আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহার শুরু হওয়ার পর গত দু’মাসে পুরো পাল্টে গেছে দেশটির চেহারা। একের পর এক এলাকার দখলে নিয়েছে তালিবান। এরই মধ্যে আফগান নারী ও পুরুষের ওপর নানা বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। নারীরা বাড়ির বাইরে গেলে অবশ্যই তাদের বোরকা পরতে হবে। এ ছাড়া এ সময় তাদের সঙ্গে অবশ্যই একজন পুরুষ থাকতে হবে। ফলে নারীদের বাইরে চলাফেরা কঠিন হয়ে পড়েছে। ভয়ে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন নারীরা।
বিবিসি আফগানিস্তানের নানা অঞ্চলের নারীদের সঙ্গে কথা বলেছে। সেখানে আফগানিস্তানে নারীদের করুণ অবস্থা তুলে ধরেছে।
সারাহ(ছদ্মনাম) নামের এক নারী বিবিসিকে জানান, গজনি আমার খুব পছন্দের জায়গা, আমার জন্মস্থান। কিন্তু তিন দিন আগে সপরিবার সেই শহর ছেড়ে আসতে হয়েছে। গত একটা মাস ধরে সেখানে আমি সংঘাত দেখেছি। দুই দিন আগে বাবা ও ভাই-বোনদের সঙ্গে নিয়ে কাবুল এসে পৌঁছেছি।
গজনি এখন পুরোপুরি তালেবানের দখলে। আমাদের এলাকাটা এক মাস ধরেই তালেবানের দখলে ছিল। আমরা যুবতী নারীরা ঘরের পুরুষ-স্বামী, ভাই বা ছেলেকে ছাড়া বাইরে বের হতে পারতাম না। সেখানে বাস করা অসম্ভব প্রায়। তালিবান আমাদের স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিয়েছে।
ওরা যেকোনো ঘরবাড়ি এসে দখল করে নিতে পারে। যারা তাদের কথা শুনছে না, তাদের মেরে ফেলছে। এলাকার কোনো বাড়ি পছন্দ হলে তা খালি করে দিতে বলার পর খালি না করে দিলে তারা সঙ্গে সঙ্গে মেরে ফেলে। এলাকার অনেককেই আমরা ইতিমধ্যে হারিয়েছি।
আমি এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্যে স্নাতকোত্তর করছিলাম। সব বন্ধু-বান্ধব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি। বুঝতে পারছি না, আপনারা আমাদের আবেগ ও বর্তমান অবস্থা বুঝতে পারছেন কি না। সবকিছু ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না।
আমরা আফগানিস্তানের বাইরে যেতে পারব না। জানি না, সামনের দিনগুলোতে কী ঘটতে যাচ্ছে। কাবুলে ছোট্ট একটি জায়গায় থাকতে বাধ্য হচ্ছি। ওদিকে আমাদের সবকিছু রয়ে গেছে ফেলে আসা শহরে।
মরিয়ম (ছদ্মনাম)নামে একজন বলছেন, আমরা কাবুলে রয়েছি। আমি নিজের ও কাজিনদের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত। আমি আর ঘরের বাইরে পা রাখি না। কেনাকাটা করতে বা কফিশপে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি। আমাকে এখন বোরকার জীবন বেছে নিতে হবে। আমার শিক্ষা, চাকরি, ভবিষ্যৎ—সবকিছু শেষ হয়ে যাবে। ২০ বছর পর জীবন আবারও শূন্যের দিকে যাত্রা করেছে।
খোস্তে বসবাসরত আমার পরিবারের যেসব মেয়ে এখনো পড়াশোনা করছে, যারা কাবুলের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার জন্য অর্থ জমাচ্ছিল, তাদের নাকি পরিবারের পুরুষেরা বলছেন, ‘আমরা বলেছিলাম না বিয়েটা করে নাও, এখন যদি তালিবান এখানে এসে হুকুম করে যে কুমারী মেয়েদের হাত দাও, তখন আমরা কী করব?’
