ক্যালিফোর্নিয়া আর নিউইয়র্ক যুক্তরাষ্ট্রের দুই দিকে অবস্থিত। এই দুই অঙ্গরাজ্যের দূরত্ব প্রায় তিন হাজার মাইল। সম্প্রতি দুই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে এই দুই অঞ্চল। একটি পুড়ছে দাবানলে, অপরটি ভাসছে বন্যায়। দাবানলে জ্বলছে ক্যালিফোর্নিয়া ও এর আশপাশের অঙ্গরাজ্যগুলো। আর টর্নেডো আঘাত হেনেছে নিউইয়র্কসহ এর আশপাশের অঙ্গরাজ্যগুলোয়। এই করোনা মহামারিকালে দাবানল আর বন্যায় দশকের সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
৮টি টর্নেডোর আঘাতে ভয়াবহ বন্যা
যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমসের খবর অনুসারে, আজ শুক্রবার সকাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বন্যা ও টর্নেডোয় এখন পর্যন্ত ৪৬ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। নিউইয়র্কে বন্যার পানিতে ভেসে গেছে সেখানকার পাতাল রেলস্টেশন।
বন্যায় নিউজার্সিতে মারা গেছেন কমপক্ষে ২৩ জন। নিউজার্সির গভর্নর ফিল মারফি জানান, নিহতের মধ্যে বেশিরভাগই বন্যার মধ্যে তাদের গাড়িতে আটকা পড়েছিলেন এবং পানিতে ভেসে গিয়েছিলেন। নিহতের অনেকের পরিচয় এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি বলে জানান কর্মকর্তারা।
অনেক বাড়িতে পানি ঢুকে পড়েছে। পানিতে ভেসে গেছে অনেকের গাড়ি। আবার এসব গাড়িতে আটকা পড়ে প্রাণ হারিয়েছেন বেশ কয়েকজন। অনেক এলাকা বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়েছে। বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, লুইজিয়ানা, মিসিসিপি, পেনসিলভানিয়া ও নিউইয়র্কের প্রায় ১০ লাখ বাসিন্দার বাড়িতে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে।
দুর্যোগের কারণে নিউইয়র্ক শহরের প্রায় সবগুলো সাবওয়ে লাইন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে এবং জরুরি পরিবহন ছাড়া সব ধরনের যান চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছে। স্থগিত করা হয়েছে নিউইয়র্ক ও নিউজার্সির বেশ কয়েকটি ফ্লাইট ও ট্রেন। ইতোমধ্যেই নিউইয়র্ক শহর, ব্রুকলিন, কুইনস ও লং আইল্যান্ডের কিছু অংশে ‘জরুরি বন্যা পরিস্থিতি’ ঘোষণা করা হয়েছে। ম্যাসাচুসেটস ও রোড আইল্যান্ডের কয়েকটি অংশে টর্নেডো সতর্কতা জারি হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের উত্তরপূর্বাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকায় হ্যারিকেন আইডার প্রভাবে ৮টি টর্নেডো আঘাত হেনেছে। বন্যার ক্ষতি কেমন হয়েছে, এর কিছু ছবি প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের গণমাধ্যমগুলো। এসব ছবির একটিতে দেখা যায়, মিসিসিপিতে ঘূর্ণিঝড় আইডার ফলে সৃষ্ট বন্যায় ভেসে গেছে অনেক এলাকা, বিশেষ করে সমুদ্রতীরবর্তী এলাকা। একতলা অনেক বাড়ি ডুবে গেছে। ডুবে গেছে সড়কও। ফলে অনেকে পানিবন্দী হয়ে পড়েছে।
নিউইয়র্ক সিটির মেয়র বিল ডি ব্লাজিও সেখানকার পরিস্থিতিকে বড় ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয় বলে আখ্যা দিয়েছেন। আর নিউ জার্সির গভর্নর ফিল মারফি অঙ্গরাজ্যের বাসিন্দাদের ঘরে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন।
দাবানলে পুড়ছে ক্যালিফোর্নিয়া
এদিকে দু’মাস ধরে চলা টানা দাবানলের কারণে ক্যালিফোর্নিয়াতেও জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, গত সপ্তাহে হোয়াইট হাউস থেকে ক্যালিফোর্নিয়ায় জরুরি অবস্থা জারির ঘোষণা দেওয়া হয়। আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশন থেকেও ক্যালিফোর্নিয়ার এই দাবানলের ধোয়া দেখা যাচ্ছে।
