করোনার সংক্রমণের কারণে দুই বছর ধরে বন্ধ রয়েছে পঞ্চগড়ের ছোট বড় অর্ধশতাধিক হস্তশিল্প কারখানা। বন্ধ আছে তাঁতের শাড়ি, থ্রিপিস, ওড়না ও পরচুলা কিংবা নকল চুল তৈরি। মালামাল তৈরি না হওয়ায় পাইকারি ব্যবসায়ীরা আসছেন না, বকেয়া টাকাও দিচ্ছেন না। এ অবস্থায় অর্থ সংকটে পড়েছেন মালিক ও শ্রমিকরা।
অভাবে সংসার চালাতে পারছেন না অনেক শ্রমিক। মালিকরা পাননি সরকারি সহায়তা ও সুদবিহীন ঋণ। সংকট চরম আকার ধারণ করায় দিশেহারা তারা। জেলার অর্ধশতাধিক কারখানায় কাজ করেন প্রায় ১০ হাজার শ্রমিক। লকডাউনের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত সব কারখানা বন্ধ।
থমকে গেছে প্রাণচাঞ্চল্য। বেকার হয়ে পড়েছেন শ্রমিকরা। লোকসানে পড়েছেন কারখানা মালিকরা। সবমিলে তাদের ক্ষতি কয়েক কোটি টাকা। অভাবে সংসার চালাতে পারছেন না অনেক শ্রমিক, মালিকরা পাননি সরকারি সহায়তা ও সুদবিহীন ঋণ।
সারা বছর তাঁত বস্ত্র ও পরচুলা বানিয়ে সংসার চালান। মালিক ও শ্রমিকদের সবকিছু ওলট-পালট করে দিয়েছে করোনা। দীর্ঘদিন কারখানা বন্ধ থাকায় মালিকরা পুঁজি হারিয়েছেন। এখন কারখানা চালু করতে পারছেন না। অন্যদিকে উৎপাদনের পাশাপাশি আয় বন্ধ হয়ে পড়ায় শ্রমিকরা বিপর্যস্ত। মানবেতর জীবনযাপন করছেন তারা।
দেবীগঞ্জ উপজেলার তাঁত কারখানা মেসার্স টাচ ফ্যাশনের শ্রমিক লাভলী বেগম ও রেশমা শাহনাজ জানান, স্বামী-স্ত্রী মিলে কারখানায় কাজ করে যা আয় হতো তা দিয়ে সংসার চলতো। দীর্ঘ দুই বছর ধরে কারখানা বন্ধ। কাজ নেই। ছেলেমেয়ে নিয়ে সংসার চালাতে পারছি না। সরকারিভাবে খাদ্য সহায়তাও পাইনি। গরু ছাগল সব বিক্রি করেছি। ধারদেনা করে খেয়ে না খেয়ে জীবনযাপন করছি।
ওই একই কারখানার শ্রমিক সুরতজাল, আমিনুল ও আনছারুল জানান, কাজ করলে আয় হয়। কিন্তু করোনার কারণে কারখানা বন্ধ। ঘর থেকে বের হতে পারছি না। সংসার চলে না। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে একবেলা ভালোমতো খেতে পারি না। আমাদের কেউ সহায়তাও করে না।
হ্যান্ড টাচ কারখানার শ্রমিক কিয়ামউদ্দিন ও রোমানা জানান, করোনায় অসহায় মানুষকে সরকারিভাবে ত্রাণ দেওয়া হয়েছে। অথচ আমরা কিছুই পাইনি। খেয়ে না খেয়ে দিন চলছে।
দেবীগঞ্জ উপজেলার তাঁত কারখানা মেসার্স টাচ ফ্যাশনের ব্যবস্থাপক মো. রাশিদুল ইসলাম বলেন, আমার কারখানায় দুই শতাধিক শ্রমিক কাজ করতো। করোনার কারণে মহাজনরা বকেয়া টাকা দিচ্ছে না। কারখানায় প্রায় ৩০ লাখ টাকার তৈরি পোশাক ও কাঁচামাল পড়ে আছে। বিক্রি করতে পারছি না। করোনার কারণে কারখানা চালু করতে পারছি না। ফলে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা দিতে পারছি না। আমাদেরই চলতে কষ্ট হয়।
দেবীগঞ্জ উপজেলার সুন্দরদিঘী ইউনিয়নের রায়হান হেয়ার ইন্টারন্যাশনাল কারখানার সুপারভাইজার অনন্ত রায় বলেন, আমার পরচুলার কারখানায় তিন শতাধিক শ্রমিক কাজ করতো। করোনার কারণে দীর্ঘদিন ধরে কারখানা বন্ধ। কারখানার পরচুলা চীনে যায়। করোনার কারণে বিদেশিরা আসতে পারছে না। উৎপাদন বন্ধ, ক্রেতা নেই। এ কারণে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা দিতে পারছি না। কারখানার মেশিন ও জিনিসপত্র নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
দেবীগঞ্জের তাঁত কারখানা হ্যান্ড টাচের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলী খান বলেন, করোনায় ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছি। ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারবো কিনা জানি না। কারখানা চালু করতে না পারলে আরও বেশি ক্ষতির মুখে পড়তে হবে। কাজ বন্ধ থাকায় উৎপাদন বন্ধ। কাজ নেই, আয়ও নেই। এ কারণে শ্রমিকরাও চরম দুর্ভোগে পড়েছে। সংকট নিরসনে সরকারি সহযোগিতা চাই আমরা।
মেসার্স টাচ ফ্যাশনের চেয়ারম্যান আব্দুল মজিদ বলেন, করোনায় আমি নিঃস্ব হয়ে গেছি। হাতে কোনও টাকা নেই। পুঁজি ছাড়া প্রতিষ্ঠান চালু করা সম্ভব না। ঋণ প্রস্তাব নিয়ে কর্মসংস্থান ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া, ইসলামী ব্যাংক, মার্কেন্টাইল ব্যাংকে একাধিকবার ধরনা দিয়েছি। ঋণ প্রস্তাব ফেরত দিয়েছে তারা। কেউ ঋণ দেয়নি। সবদিক দিয়ে আমরা লোকসানে পড়েছি। বন্ধ কারখানা চালু করতে হলে পুঁজির প্রয়োজন। আমাদের এখন পুঁজি নেই। সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া আমাদের ঘুরে দাঁড়ানোর উপায় নেই।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) পঞ্চগড়ের উপ-ব্যবস্থাপক শাহ মোহাম্মদ জোনায়েদ বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত কারখানা মালিকদের তালিকা করে সরকারের পক্ষ থেকে প্রণোদনা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে।
সফট টাচ কারখানার মালিক মো. সাইফুর আলম জানান, তার প্রতিষ্ঠান কাপড় উৎপাদনের পাশাপাশি প্রশিক্ষণ দেয়। খুচরা ও পাইকারি কাপড় বিক্রি করতে না পারায় বিপাকে পড়েছেন তিনি। জমানো টাকা শেষ। এখন হাত খালি। উৎপাদন শুরু হলে পাইকারি ও খুচরা কাপড় বিক্রি করা সম্ভব হবে। এ পর্যন্ত ১০ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে তার।
আপনার মতামত জানানঃ