দেশে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তালিবান। এখন তারা মুখে যতই নরম কথা বলুক, ভোল পাল্টাতে বিন্দুমাত্র সময় নেবে না, এমন আশঙ্কা রয়েছে অধিকাংশ আফগানবাসীরই। তালিবান রাজ শুরু হতেই আফগানিস্তানজুড়ে শঙ্কায় নারীরা। ভয়ে আতঙ্কে কাটছে তাদের প্রতি ক্ষণ। তাই মেয়েদের সুরক্ষার জন্যই আফগানিস্তানের একমাত্র মেয়েদের স্কুল ‘অল গার্লস বোর্ডিং স্কুল’ এর ছাত্রীদের সমস্ত রেকর্ড পুড়িয়ে দিলেন স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা শাবানা বাসিজ-রসিক নিজেই। যাতে এসব নথি ধরে ধরে শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবারকে তালিবান হানা দিতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে চান স্কুল কর্তৃপক্ষ।
স্কুল অব লিডারশিপ আফগানিস্তানের (এসওএলএ) অধ্যক্ষ শাবানা বাসিজ-রসিক টুইটারে নথি পোড়ানোর ভিডিও শেয়ার দিয়েছেন। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই এমন পদক্ষেপ নিয়েছেন বলে দাবি করেন এই শিক্ষিকা।
তিনি বলেন, ফের নারীশিক্ষার উপর আঘাত নেমে আসতে চলেছে। তালিবান আমলে মেয়েদের উন্নতি এবং শিক্ষা কতদূর এগোবে তা নিয়ে সংশয় আছে। ছাত্রীদের কথা মনে পড়লে অসহায় লাগে বলেও তিনি জানান।
আফগানিস্তানে যে হারে মেয়েদের অত্যাচারের ছবি ধরা পড়ছে তাতে পরিষ্কার সেখানে তারা কোনোভাবেই নিরাপদ বা সুরক্ষিত নয়। তাই স্কুলের এত জন মেয়েদের তালিকা এবং তাদের সমস্ত তথ্য তালিবানদের হাতে গেলে কী হতে পারে, তা ভেবেই আতঙ্কিত হচ্ছিলেন শাবানা৷ নিজের টুইটে সেই আতঙ্কের কথাই জানিয়েছেন শাবানা৷
গোটা আফগানিস্তানে ওই একটিই মেয়েদের স্কুল। আর সেই স্কুলের ভবিষ্যৎ এবার বিশ বাঁও জলে। স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা শাবানা বাসিজ-রসিক তার টুইটারে ছাত্রীদের রেকর্ড পোড়ানোর বিষয়ে লেখেন, ”আফগানিস্তানের একমাত্র মেয়েদের বোর্ডিং স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে আমি সমস্ত ছাত্রীর রেকর্ড পুড়িয়ে দিলাম। ছাত্রীদের মুছে ফেলতে নয়, তাদের ও তাদের পরিবারকে রক্ষা করতে। আমি এই বিবৃতি দিচ্ছি মূলত আমাদের ছাত্রীদের পরিবারকে এটা বোঝাতে যে, আমরা এই রেকর্ড পোড়ালাম আমাদের ছাত্রীদের ও আমাদের সমর্থকদের নিরাপত্তা দিতে।”
আগুনে পোড়ানোর ভিডিওর পোস্টে তাকে আক্ষেপ করতে দেখা গিয়েছে, ”২০০২ সালের মার্চে তালিবানের পতনের পরে হাজার হাজার আফগান মেয়েকে নিকটবর্তী স্কুলে ভর্তি হতে পরীক্ষা দিতে হয়েছিল। কেননা তালিবান সমস্ত ছাত্রীর রেকর্ড পুড়িয়ে দিয়েছিল। তাদের মধ্যে আমিও ছিলাম।”
তবে নারীশিক্ষা নিয়ে তার লড়াই যে এর পরেও চলবে, সে কথাও জানিয়ে রেখেছেন শাবানা। বলেন, যে সব আফগান মরিয়া হয়ে দেশ ছাড়ছেন, এখন সেই মর্মান্তিক নাটকীয়তার দিকে নজর রয়েছে পৃথিবীর। কিন্তু যে সব আফগান মেয়ে দেশ ছেড়ে যেতে পারল না, তাদের শিক্ষায় বিনিয়োগের জন্য যে আগুন আমার মধ্যে জ্বলছে, তা দিনে দিনে আরও উজ্জ্বল এবং সোচ্চার হচ্ছে।’
