জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বিপাকে দেশের শিশুরা। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বয়স্ক ব্যক্তিদের চেয়ে বেশি ঝুঁকিতে শিশুরা। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার চার দেশের শিশুরা অতি উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে ইউনিসেফ। এতে বলা হয়েছে, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশের শিশুরা তাপপ্রবাহ ও বন্যার মতো জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকির ক্ষেত্রে অত্যন্ত অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে।
এই অঞ্চলে খরা, বন্যা, বায়ু দূষণ ও নদী ভাঙনের কারণে লাখ লাখ শিশু গৃহহীন ও ক্ষুধার্ত এবং কোনো স্বাস্থ্যসেবা ও পানিবিহীন অবস্থায় রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন ও কোভিড-১৯ মহামারি একসঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার শিশুদের জন্য একটি উদ্বেগজনক সঙ্কট তৈরি করেছে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ইউনিসেফ।
সংস্থাটি বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনে এসব দেশের শিশু ও তরুণদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সুরক্ষা হুমকির মুখে পড়েছে।
শুক্রবার ‘জলবায়ু সংকট কার্যত শিশু অধিকারের সংকট’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে প্রথমবারের মতো শিশুদের জলবায়ু ঝুঁকি সূচক (সিসিআরআই) প্রবর্তন করে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ইউনিসেফ। এই সূচক বিশ্লেষণে দেখা যায়, বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান শিশুদের জন্য ‘অত্যন্ত উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ’ দেশের তালিকায় পড়েছে।
এই সূচকে ‘অত্যন্ত উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ’ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত ৩৩টি দেশে বসবাস করে প্রায় ১০০ কোটি শিশু।
জলবায়ু ও পরিবেশগত অবস্থা এবং তাতে শিশুদের ঝুঁকি বিশ্লেষণ করে শূন্য থেকে ১০ ভিত্তিক স্কেলে ঝুঁকির মাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ওই দুই নির্ণায়ক মিলিয়েই তৈরি হয়েছে শিশুদের জলবায়ু ঝুঁকি সূচক। এই সূচকে যে দেশের পয়েন্ট যত বেশি, সেই দেশের শিশুরা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তত বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে বলে ধরে নিতে হবে।
ইউনিসেফের প্রতিবেদনে বলা হয়, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, আফগানিস্তান ও ভারত— দক্ষিণ এশিয়ার এই চার দেশে শিশুরা জলবায়ু সংকটের প্রভাবসমূহের শিকার হওয়ার অত্যন্ত উচ্চ ঝুঁকিতে আছে। এই চার দেশের অবস্থান যথাক্রমে ১৪, ১৫, ১৫ ও ২৬ নম্বরে। নেপালের অবস্থান ৫১, শ্রীলঙ্কা আছে ৬১তম স্থানে। ভুটান আছে ১১১তম অবস্থানে, যেখানে শিশুরা অপেক্ষাকৃত কম ঝুঁকিতে আছে। প্রায় ১০০ কোটি শিশু ‘অত্যন্ত উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে চিহ্নিত করা ৩৩টি দেশে বসবাস করে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, দক্ষিণ এশিয়ার এই শিশুরা নদীবাহিত বন্যা ও বায়ু দূষণের কারণে ক্রমাগত বিপদের মধ্যে রয়েছে। এতে উঠে এসেছে যে, শিশু স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও শিক্ষার পেছনে বিনিয়োগ করা হলে তা জলবায়ু পরিবর্তন থেকে শিশুদের সুরক্ষায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ায় ৬০ কোটিরও বেশি শিশুর বসবাস এবং বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক তরুণ জনগোষ্ঠীর বসবাসও এই অঞ্চলে। বৈশ্বিকভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবজনিত কারণে সবচেয়ে ঝুঁকির মুখে থাকা দেশগুলোর মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো রয়েছে।
ইউনিসেফের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, দক্ষিণ এশিয়ার শিশুরা বন্যা ও বায়ু দূষণের কারণে বিপদের মধ্যে রয়েছে। একটি বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠার আগেই তারা আরেকটি বিপর্যয়ের শিকার হচ্ছে, যা অর্জিত সব অগ্রগতিকে উল্টে দিচ্ছে। বাংলাদেশসহ ‘অত্যন্ত উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে চিহ্নিত ৩৩টি দেশ বিশ্বজুড়ে নিঃসরিত কার্বন-ডাই-অক্সাইডের মাত্র ৯ শতাংশের ভাগীদার। অন্যদিকে, মাত্র ১০টি দেশ বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণের ৭০ শতাংশের জন্য দায়ী। শিশু স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও শিক্ষার পেছনে আরও বেশি বিনিয়োগ করা হলে তা জলবায়ু পরিবর্তন থেকে শিশুদের সুরক্ষায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনতে পারে বলে সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