মেহরিন নামের এক শিক্ষিকা বলছেন, তালিবান আমার ঘরও ধ্বংস করে দিয়েছে। কান্দাহার ত্যাগ নিজের ইচ্ছায় নয়, বাধ্য হয়ে করেছি। জীবনের সবচেয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত ছিল এটি। কল্পনাও ছিল না যুদ্ধ এতটা তীব্র হয়ে উঠবে। রাত ১২টায় ঘরের পেছনের দেয়ালে যখন গোলা পড়ল, তখন বোরকা পরে বেরিয়ে পড়া ছাড়া কোনো উপায় থাকল না।
আমরা কাবুলে রয়েছি। আমি নিজের ও কাজিনদের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত। আমি আর ঘরের বাইরে পা রাখি না। কেনাকাটা করতে বা কফিশপে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি। আমাকে এখন বোরকার জীবন বেছে নিতে হবে। আমার শিক্ষা, চাকরি, ভবিষ্যৎ—সবকিছু শেষ হয়ে যাবে। ২০ বছর পর জীবন আবারও শূন্যের দিকে যাত্রা করেছে।
পরে জেনেছি, আমাদের ও প্রতিবেশীদের বাড়িঘর তালিবান তাদের দখলে নিয়েছে। বাড়ি ছাড়ার সময় শুধু পরিচয়পত্র ও শিক্ষাসনদ নিয়ে বেরিয়েছি। আমার জন্য এ দুটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। এক সপ্তাহ আত্মীয়ের বাসায় থেকে ওয়ারদাকে ১৬ দিন কাটিয়ে কাবুলে একটি বাসা ভাড়া নিয়েছি।
এই পরিস্থিতির কারণে আমার ভাবির সন্তান নষ্ট হয়ে গেছে। কান্দাহার থেকে আমার আত্মীয়রা পাকিস্তান ও হেরাতে চলে গেছে। আমি যখন বাড়ি ছেড়েছি, তখন পুরো জেলা প্রায় ফাঁকা। সব ঘরবাড়ি, দোকানপাট বন্ধ। সবাই যানবাহনের সন্ধান করছিল। কয়েক দিন রকেটের শব্দ শোনার পর শিশুরা এখনো ভীত হয়ে আছে।
মরিয়ম সামা নামের একজন বলেন, আমি আফগান পার্লামেন্টের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক কমিশনের সদস্য। বর্তমান পরিস্থিতি নারীদের জন্য ভীষণ কষ্টকর ও দুশ্চিন্তার। সারা বিশ্ব আমাদের ধোঁকা দিয়েছে। তালিবানের শাসন কায়েম হলে লাখ লাখ নারী মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে।
তাখার ও হেরাতের এমন অনেক ঘটনা জানি, সেখানে তালিবান বহু অবিবাহিত ও বিধবা নারীকে বিয়ে করছে। এগুলো কোনোভাবেই উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। তালিবান তার যোদ্ধাদের বলে, ধর্মীয়ভাবে নাকি এসব কাজের বৈধতা রয়েছে।
বিবিসির সাংবাদিক ইয়ালদা হাকিম বলছেন, আফগানিস্তানে এখন উদ্বাস্তুদের দেখা যাচ্ছে। বহু নারী সাহায্য প্রার্থনা করছেন। তালিবান আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নিলে কী হবে, তা ভেবে তারা ভীষণ আতঙ্কিত।
ইয়ালদা তার টুইটে একজন নারীর পাঠানো বার্তায় উল্লেখ করেছেন, সে নারী লিখেছেন, ‘আপনার সাহায্য আমার খুবই প্রয়োজন। এখান থেকে বের হওয়ার জন্য সহযোগিতা ভীষণ দরকার। আফগানিস্তানের পরিস্থিতি খুব খারাপ হচ্ছে। আমি নারীদের অধিকারের জন্য শো করতাম। আফগান ন্যাশনাল আর্মির জন্য শো করতাম। আফগানিস্তানের উন্নতির কথা বলতাম। আমি জানি না, আমাকে জীবিত ছেড়ে দেওয়া হবে, নাকি মেরে ফেলা হবে।’
ইয়ালদা বলেন, ‘তালিবান আমাকে বলেছে, এখন থেকে ১২ বছরের বেশি বয়সের কোনো মেয়ে স্কুলে যেতে পারবে না। বিয়ে ছাড়া যে নারী-পুরুষ সম্পর্ক রাখবে, তাদের পাথর নিক্ষেপ করে মারা হবে। চুরির শাস্তি হিসেবে হাত কাটা হবে।’
বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংবাদমধ্যমে খবর বেরিয়েছে, রাজধানীতে বোরকা কেনার হিড়িক পড়ে গেছে। ফলে বোরকার দামও বেড়ে গেছে আট থেকে দশগুণ। গত বছর যে বোরকার দাম ছিল দুইশ আফগানি মুদ্রা, বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে দুই হাজার থেকে তিন হাজার আফগানি মুদ্রায়।
এতোদিন শুধু আফগানিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশের নারীরাই বোরকা পড়ত। কিন্তু তালিবান কাবুলের চারদিক ঘিরে ফেলার পর থেকেই সেখানকার নারীরা বোরকা কিনতে ভিড় করছেন দোকানগুলোতে।