ধারণা করা হচ্ছে, এবারের দাবানল গত বছরের দাবানলকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। পাশাপাশি এবারের দাবানলকে অঙ্গরাজ্যটির ইতিহাসে অষ্টম বৃহত্তম বলে উল্লেখ করা হচ্ছে।
ক্যালডর ফায়ারে ইতিমধ্যে দুই লাখ একর বনভূমি পুড়ে গেছে। সূত্র মতে, গত ১৪ আগস্ট সেখানে দাবানল শুরু হয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে সেখানে অগ্নিনির্বাপণ বিভাগের কর্মীদের মোতায়েন করা হয়েছে। এসব এলাকা থেকে প্রায় ৫০ হাজার মানুষকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্য সরকারের দেওয়া তথ্য অনুসারে, দুটি কাউন্টিতে এই দাবানল এখন জ্বলছে। এই আগুন এখন নেভাডার দিকে ছুটছে। ফলে সেখানকার বাসিন্দাদের সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এই দাবানলে ইতিমধ্যে ৬০০টির বেশি ভৌত অবকাঠামো ধ্বংস হয়েছে। বিবিসি বলছে, এই দাবানলের কারণে ঝুঁকিতে পড়েছে প্রায় ৩২ হাজার ভবন।
এর আগে ক্যালিফোর্নিয়ার উত্তরাঞ্চলে আরেকটি দাবানল শুরু হয়েছিল জুলাইয়ের মাঝামাঝি। গত দুই মাস ধরে চলা এই দাবানলে প্রায় ৮ লাখ ৬৫ হাজার ৭০৩ একর এলাকা পুড়ে গেছে।
ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্য সরকারের দেওয়া তথ্য অনুসারে, পাঁচটি কাউন্টিতে এই দাবানল এখন জ্বলছে। ৪৯ দিন ধরে জ্বলছে এই আগুন। শুধু ক্যালিফোর্নিয়া কিংবা নেভাডা নয়, কদিন আগে পুড়েছে অ্যারিজোনাও।
জলবায়ু পরিবর্তন এবং সংখ্যালঘুদের ভোগান্তি
যুক্তরাষ্ট্রের বন্যার জন্য প্রেসিডেন্ট বাইডেন বৈশ্বিক উষ্ণায়নকে দায়ী করেছেন। আর দাবানলের উপর দেশটির এনভায়রনমেন্টাল প্রটেকশন এজেন্সি (ইপিএ) নতুন একটি প্রতিবেদন দিয়েছে। এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে সংখ্যালঘুরা।
ইপিএর গবেষণায় উঠে এসেছে, বন্যার ঝুঁকিতে থাকা এলাকাগুলোতে মূলত যুক্তরাষ্ট্রের আদিবাসীদের (নেটিভ) বসবাসের প্রবণতা বেশি। উল্টো দিকে দাবদাহে মৃত্যু যেদিকে বেশি হয়, সেই দিকেও আফ্রিকান-আমেরিকানদের বসবাসের প্রবণতা বেশি।
এই গবেষণা প্রতিবেদন এমন সময়ে প্রকাশ করা হলো, যার কদিন আগে যুক্তরাষ্ট্রে ঘূর্ণিঝড় আইডা আঘাত হেনেছে। আর এর আঘাতে লুইজিয়ানা ও মিসিসিপিতে কৃষ্ণাঙ্গ ও নিম্ন আয়ের মানুষের ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে ইপিএর পরিচালক মাইকেল রিগান বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের ফল আমরা এখন পেতে শুরু করেছি। দাবানল বা দাবদাহ থেকে শুরু করে ভয়াবহ বন্যা, ঘূর্ণিঝড়; সবই আঘাত হানছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এই পরিস্থিতির আরও অবনতি হবে। মানুষ প্রস্তুতির খুব কম সময়ই পাবে।’
ওয়াশিংটন পোস্টের খবরে বলা হয়েছে, বর্ণভেদে যারা সংখ্যালঘু, বৈশ্বিক উষ্ণায়নে তারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দাবদাহে তারা মারা পড়বে বেশি। আবার সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতার বৃদ্ধির ফলে তারাই বেশি সম্পদ হারাবে।
সাম্প্রতিক সময়েই গ্রীস, যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যসহ উত্তর আমেরিকার কিছু অঞ্চল, কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়া অঙ্গরাজ্য, তুরস্ক, আলজেরিয়াতে ভয়াবহ দাবানল ছড়িয়ে পড়েছে। ইউরোপ থেকে আস্তে আস্তে আফ্রিকার দিকে দাবানল ছড়িয়ে পড়ছে।
বিজ্ঞানীরা বলেছেন, ২০০৩ সালের পর চলতি বছরের মাঝামাঝি পর্যন্ত এমন দাবানল বিশ্বে আর হয়নি। তীব্র দাবদাহ আর দীর্ঘ খরার কারণে দাবানল সৃষ্টি হয়েছে। এতে বনাঞ্চল ও তৃণভূমি পুড়ে বায়ুমণ্ডলে ৩৪৩ মেগাটন কার্বন নিঃসরণ হয়েছে, যা পরিবেশ সুরক্ষায় বড় হুমকি হয়ে উঠতে পারে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৫০৫
আপনার মতামত জানানঃ