পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসের দিন দেশটির পাঞ্জাব প্রদেশের রাজধানী লাহোরে টিকটকের ভিডিও বানাতে গিয়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে মারাত্মক হয়রানির শিকার হতে হয়েছে এক নারীকে।
সূত্র মতে, বন্ধুদের সঙ্গে টিকটকের ভিডিও বানাচ্ছিলেন ওই নারী। আচমকা তাদের ওপর হামলে পড়ে কয়েক’শ মানুষ। তারা ওই নারীকে ভয়ংকরভাবে টানাহেঁচড়া করতে থাকে, কয়েকজন তাকে শূন্যে তুলে ফেলে, এমনকি কাপড়-চোপড়ও ছিঁড়ে ফেলা হয়।
শেষ পর্যন্ত প্রাণে বেঁচে গেলেও, ওই নারী শারীরিক ও মানসিকভাবে যে মারাত্মক হয়রানির শিকার হতে হয়েছে তাকে- তা বর্ণনাতীত। এরই মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে এর ভিডিও।
ভুক্তভোগী বলেন, ভিড় ছিল বিশাল। মানুষজন জায়গাটি ঘিরে ফেলে আমাদের দিকে আসতে থাকে। একসময় তারা আমাকে টানতে থাকে, ধাক্কা দিতে দিতে কাপড়-চোপড় ছিঁড়ে ফেলে।
তিনি জানান, এমন বিপদের মুহূর্তে কয়েকজন তাকে সাহায্যের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু বিশাল ভিড়ের সঙ্গে তারা পেরে ওঠেননি। পরে আক্রমণকারীরা তাকে শূন্যে ছুঁড়তে থাকে। এসময় ওই নারীর কানের দুল, আংটি, এক সঙ্গীর মোবাইল ফোন, পরিচয়পত্র ও ১৫ হাজার রুপি ছিনিয়ে নেয়া হয় বলেও অভিযোগ করা হয়েছে।
থানায় অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, ওই নারী টিকটকার ছয় সঙ্গীর সঙ্গে মিনার-ই-পাকিস্তানের কাছে ভিডিও বানাচ্ছিলেন। এমন সময় ৩০০-৪০০ লোক তাদের ওপর আক্রমণ করে।
এ ঘটনায় দোষীদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন লাহোর পুলিশের ডিআইজি সাজিদ কিওয়ানি। অজ্ঞাত কয়েক’শ জনের বিরুদ্ধে হয়রানি ও চুরির অভিযোগে মামলা হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
প্রসঙ্গত, পাকিস্তানিদের মধ্যে টিকটক বেশ জনপ্রিয়। তবে ‘অশ্লীল কনটেন্ট’ প্রচারের দায়ে দেশটিতে বেশ কয়েকবার নিষিদ্ধ করা হয়েছে চীনা অ্যাপটি।
নারীর জন্য বিপজ্জনক দেশ পাকিস্তান
নারীর জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক দেশের তালিকায় পাকিস্তান বিশ্বে ছয় নম্বরে অবস্থান করছে৷ যৌন নির্যাতন ও পারিবারিক সহিংসতার হার বেড়েই চলেছে৷ অধিকারকর্মীরা নারীর প্রতি সহিংসতা বাড়ার জন্য বিচারহীনতার সংস্কৃতিকেই দায়ী করছেন৷
বালোচিস্তানের সাবেক আইনপ্রণেতা ইয়াসমিন লাহিড়ি জার্মান ভিত্তিক গণমাধ্যম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এক নারী আইনজীবীকে ছুরি দিয়ে ১২ বার আঘাত করার পরও আদালত এক ব্যক্তিকে মুক্তি দিয়ে দিয়েছেন৷ নারীর প্রতি যারা সহিংসতা করে, তাদের কী বার্তা দেয়া হলো এর মাধ্যমে?’’
২০০২ সালে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হওয়া অধিকারকর্মী মুখতার মাই বলেন, “যারা নারীর প্রতি সহিংসতা করে, তারা আইনি প্রক্রিয়াকে ভয় করে না৷ বেশিরভাগ পাকিস্তানি পুরুষ নারীকে পেটানোকে কোনো সহিংসতাই মনে করে না৷”
সমাজের পুরুষতান্ত্রিক আচরণকেও দায়ী করেন অনেকে৷ লাহোর-ভিত্তিক নারীবাদী আন্দোলনকারী মাহনাজ রেহমান বলেন, যখনই নারীরা তাদের অধিকার নিয়ে সোচ্চার হয় তখনই তাদের সহিংসতার শিকার হতে হয়৷
তিনি বলেন, “নারীদের শিক্ষা দেয়া হয় পুরুষকে মান্য করে চলার জন্য, কারণ, পরিবারে তাদের স্ট্যাটাস উঁচুতে৷”
দেশটির প্রধানমন্ত্রীর দায়
অনেক অধিকার কর্মীই মনে করেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী ‘সহিংসতার শিকার নারীকেই উলটো দায়ী’ করার কারণে নারীর প্রতি সহিংসতা বেড়েছে৷
গত জুন মাসে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান যৌন নির্যাতনের জন্য নারীকেই দায়ী করে বক্তব্য দিয়ে ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দেন৷ মার্কিন টিভি চ্যানেল এইচবিওতে ডকুমেন্টারি নিউজ সিরিজ এক্সিওস-এর জন্য দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, “নারী যদি খুব কম কাপড় পরে তাহলে পুরুষের ওপর তার প্রভাব পড়তেই পারে, যদি তারা রোবট না হয়৷” এটাকে ‘সাধারণ জ্ঞান’ বলেও উল্লেখ করেন তিনি৷
এর আগে চলতি বছরের শুরুতেও একটি মতবিনিময় অনুষ্ঠানে পাকিস্তানে নারীর প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধির পেছনে ‘পর্দার’ অভাবকে দায়ী করে বক্তব্য দেন তিনি৷
লাহোর-ভিত্তিক অ্যাক্টিভিস্ট সাজিয়া খান বলেন, “প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান এবং তার মন্ত্রীদের একের পর এক নারীবিরোধী মন্তব্য নারীবিদ্বেষ এবং নারীর প্রতি সহিংসতাকেও এক প্রকার উসকে দিয়েছে৷”
সাবেক আইনজীবী ইয়াসমিন লাহিড়ি মনে করেন, ইমরান খানের সরকার নারীদের রক্ষায় কিছুই করেনি৷ বরং নারীর প্রতি সহিংসতা দমনে একটি আইন দেশের ইসলামিক আলেমদের কাছে পাঠানোর পর তারা তা আটকে দিয়েছেন৷
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৬০৫
আপনার মতামত জানানঃ