কক্সবাজারের টেকনাফ-উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো এখন জঙ্গিদের নিরাপদ ঘাঁটি। এসব ক্যাম্পকে কেন্দ্র করে চলছে জঙ্গি প্রশিক্ষণ। দুর্গম অরণ্যে গড়ে তোলা হয়েছে প্রশিক্ষণকেন্দ্র। সূত্র মতে, ৩৪টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে জঙ্গিদের সংগঠিত করে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে রোহিঙ্গা জঙ্গি সংগঠনগুলো। তাদের অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সহায়তার অভিযোগ উঠেছে দেশি-বিদেশি কয়েকটি এনজিওর বিরুদ্ধে। পাশাপাশি স্থানীয় মাদ্রাসাগুলো হয়ে উঠেছে জঙ্গিদের প্রজননক্ষেত্র হিসেবে।
রোহিঙ্গা ক্যাম্প জঙ্গিদের নিরাপদ ঠিকানা
জানা যায়, উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তালিকাভুক্ত শরণার্থী ১০ হাজার ৪০০ জন। অথচ নিবন্ধন ছাড়া আরো এক লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা আগে থেকেই অবৈধভাবে বসবাস করছে এখানে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, এই ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য গঠিত হয়েছে ক্যাম্প ম্যানেজমেন্ট কমিটি। রোহিঙ্গা জঙ্গিনেতা মৌলভী শফিক ও নুরুল হক শতাধিক রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী নিয়ে এ কমিটি পরিচালনা করছেন। তারাই ক্যাম্প নিয়ন্ত্রণ করেন। তাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে পলাতক সব দুর্ধর্ষ জঙ্গি।
একইভাবে টেকনাফের নয়াপাড়া ক্যাম্পেও রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী মো. ইসলাম ও জুবাইয়ের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছে ৭০-৮০ সদস্যের ক্যাম্প ম্যানেজমেন্ট কমিটি। তারাই নিয়ন্ত্রণ করে ওই ক্যাম্প।
নয়াপাড়ার কাছে লেদা এলাকায় রয়েছে আরো একটি ক্যাম্প। সেখানে অবৈধভাবে বসবাস করছে প্রায় ৩০ হাজার রোহিঙ্গা। একাধিক রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গ্রুপ এই ক্যাম্প নিয়ন্ত্রণ করছে।
সূত্র মতে, টেকনাফ-উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর ম্যানেজমেন্ট বা মাঝির দায়িত্বে থাকা অধিকাংশ রোহিঙ্গাই জঙ্গিনেতা। যে কারণে তাদের অধীনে থাকা ক্যাম্পগুলো ব্যবহৃত হচ্ছে যোগাযোগের নির্ভরযোগ্য ঠিকানা হিসেবে।
নিষিদ্ধ রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও), আরাকান মুভমেন্ট, আরাকান পিপলস ফ্রিডম পার্টি, আরাকান রোহিঙ্গা ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন (এআরএনও), হরকাতুল জিহাদসহ কয়েকটি জঙ্গি সংগঠন এখন প্রশাসনের দৃষ্টি এড়িয়ে একটি গ্রুপে কাজ করছে।
সূত্র মতে, ক্যাম্পে জঙ্গিদের সামরিক প্রশিক্ষক ছিলেন আরাকানের বুচিদংয়ের রোহিঙ্গা জঙ্গি নুরুল ইসলাম। তিনি এখন টেকনাফের লেদা ক্যাম্পে রয়েছেন। এখানে প্রায় ৩০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীর সঙ্গে মিশে রয়েছেন আবদুর রহিম, হাফেজ মুহাম্মদ আয়ুব, হাফেজ রফিকুল ইসলাম, জামাল হোসেন, মো. জাবের, মৌলভী আইয়ুব নদভীসহ আরো রোহিঙ্গা জঙ্গি।
টেকনাফের নয়াপাড়া ক্যাম্পে রয়েছেন জঙ্গি গ্রুপের আমির জুবাইর আহমদ, কমান্ডার সাব্বির আহমদ ও ফরিদ উদ্দিনসহ কয়েকজন।
এনজিও’র সম্পৃক্ততা ও বিপুল অর্থের সংস্থান
একাধিক সূত্র জানিয়েছে, রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের সঙ্গে বিদেশি কয়েকজন এনজিও কর্মকর্তার সম্পর্ক রয়েছে। এসব সংস্থা সাহায্যের নামে রোহিঙ্গা জঙ্গিদের অর্থ জোগান দিচ্ছেন।
সূত্র মতে, রোহিঙ্গা শিবিরে জঙ্গিদের অর্থ সহায়তার বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ায় মুসলিম এইড, মুক্তিসহ ৭-৮টি এনজিওর কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এরপরও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দৃষ্টি এড়িয়ে পুরোদমে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে অভিযুক্ত কয়েকটি এনজিও। তাদের সহায়তায় দিন দিন আরো শক্তিশালী হচ্ছে জঙ্গিরা।
এছাড়া আরএসওর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একজন জানিয়েছেন, রোহিঙ্গা জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর শীর্ষ নেতাদের তৎপরতায় মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপ থেকে বিশাল অঙ্কের তহবিল বাংলাদেশে আসে। স্থানীয়ভাবেও তহবিল সংগ্রহ করা হয়।