”আফগানিস্তানের একমাত্র মেয়েদের বোর্ডিং স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে আমি সমস্ত ছাত্রীর রেকর্ড পুড়িয়ে দিলাম। ছাত্রীদের মুছে ফেলতে নয়, তাদের ও তাদের পরিবারকে রক্ষা করতে। আমি এই বিবৃতি দিচ্ছি মূলত আমাদের ছাত্রীদের পরিবারকে এটা বোঝাতে যে, আমরা এই রেকর্ড পোড়ালাম আমাদের ছাত্রীদের ও আমাদের সমর্থকদের নিরাপত্তা দিতে।”
তিনি এবং তার স্কুলের ছাত্রীরা আপাতত নিরাপদেই রয়েছে, সে কথা জানিয়ে শাবানা লিখেছেন, ‘এখনও কিন্তু অনেক মেয়েই বিপদের মুখে রয়েছে। অনেকে আর নিরাপদ বোধ করছে না। ওদের কথা ভেবে আমার হৃদয় বিধ্বস্ত।’
তবে তার ছাত্রীদের নিরাপত্তার কথা ভেবেই এর বেশি আর কিছু লিখতে চাননি শাবানা। নিজের স্কুল ‘সোলা’র জন্য অনুদানও চেয়েছেন শাবানা। আফগান-ভূমিকে ‘সোলা’ শব্দের অর্থ শান্তি। যা দ্রুত ফিরবে, এই বিশ্বাসে বুক বাঁধছেন শাবানা।
আফগানিস্তানে ক্রমশই দৃঢ় হচ্ছে শাসক তালিবানের মুঠি। ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে ফতোয়া দেওয়া। শুরুতে তারা জানিয়েছিল, শরিয়তে নারীদেরও অধিকার আছে। তাদের নিরাপত্তায় তালিবান যথেষ্ট যত্নবান। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পড়াশোনা করতে পারবে দেশের মেয়েরা।
কিন্তু দিন ঘুরতে না ঘুরতেই কথায় আর কাজে আকাশ-পাতাল তফাৎ দেখিয়ে দিল জঙ্গিবাহিনী। এবার তারা কো-এড স্কুলে অর্থাৎ ছেলেমেয়ের একসঙ্গে পড়াশোনা বন্ধ করার ফতোয়া জারি করে ফেলেছে। এই পরিস্থিতিতে এবার স্কুলের মেয়েদের স্কুল রেকর্ড পোড়ানোর পথে হাঁটতে হল শাবানাকে।
তিনি বুঝতে পেরেছেন, অন্ধকার থেকে আলোয় ফেরার পথে আবারও উল্টো দিকে হাঁটতে শুরু করেছে ইতিহাস। ফের অন্ধকারে ঢোকার আগেই তাই আগুন জ্বালালেন তিনি। স্কুলের মেয়েদের নিরাপত্তা দিতেই।
আফগানিস্থানে মূলত দুই ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলিত। প্রথমত কো-এডুকেশন ব্যবস্থা। দ্বিতীয়তঃ ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য পৃথক ক্লাস রুমের ব্যাবস্থা। যদিও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে এই দু-ধরনের ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলিতে সীমিত সংখ্যক ছাত্রী হওয়ায় সেখানে পৃথক ক্লাস রুমের ব্যাবস্থা করা যাবে না বলে জানানো হয়েছে। যার ফলে আগামী দিনে উচ্চশিক্ষা লাভের ক্ষেত্রে বঞ্চিত হতে পারেন ছাত্রীরা। এমনটাই মনে করছে সংশ্লিষ্ট মহল।
হেরাতের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে পৃথক ক্লাসের ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়। সেই কারণেই হাজারের ওপর ছাত্রী আগামী দিনে উচ্চ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হবে বলেই মনে করছেন সেখানকার শিক্ষক মহল। ফলে ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে দেশটিতে নারী শিক্ষার প্রসার। প্রতিষ্ঠিত সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মিলিয়ে মোট ৪০ হাজারের ওপর পড়ুয়া রয়েছে। প্রদেশ শিক্ষকের সংখ্যা বর্তমানে দুই হাজারের ওপর।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭৫৩
আপনার মতামত জানানঃ