আবারও ভয়াবহ দাবানলের কবলে পড়েছে পৃথিবীর ‘ফুসফুস’ খ্যাত আমাজন। এ নিয়ে টানা তৃতীয় বছরের মতো দাবানলে পুড়ছে এই বন। সমালোচকরা বলছেন, ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জেইর বলসোনারোর বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কার্যক্রমের কারণে হুমকির মুখে জীববৈচিত্র্য। মানবসৃষ্ট অগ্নিকাণ্ডে ল্যাবরিয়া অঞ্চলের বিশাল এলাকা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। আশপাশের ন্যাশনাল পার্কেও ছড়িয়ে পড়ছে সে আগুন, নতুন করে সৃষ্টি হচ্ছে দাবানল। এতে উদ্বিগ্ন পরিবেশবাদীরা।
রয়টার্স জানায়, মানবসৃষ্ট অগ্নিকাণ্ডে বনের ল্যাবরিয়া অঞ্চলের বিশাল এলাকা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। আগুন আশপাশের ন্যাশনাল পার্কেও ছড়িয়ে পড়ছে। ফলে নতুন করে সৃষ্টি হচ্ছে দাবানল। এ ঘটনার জন্য ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জেইর বলসোনারোকে দায়ী করছেন পরিবেশবাদীরা।
বিভিন্ন সংস্থার দাবি, বলসোনারো ক্ষমতায় থাকাকালে তৃতীয়বারের মতো রেকর্ডসংখ্যক এলাকার বনাঞ্চল ধ্বংস হলো। আমাজন এলাকায় সেনাবাহিনীর ক্যাম্প স্থানান্তর, কৃষি সম্প্রসারণ এবং কারখানা স্থাপনের পরিকল্পনা নিয়েছেন ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট। এরপর থেকেই আমাজনের বিস্তীর্ণ এলাকা দাবানলের কবলে পড়ে।
এদিকে আমাজন এলাকায় সৃষ্ট দাবানলের কারণ হিসেবে সেনাবাহিনীর ক্যাম্প স্থানান্তর, কৃষি সম্প্রসারণ আর একের পর এক উন্নয়ন কার্যক্রমকেই দায়ী করছেন পরিবেশবিদরা।
আশঙ্কা করা হচ্ছে, অচিরেই মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে প্রাণের অস্তিত্ব। দাবানলের কারণে লাখ লাখ প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে সবাইকে পরিবেশ বিপর্যয়ের মাশুল দিতে হবে বলে হুঁশিয়ারি বিশেষজ্ঞদের।
স্যাটেলাইটে আমাজনে এ পর্যন্ত ২৮ হাজারের বেশি অগ্নিকাণ্ড রেকর্ড করা হয়েছে। লাখ লাখ প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে সবাইকে পরিবেশ বিপর্যয়ের মাশুল দিতে হবে বলে হুঁশিয়ারি বিশেষজ্ঞদের।
২০০৪ সালে ব্রাজিল একাই আমাজনের ১১ হাজার বর্গমাইল বনাঞ্চল খালি করে দেয়। পরিসংখ্যান মতে, ব্রাজিলের মোট বনাঞ্চলের ৬০ শতাংশই তখন ধ্বংস করে ফেলা হয়। বাকি চল্লিশ শতাংশ ধ্বংসের পাঁয়তারা চলছে ব্রাজিলের বর্তমান প্রেসিডেন্ট বলসোনারোর আমলে। ২০১৪ সাল থেকে উন্নয়নের নামে বন ধ্বংসের পাঁয়তারা নতুন করে শুরু হয়।
উষ্ণতার কারণে আমাদের পৃথিবী প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে। কয়েক দশক ধরে বন উজাড় হওয়ার কারণে পরিবেশের ক্ষতি এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে, পৃথিবীর পরিবেশ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা প্রায় অসম্ভব। গাছ দিয়ে ঢেকে থাকা পৃথিবী এখন গাছের অভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের কড়াল গ্রাসে ধরা দিয়েছে।
উষ্ণতার কারণে আমাদের পৃথিবী প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে। কয়েক দশক ধরে বন উজাড় হওয়ার কারণে পরিবেশের ক্ষতি এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে, পৃথিবীর পরিবেশ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা প্রায় অসম্ভব। গাছ দিয়ে ঢেকে থাকা পৃথিবী এখন গাছের অভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের কড়াল গ্রাসে ধরা দিয়েছে।
গাছ কাটাই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মূল এবং প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দিন দিন জলবায়ু আরও বিপর্যয়ের মুখে চলে যাচ্ছে গাছ কমতে থাকায়। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রতি বছর যে পরিমাণ কার্বন ডাই অক্সাইড আছে, তার দুই তৃতীয়াংশ শোষণ করে নেয় গাছ। পৃথিবীর চারপাশের বন কমতে থাকায় পৃথিবীর প্রতিরোধক্ষমতাও কমে যাচ্ছে।
