করোনা মহামারীতেও থেমে নেই জঙ্গীদের কার্যকলাপ। গোটা দেশ যখন করোনা আতঙ্কে তখন এই সুযোগে উগ্রবাদী কিছু সংগঠন মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের কক্সবাজারের ক্যাম্পে সহায়তার নামে উগ্রবাদ মতাদর্শ প্রচারে লিপ্ত। এ জন্য দেশ ও বিদেশ থেকে সাদকা ও যাকাত সংগ্রহ করার আড়ালে জঙ্গী অর্থায়ন করে আসছে। সেই সংগঠনগুলোর শীর্ষ নেতাদের ক্যাম্প পরিদর্শনের প্রমাণ পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। মিয়ানমারের মতাদর্শী কিছু গোষ্ঠী এসব সংগঠনকে সহযোগিতা করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে নতুন শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে।
গত মাসে র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হয় আনসার আল ইসলামের আধ্যাত্মিক নেতা মাহমুদ হাসান গুনবি। দেশীয় জঙ্গিবাদের অন্যতম শীর্ষ নেতাদের একজন তিনি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আরো দুই সহযোগীসহ বছরের শুরুর দিকে উখিয়ার দু’টি রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেন আনসার আল ইসলামের এ আধ্যাত্মিক নেতা। সেখানে সদস্য সংগ্রহের চেষ্টা করেন।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, বিভিন্নভাবে ‘দাওয়াত’ এর মাধ্যমে বেশ কিছু ব্যক্তিকে ব্রেইনওয়াশ করেছে গুনবি। সম্প্রতি তার রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনের প্রমাণ মিলেছে।
সূত্রে জানা গেছে, ক্যাম্পের বাইরে টেকনাফের পাহাড়ি এলাকায় মিয়ানমারের বিভিন্ন উগ্রবাদী সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন গুনবি। সেখানে ছিল আরাকান রোহিঙ্গা সলিডারিটি, আরাকান পিপলস আর্মি, আরাকান মুজাহিদ পার্টিসহ কয়েকটি সংগঠনের নেতারা। এছাড়াও সীমান্তবর্তী এলাকায় রোহিঙ্গা নেতাদের সঙ্গে কয়েকটি জঙ্গি সংগঠনের নেতা একাধিক বৈঠক করেছেন বলেও খবর পাওয়া গেছে।
ডিএমপি’র কাউন্টার টেররিজম ও ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান আসাদুজ্জামান বলেন, মিয়ানমার বা আরাকান ভিত্তিক যে সংগঠনগুলো বিদ্যমান রয়েছে তাদেরও এরকম দুই-একটা উগ্রবাদী সংগঠন আছে, যাদের উদ্দেশ্য ওই এলাকার জঙ্গি বা উগ্রবাদী সংগঠনগুলোর সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করা। যাতে তারা সাংগঠনিকভাবে একে অপরকে সাহায্য করতে পারে। তবে তারা এখনও সুবিধা করে উঠতে পারেনি। তবে আটককৃত গুনবি এ উদ্দেশ্যেই সেখানে গিয়েছিল।
রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে উগ্রবাদে দীক্ষিত করা ঠেকাতে সতর্ক অবস্থায় আছে প্রশাসন। জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানান কর্মকর্তারা।
জাতীয় নিরাপত্তা সেলের প্রধান নির্বাহী আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, আর্থিক লোভ দেখিয়ে জঙ্গি রিক্রুট করা খুবই সহজ। জঙ্গিরা সে চেষ্টাই করছে বলে আমাদের কাছে তথ্য রয়েছে। রোহিঙ্গারা যাতে উগ্রবাদের সঙ্গে জড়িয়ে না পড়ে সেজন্য প্রয়োজনীয় নজরদারি, পাহারা ও তথ্য সংগ্রহের কার্যক্রম চালু রয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে সব সংস্থা একযোগে কাজ করছে বলেও জানান এ কর্মকর্তা।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে জঙ্গি তৎপরতা
গণমাধ্যমের অনুসন্ধানে জানা যায়, কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে বর্তমানে চারটি জঙ্গি সংগঠন তৎপরতা চালাচ্ছে। এদের মধ্যে রয়েছে পুরনো দুই জঙ্গি সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) ও রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও)। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ইসলামী মাহাজ এবং জমিউয়তুল মুজাহিদীন নামে নতুন দুই সংগঠন।
