্ছে কর্মঘণ্টা
যানজট নিয়ে সর্বশেষ গবেষণা বলছে, ঢাকায় যানজটের কারণে পিক আওয়ারে গণপরিবহনগুলোর গতিবেগ ঘণ্টায় ৫ কিলোমিটারে নেমে এসেছে, যেখানে হেঁটে চলার গড় গতিও ৫ কিলোমিটার। ফলে প্রতিদিন ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। ১২ বছর আগেও এই গতি ছিল ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার।
এআরআই’র গবেষণায় বলা হয়, ২০১৫ সালের সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা (আরএসটিপি) অনুযায়ী, ঢাকায় দৈনিক প্রায় ৩ কোটি ৬০ লাখ ট্রিপ হয়। উল্লেখ্য, একজন মানুষ কোনও একটি বাহনে উঠে নির্ধারিত গন্তব্যে নামলে একটি যাত্রা বা ট্রিপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
এই প্রতিবেদন অনুসারে, ২০০৪ সালে ঢাকার রাস্তায় প্রতি ঘণ্টায় গাড়ির গতিসীমা গড়ে ছিল ২১ দশমিক ২ কিলোমিটার। ২০০৯ সালে তা ঘণ্টায় ৬ দশমিক ৮ কিলোমিটারে এসে দাঁড়ায়। যানবাহনের পরিমাণ যদি একই হারে বাড়তে থাকে এবং তা নিরসনের কোনও উদ্যোগ না নেওয়া হয়, তাহলে ২০২৫ সালে এই শহরে যানবাহনের গতি হবে ঘণ্টায় চার কিলোমিটার, যা মানুষের হাঁটার গতির চেয়ে কম।
বছরে গড়ে ৩৭ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি
২০১১ সালে রাজধানীতে যানজটের কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করে ইনস্টিটিউশন অব ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশ (আইইবি) জানায়, ক্ষতির পরিমাণ বছরে ২০ হাজার কোটি টাকা। ২০১২ সালে যানজটের আর্থিক ক্ষতি নিরূপণ করে ইউএনডিপি। তাতে ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৩১ হাজার কোটি টাকার মতো। ২০১৫ সালে বাংলাদেশ বিনিয়োগ বোর্ড (বিওআই) জানায়, রাজধানীতে যানজটের কারণে বছরে অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে প্রায় এক লাখ কোটি টাকার, যা মোট জিডিপির ৭ শতাংশের সমান।
২০১৬ সালে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের ‘নগর পরিস্থিতি-২০১৬: ঢাকা মহানগরে যানজট, শাসন ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিত’ শীর্ষক এক গবেষণায় বলা হয়েছিল, যানজটের আর্থিক ক্ষতির পরিমাপে ২৬ দশমিক ৫ কিলোমিটার দৈর্ঘের এয়ারপোর্ট-পোস্তগোলা রুটকে নমুনা হিসেবে নেওয়া হয়।
দেখা গেছে, ব্যস্ত সময়ে (পিক আওয়ার) এ রুটে গাড়ির গতিসীমা থাকে ঘণ্টায় ৯ কিলোমিটার। এই ধীরগতির কারণে প্রতিবার যাতায়াতে একজন যাত্রীর যে সময় নষ্ট হয়, যার আর্থিক পরিমাণ দিনে আনুমানিক ৫৩ টাকা। এ ছাড়া যানজটে নষ্ট হওয়া সময়ের আর্থিক মূল্য ও জ্বালানি খরচ সার্বিকভাবে মাসে ২২৭ কোটি টাকা দাঁড়ায় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
সর্বশেষ ২০১৮ সালে ‘ঢাকা মহানগরীর যানজট: আর্থিক ও স্বাস্থ্যগত সমস্যা’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছিল বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এআরআই)। ওই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, যানজটের কারণে ২০ হাজার থেকে ৫৫ হাজার কোটি টাকার বার্ষিক ক্ষতি হচ্ছে।
এ থেকে বলা যায়, যানজটের কারণে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ বছরে গড়ে ৩৭ হাজার কোটি টাকা। তবে সড়ক খাতে বিনিয়োগ, যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ ও যানজট নিরসনে রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে এই ক্ষতি অন্তত ৬০ শতাংশ বা ২২ হাজার কোটি টাকা কমানো যেত।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) পরিচালক এবং বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক মো. মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ‘করোনার কারণে পরিস্থিতি এখন বুঝার উপায় নেই। অনেক কিছু বন্ধ ছিল। আর পরিস্থিতি ভালো হওয়ার কোনও কারণ নেই। পরিস্থিতি উন্নতি করার জন্য বাস সিস্টেম উন্নত করা, পথচারী সিস্টেম ইমপ্রুভ করা, ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের যে ব্যবস্থা ইমপ্রুভ করার কথা ছিল, সেটিও হয়নি। সুতরাং, অবস্থা ভালো হওয়ার কোনও কারণ নেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের দৈনিক যে কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়, সেখান থেকেই এই আর্থিক ক্ষতির হিসাবটা এসেছে। একজন মানুষ প্রতিঘণ্টায় ন্যূনতম যে আয় করেন, সেই হারের সঙ্গে কর্মঘণ্টার হিসাব করে যে অঙ্কটি পাওয়া যায়, সেটি হচ্ছে এই ৩৭ হাজার কোটি টাকা আর্থিক ক্ষতি।’
এই আর্থিক ক্ষতি পৃথিবীর কোনও দেশ শতভাগ পুষিয়ে নিতে পারবে না, উল্লেখ করে তিনি বলেন, কারণ শহর থাকবে, মানুষ থাকবে, জ্যাম কিছু পরিমাণ থাকবেই। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এটাকে কত শতাংশ কমানো সম্ভব। আমাদের ধারণা ছিল— এটি শতকরা ৫০ ভাগ কমানো সম্ভব।
পরিবহন খাতে বেসিক যে প্রয়োজনগুলো, সেগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে কমপক্ষে ৫০ ভাগ ক্ষতি কমানো সম্ভব। সেই অর্থে যআর পরিমাণ ১৯-২০ হাজার কোটি টাকা। সরকারের যদি সঠিক বিনিয়োগ পরিকল্পনা সেখানে কাজ করে এবং প্রতি বছর যদি ৫-১০ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হতো, তাহলে হয়তো কাজ হতো। এখন বলতে পারেন, ২২ হাজার কোটি টাকার মেট্রোরেল হচ্ছে, কিন্তু সেটা তো এখনও চালু হয়নি। আর এটি হচ্ছে ১০টি ‘গুটি’র (উপায়) একটি, বাকি যে ৯টি গুটি আছে, সেগুলোর ক্ষেত্রেও কিন্তু কিছু বিনিয়োগের প্রয়োজন আছে।
সেটা কিন্তু করা হয়নি এবং সেখানে অল্প টাকার বিনিয়োগ। ট্রাফিক সিস্টেম ও বাস ম্যানেজমেন্ট; এগুলোতে কিন্তু অল্প টাকার বিনিয়োগ। ১-২ হাজার কোটি টাকার মধ্যে হয়ে যাওয়ার কথা। আমাদের বাস সিস্টেমে কাজ করা অত্যন্ত জরুরি। সেখানে হাত দেওয়া হয়নি এখনও। আরও মেট্রোরেল করা হবে, সেগুলো হবে ২০৩০ সালে। কিন্তু এর মধ্যে মানুষের দুর্ভোগ চলতে থাকবেই, আর আর্থিক ক্ষতির পরিমাণও বাড়তে থাকবে।
এসডব্লিউ/এসএস/০৭০৮
আপনার মতামত জানানঃ