জাতিসংঘের পূর্বাভাস বলছে, ১৯৯০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ১০০ কোটি একর বা ৪২ কোটি হেক্টর বন উজাড় হয়ে গেছে। যে পরিমাণ বন উজাড় হয়েছে, পুরোটার আকার হবে লিবিয়ার সমান। ২০১৫ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত বছরে ১ কোটি হেক্টর করে বন উজাড় হয়েছে।
তবে নেচার জার্নালে প্রকাশিত লিখায় বিজ্ঞানীরা বলছেন, ব্রাজিলের আমাজন বন গত এক দশকের মধ্যে শুধু এই ১২ মাসে সর্বোচ্চ ধ্বংস হয়েছে। ২০০৮ সালের পর ২০২০ আর ২০২১ সালে সর্বোচ্চ ধ্বংস হয়েছে পৃথিবীর ফুসফুস। প্রেসিডেন্ট বলসোনারো ক্ষমতায় আসার পরই বন উজাড় হচ্ছে বেশি। আন্তর্জাতিকভাবে এই বন রক্ষার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হলেও স্থানীয়দের সহযোগিতা ছাড়া দিনদিন আমাজন রক্ষা করা অসম্ভব হয়ে পড়ছে। অথচ আমাজনের গাছ পৃথিবী থেকে প্রতি বছর লাখ লাখ টন কার্বন শোষণ করছে।
আমেরিকার বনাঞ্চলে আগুন লাগে বছরে হাজার বার। যে কারণে পুড়ে যায় লাখ লাখ হেক্টর জমি। এই আগুন সামনে যা কিছু পায়, পুড়িয়ে নিঃশেষ করে। বজ্রপাতসহ এই আগুন লাগার পেছনে প্রাকৃতিক কারণ মাত্র পাঁচ ভাগের এক ভাগ। বাকি চারভাগের জন্য দায়ী মানুষ।
অযত্নে ফেলে রাখা ক্যাম্পফায়ারের আগুন, সিগারেটের অবশিষ্টাংশ থেকে যতটা আগুন লাগে ততটা লাগে না প্রকৃতি থেকে। কিন্তু যেভাবেই হোক একবার আগুন লাগলে প্রকৃতি সেটাকে বাড়াতে থাকে। ফায়ার স্টর্ম, আগুনে-সাইক্লোন, অগ্নি-টর্নেডোর রূপ নিয়ে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে আগুন। গত ৩০ বছরে দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন অরণ্য, আফ্রিকার কঙ্গো বর্ষাবন এলাকা এবং ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপের লাখ লাখ একর বন ধ্বংস করে জুম এবং নিয়মিত চাষাবাদের জমি বের করা হয়েছে। উর্বরতা কম হওয়ায় কয়েক বছর পরেই আবার নতুন করে পোড়াতে হচ্ছে বনাঞ্চল।
এ ছাড়া প্রাকৃতিকভাবে দাবানল সৃষ্টির অন্যতম কারণ বজ্রপাত। বজ্রপাতের কারণে বিভিন্ন স্থানে শুরুতে ছোট ছোট দাবানলের সৃষ্টি হয়। বাতাসের গতিবেগে পরে তা দ্রুত ভয়াবহ আকার ধারণ করে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি আমাদের অনেকের কাছেই কাঠখোট্টা বিজ্ঞান মনে হয়। এ কারণে বন্যা, খরা, ঝড়, নদীভাঙন, মহামারি আর বিপন্ন জীববৈচিত্র্যের সঙ্গে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার সম্পর্ক খুঁজতে আমরা বিশেষজ্ঞদের শরণাপন্ন হই।
কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনই ২১ শতকের সবচেয়ে বড় স্টোরি হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। সমাজের দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী এই পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারে না। ফলে তাদেরই সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হয়। ভবিষ্যতে আরও হবে। কিন্তু লাভবান হয় সম্পদশালী ভোক্তাশ্রেণি, জ্বালানি কোম্পানি, ভারী শিল্প, পরিবহন ও কাঠের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলো। অথচ এরাই সবচেয়ে বেশি গ্রিনহাউস গ্যাস ছড়ায়।
তারা বলেন, আমরা বেশির ভাগ মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়কে নিতান্তই পরিবেশের বিষয় বলে মনে করে এসেছি। বারবার নিজেদের বুঝিয়েছি বিজ্ঞানের বিষয়। এখন আর সেই অস্পষ্টতা নেই মানুষের মধ্যে। এখন বিষয়টিকে অবধারিত এক বৈশ্বিক ঘটনা হিসেবে দেখা হয়, যা অর্থনীতি, নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য, জীবনযাপন, খাবারের জোগান, এমনকি রাজনীতি পর্যন্ত— আমাদের জীবনের প্রতিটি দিককে কোনো না কোনোভাবে প্রভাবিত করছে।
বৈশ্বিক উষ্ণতা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে আমাজন। প্রায় ৩০ লাখ স্বতন্ত্র প্রজাতির গাছপালা ও প্রাণীর আবাসস্থল এই আমাজন। প্রতিবছর মিলিয়ন মিলিয়ন টন কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে নেয় আমাজনের বিস্তৃত বনাঞ্চল। এই গাছগুলো যখন কাটা হয় বা আগুনে পুড়ে যায়, তখন শোষণ করে রাখা কার্বন ডাই-অক্সাইড বায়ুমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়ে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭১৭
আপনার মতামত জানানঃ