৩২টি শরণার্থী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মধ্যে ২৭টিতে রয়েছে আরসার আধিপত্য। এ সংগঠনের নেতৃত্বে রয়েছেন সৌদি আরবে বেড়ে ওঠা পাকিস্তানি নাগরিক আবু আম্মর জুনুনী ওরফে আতাউল্লাহ। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের প্রত্যেক ব্লকে রয়েছে এ সংগঠনের তৎপরতা। এ সংগঠন ‘ওলামা কাউন্সিল’, ‘ওলামা বোর্ড’, ‘মজলিসে আম’ এবং ‘আরকান আরমট’ এ পাঁচ শ্রেণিতে বিভক্ত হয়ে ক্যাম্পগুলোতে তৎপরতা চালাচ্ছে।
আরসা ভেঙে নতুন আরেকটি গ্রুপ তৈরি করেছেন মুন্না নামে এক নেতা। আতাউল্লাহর এক সময়ের সহযোগী মুন্না আরসা থেকে বের হয়ে তৎপরতা চালাচ্ছেন ক্যাম্পের কিছু কিছু ব্লকে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তৎপর রয়েছে ইসলামী মাহাজ নামে আরেকটি সংগঠন। পাঁচ শরণার্থী ক্যাম্পে রয়েছে নতুন সংগঠনটির তৎপরতা। এ সংগঠনের নেপথ্যে রয়েছেন জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ বার্মার কয়েকজন নেতা। এ সংগঠনের আমির শেখ সালামত নামে এক ব্যক্তি।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তৎপর আরেক জঙ্গি সংগঠন ‘আরএসও’র নেতৃত্বে রয়েছেন দুই পাকিস্তানি নাগরিক হাফেজ সালাহুল ইসলাম এবং মাওলানা মোহাম্মদ আতাউল্লাহ। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে এ সংগঠনটি ফের ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। জমিউয়তুল মুজাহিদীন নামে আরেকটি জঙ্গি সংগঠন তৎপরতা শুরু করেছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। এ সংগঠনটির নেপথ্যে রয়েছেন মাওলানা হানিফ রাগেব নামে এক ব্যক্তি।
এ চার জঙ্গি সংগঠনের অর্থায়ন হয় সৌদি আরব, আরব আমিরাত, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও ইন্দোনেশিয়া থেকে। মূলত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তৎপর বিভিন্ন এনজিও, হুন্ডির মাধ্যমে এসব দেশ থেকে আসা টাকা সংগঠনগুলোর কাছে পৌঁছানো হয়।
পরিস্থিতি নিয়ে মুখ খুলতে চান না প্রশাসনের কোনো কর্মকর্তা। তবে সম্প্রতি দেওয়া এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে জঙ্গি সংগঠনগুলোর তৎপরতার কথা।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অবস্থানকারী আলেমদের টার্গেট করে কাজ করছে জঙ্গি সংগঠনগুলো। তারা আলেমদের তুলে নিয়ে জঙ্গি সংগঠনগুলোর পক্ষে ‘ফতোয়া’ দেওয়ার জন্য চাপ দেয়। যেসব আলেম তাদের মতের বিরোধিতা করেন, তাদের ওপর চালানো হয় অমানুষিক নির্যাতন। এ ছাড়া জঙ্গি সংগঠনগুলো জাল নোট এবং ইয়াবা ব্যবসায় লগ্নি করছে। এ দুই খাত থেকে আসা টাকা-পয়সা সাংগঠনিক কাজে ব্যয় করা হচ্ছে।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অবস্থানকারী আলেমদের টার্গেট করে কাজ করছে জঙ্গি সংগঠনগুলো। তারা আলেমদের তুলে নিয়ে জঙ্গি সংগঠনগুলোর পক্ষে ‘ফতোয়া’ দেওয়ার জন্য চাপ দেয়। যেসব আলেম তাদের মতের বিরোধিতা করেন, তাদের ওপর চালানো হয় অমানুষিক নির্যাতন। এ ছাড়া জঙ্গি সংগঠনগুলো জাল নোট এবং ইয়াবা ব্যবসায় লগ্নি করছে। এ দুই খাত থেকে আসা টাকা-পয়সা সাংগঠনিক কাজে ব্যয় করা হচ্ছে। তাদের এমন কাজকর্মকে অশনিসংকেত হিসেবে দেখছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা।
বিশ্লেষকরা বলেন, ‘সরকারের উচিত মাথাচাড়া দেওয়ার আগে রোহিঙ্গা জঙ্গি সংগঠনগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা। নইলে এসব সংগঠন বাংলাদেশের জন্য হুমকি হয়ে উঠবে।’
রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ এখনও কঠোর অবস্থান না নিলে পরিস্থিতি আরও জটিল হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোকে ঘিরে নানা ধরনের সন্ত্রাসী ও জঙ্গি তৎপরতা, দেশি-বিদেশি বিভিন্ন গোষ্ঠীর উস্কানি ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের খবর ইতোমধ্যেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে আসতে শুরু করেছে। এসব অপতৎপরতা দীর্ঘমেয়াদে এই অঞ্চলের জন্য হুমকি হয়ে উঠবে।
আরও বলেন, এসব বিষয় বিবেচনায় রেখে রোহিঙ্গা ক্যাম্পকে আরও বেশি গোয়েন্দা নজরদারির আওতায় আনা এবং তাদের প্রত্যাবাসনে যথাযথ ভূমিকা গ্রহণ করতে সরকারের সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮১২
আপনার মতামত জানানঃ