সেই টাকায় জঙ্গি গ্রুপগুলোকে সংগঠিত করার তৎপরতা চালাচ্ছে নেতারা। এ উদ্দেশ্যে আরএসওর সামরিক শাখার দায়িত্বে নিয়োজিত জঙ্গি মৌলভী সেলিম, আইয়ুব কিছুদিন ধরে উখিয়া-টেকনাফে অবস্থান করছেন।
অন্যদিকে কতিপয় প্রভাবশালী নেতার পৃষ্ঠপোষকতায় এসব রোহিঙ্গা জঙ্গি অপরাধ করেও বারবার পার পেয়ে যাচ্ছে বলে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। শুধু তাই নয়, রোহিঙ্গা জঙ্গিগোষ্ঠী দ্বারা পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ঢাল হিসেবে সভাপতিসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদ দখল করে আছেন এসব নেতারা।
রোহিঙ্গা নিয়ন্ত্রিত মাদরাসা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জঙ্গি প্রজননকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থীই রোহিঙ্গা শিশু-কিশোর।
সূত্র মতে, কক্সবাজার সদরের ঝিলংজার মহুরীপাড়ায় ইমাম মুসলিম ইসলামিক সেন্টার, শহরতলীর কলাতলী আদর্শ শিক্ষা নিকেতন, দক্ষিণ মহুরীপাড়া আদর্শ শিক্ষা নিকেতন, ঈদগাঁও মারুফ মাদরাসাসহ জেলা শহর ও পার্শ্ববর্তী পার্বত্য অঞ্চলে অন্তত ১৪-১৫টি মাদরাসা পরিচালিত হচ্ছে জঙ্গিদের অর্থে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভাষ্যমতে
কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. হাসানুজ্জামান জানিয়েছেন, সীমিত লোকজন দিয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করছে পুলিশ। রোহিঙ্গা ক্যাম্প অত্যন্ত স্পর্শকাতর এলাকা। এখানে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর নজরদারি রয়েছে। তাই পুলিশ সুনির্দিষ্ট তথ্য ছাড়া ক্যাম্পে অভিযান চালায় না। রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা এ সুযোগ নিতে পারে।
তিনি আরো জানান, রোহিঙ্গাদের জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তাদের কাছেও রয়েছে। ক্যাম্পগুলোতে এখন নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
পুলিশের একটি সূত্র জানায়, টেকনাফের দুটি ক্যাম্পে অভিযান চালিয়ে সম্প্রতি কয়েকটি ল্যাপটপ উদ্ধার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সেসব ল্যাপটপে রয়েছে জঙ্গি তৎপরতা ও সংশ্লিষ্টতার তথ্য।
এদিকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বপ্রাপ্ত ১৬ এপিবিএন-এর অধিনায়ক মোহাম্মদ তরিকুল ইসলাম বলেন, উখিয়া-টেকনাফের ৩৪টি ক্যাম্পের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় আমরা কাজ করছি। তবে সীমিত জনবল নিয়ে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের অপতৎপরতা দমনে হিমশিম খেতে হচ্ছে। দেশি-বিদেশি কিছু এনজিওর তৎপরতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এর আগে, কয়েকটি এনজিওকে নিষিদ্ধও করা হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, গোপনে যারা জঙ্গি তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে, তাদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। গত জুন মাসে রোহিঙ্গা ভিত্তিক জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগে ঢাকা থেকে তিনজনকে গ্রেফতার করে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট (সিটিটিসি)।
কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের (সিটিটিসি) প্রধান ডিআইজি মো. আসাদুজ্জামান গনমাধ্যমকে বলেছিলেন, দান-সদকা ও দেশি-বিদেশি সংস্থার অর্থ সংগ্রহকারী আনসার আল ইসলামের তিন সদস্যকে (সাইয়েদ তাহমিয়া ইব্রাহিম ওরফে আনোয়ার, মারুফ চৌধুরী মিশু ওরফে ফারহান ও ফয়জুল মুরসালিন) রাজধানীর রামপুরা থেকে গ্রেফতার করা হয়েছিল।
তাদের দেওয়া স্বীকারোক্তিতে বলা হয়, তারা দীর্ঘদিন কক্সবাজারে অবস্থান নিয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সদস্যদের জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করছে। আল ইয়াকিন, আরএসওসহ বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠন একত্রিত হয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে জঙ্গিবাদ ছড়িয়ে দিচ্ছে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৬০৬
আপনার মতামত জানানঃ