এ বিষয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় ইউনিসেফের আঞ্চলিক পরিচালক জর্জ লারিয়া-আদজেই বলেন, ‘প্রথমবারের মতো দক্ষিণ এশিয়ার লাখ লাখ শিশুর ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের সুস্পষ্ট প্রমাণ আমরা পেয়েছি। এই অঞ্চলে খরা, বন্যা, বায়ু দূষণ ও নদী ভাঙনের কারণে লাখ লাখ শিশু গৃহহীন ও ক্ষুধার্ত এবং কোনো স্বাস্থ্যসেবা ও পানিবিহীন অবস্থায় রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন ও কোভিড-১৯ মহামারি একত্রে দক্ষিণ এশিয়ার শিশুদের জন্য একটি উদ্বেগজনক সঙ্কট তৈরি করেছে। এখনই পদক্ষেপ গ্রহণের সময়— আমরা যদি পানি, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার পেছনে বিনিয়োগ করি, তাহলে পরিবর্তনশীল জলবায়ু এবং অবনতিশীল পরিবেশের প্রভাব থেকে তাদের ভবিষ্যতকে আমরা রক্ষা করতে পারি।’
দক্ষিণ এশিয়ার শিশুরা বন্যা ও বায়ু দূষণের কারণে বিপদের মধ্যে রয়েছে। একটি বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠার আগেই তারা আরেকটি বিপর্যয়ের শিকার হচ্ছে, যা অর্জিত সব অগ্রগতিকে উল্টে দিচ্ছে। বাংলাদেশসহ ‘অত্যন্ত উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে চিহ্নিত ৩৩টি দেশ বিশ্বজুড়ে নিঃসরিত কার্বন-ডাই-অক্সাইডের মাত্র ৯ শতাংশের ভাগীদার। অন্যদিকে, মাত্র ১০টি দেশ বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণের ৭০ শতাংশের জন্য দায়ী।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব থেকে শিশুদের রক্ষা করার জন্য ইউনিসেফ বেশকিছু সুপারিশ জানিয়েছে।
শিশুদের জন্য মূল পরিষেবাগুলোতে জলবায়ু অভিযোজন এবং স্থিতিস্থাপকতার পেছনে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে।
গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমাতে। ২০৩০ সাল নাগাদ উষ্ণতা বৃদ্ধির মাত্রা যাতে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি না হয় তা নিশ্চিত করার জন্য দেশগুলোকে তাদের নির্গমন কমপক্ষে ৪৫ শতাংশ (২০১০ সালের মাত্রার তুলনায়) কমাতে হবে।
শিশুদের জলবায়ুবিষয়ক শিক্ষা এবং পরিবেশবান্ধব দক্ষতা শেখাতে, যা জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে তাদের মানিয়ে নেওয়ার জন্য এবং প্রভাব মোকাবিলার প্রস্তুতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
কপ ২৬-সহ সকল জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক জলবায়ু আলোচনা এবং সিদ্ধান্তে তরুণদের অন্তর্ভুক্ত করতে।
কোভিড-১৯ মহামারি কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রক্রিয়া যাতে পরিবেশবান্ধব, স্বল্প-কার্বন নির্ভর ও অন্তর্ভুক্তিমূলক হয় তা নিশ্চিত করতে, যাতে জলবায়ু সংকট মোকাবেলার সামর্থ্যের প্রশ্নে ভবিষ্যত প্রজন্মকে আপোষ করতে না হয়।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ইদানীংকালে খুব বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। যখন বৃষ্টি হওয়ার কথা নয় তখনও বৃষ্টি হচ্ছে। জলবায়ুর এই আমূল পরিবর্তনে অভিযোজন করতে গিয়ে বেশি দুর্যোগের কবলে পড়ছে শিশুরা। জলবায়ু পরিবর্তন মানুষের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার দৈনন্দিন অনুষঙ্গগুলোর গুণগত মান খারাপ করে দেয়। ফলে শিশুরা নানারকম স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির মুখে পড়ে।
তারা বলেন, সারাবিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ প্রভাবের তালিকায় থাকা ওপরের দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। আর জলবায়ু পরিবর্তনের এ ক্ষতিকর প্রভাবের অসহায় শিকারে পরিণত এদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের প্রান্তিক শিশুরা। সম্প্রতি বিশ্বের পরিবেশ বিজ্ঞানীদের ধারণা জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবে ধারণার চেয়েও বেশি ঝুঁকিতে পড়বে উপকূলীয় শিশুরা।
আরও বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় প্রাণে বাঁচার জন্য যেসব পন্থা অবলম্বন করতে হয় তার বেশিরভাগই শিশুদের অজানা। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব থেকে শিশুদের রক্ষা করতে হলে চাই সরকারি ও বেসরকারি সমন্বিত উদ্যোগ।
তারা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের সময় এখনই। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব উপকূলীয় অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ, যেখানে শিশুদের ওপর এর প্রভাব বেশি মারাত্মক। বৈশ্বিক এই সংকট মোকাবিলায় সরকারি-বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর একযোগে কাজের কোনো বিকল্প নেই। সরকারের পাশাপাশি আমরা যদি সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করি, তবেই সম্ভব সব দুর্যোগ মোকাবিলা করে শিশুসহ সবার নিরাপদ জীবন নিশ্চিত করা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৪০
আপনার মতামত জানানঃ