বহু দশক ধরে বিশ্বে আফগান নারীদের পরিচায়ক ছিল ঐতিহ্যবাহী আফগানি বোরকা। যেটা অধিকাংশ সময়েই নীল রঙের হতো। সাধারণত ভারী কাপড় দিয়ে এই বোরকা বানানো হতো। এর নকশা এমনভাবে করা হতো, যাতে মাথা থেকে পায়ের আঙুল পর্যন্ত ঢেকে থাকে। চোখের কাছে জালের মতো এক ধরনের কাপড় লাগানো হতো, যাতে ভেতরে থেকে বাইরে দেখতে পাওয়া যাবে; বাইরের কেউ ভেতরে দেখতে পারবে না। ১৯৯০-এর দশকের শেষের দিকে তালিবান শাসনামলে নারীদের ওপর কঠোরভাবে এ ধরনের বোরকা পরার নির্দেশনা জারি করা হয়েছিল। নইলে তালেবানের মোরাল পুলিশের হাতে জনসমক্ষে বেত্রাঘাতের মতো নির্মম শাস্তি পেতে হতো নারীদের। ২০০১ সালে তালেবানের পতনের পর ধর্মীয় ও ঐতিহ্যগত কারণে অনেকেই বোরকা পরতেন। তবে দেশের লাখ লাখ নারী তা প্রত্যাখ্যান করেন। তারা কী পরবেন, সেটা নিজেরাই ঠিক করবেন বলে ঘোষণা দেন বিদ্রোহী নারীরা।
মেয়েদের কোনো অধিকার থাকবে না
আফগানিস্তান ত্যাগ করেছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট আশরাফ গানি। ইতোমধ্যেই রাষ্ট্রপতির ভবন দখলে নিয়েছে তালিবান যোদ্ধারা। এই অবস্থায় রোববার (১৫ আগস্ট) সন্ধ্যায় দিল্লির বিমানবন্দরে অবতরণ করে কাবুল থেকে ১২৯ জন যাত্রী নিয়ে আসা এয়ার ইন্ডিয়ার একটি বিশেষ বিমান।
এ সময় দিল্লির বিমানবন্দরে কান্নায় ভেঙে পড়লেন এক আফগান মহিলা। ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমগুলোকে তিনি বলেন, বিশ্বাস করতে পারছি না, আফগানিস্তান ছাড়তে হয়েছে। তালিবান আমাদের বন্ধুদের মেরে ফেলবে। মেয়েদের কোনো অধিকারই আর থাকবে না।
কাবুল থেকে আসা ওই বিমানে যারাই ফিরেছেন তারা সবাই গভীর আশঙ্কার কথা শোনালেন। আবদুল্লা মাসুদি নামে বিবিএ পড়ুয়া এক শিক্ষার্থী বলেন, কোনো হামলার ঘটনা আমার চোখে পড়েনি। কিন্তু হামলা যে হবে না এটা বলা যাচ্ছে না। আগে থেকেই এই বিমানের টিকিট কাটা ছিল। আমার পরিবার এখনও কাবুলেই আছে। বহু লোক আতঙ্কে কাবুল ছেড়েছে।
প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনির দেশত্যাগের পর রাষ্ট্রপতির ভবন দখলে নিয়েছে তালিবানরা। খুব শিগগিরই দেশটিতে গঠিত হতে যাচ্ছে নতুন সরকার। নতুন সরকারের নাম হবে ইসলামিক এমিরেট অব আফগানিস্তান। রোববার (১৫ আগস্ট) ভারতীয় বিভিন্ন গণমাধ্যম থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
গণমাধ্যমগুলো জানায়, সরকার গঠন করতে চলেছে তালিবানরা। নতুন সরকারের নাম ইসলামিক এমিরেট অব আফগানিস্তান (Islamic Emirate of Afghanistan)। এজন্য কাবুলে কারফিউ জারি করা হয়েছে। স্থানীয় সড়কগুলোতে তালিবানি টহলদারি আরও জোরদার করা হয়েছে।
দেয়াল থেকে মুছে ফেলা হচ্ছে নারী মডেলদের ছবি
কাবুলে তালিবান পা রাখার পর থেকেই সেখানকার বাসিন্দারা রয়েছেন আতঙ্কে। শহর ছেড়ে পালাচ্ছেন অনেকেই। আবার অনেকেই ভিড় করছেন কাবুল বিমানবন্দরে। এর মধ্যে দেখা গেল ভিন্ন এক চিত্র। রাজধানীর দেয়াল থেকে বিজ্ঞাপনে ব্যবহৃত নারী মডেলদের ছবি মুছে ফেলা হচ্ছে।
রোববার আফগানিস্তানের টোলো নিউজ টেলিভিশন চ্যানেলের প্রধান লুৎফুল্লাহ নাজাফিজাদা একটি ছবি টুইটারে শেয়ার করেন।
এতে দেখা যাচ্ছে, এক ব্যক্তি কাবুলের একটি দেয়াল থেকে পণ্যের বিজ্ঞাপনে মডেল হিসেবে থাকা নারীর ছবি রঙ দিয়ে মুছে ফেলছেন।
তালিবান কাবুল দখল করার পর নারীরা রয়েছেন আতঙ্কের মধ্যে। ইতোমধ্যে রাজধানীতে বোরকা কেনার হিড়িক পড়ে গেছে।
তবে নারীদের নিয়ে এবার অনেকখানি নরম অবস্থান নিয়েছেন তালিবানের মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদ। তিনি বলেন, মহিলাদের ব্যাংকে কাজ করতে দেওয়া হবে কিনা এ নিয়ে এখনও সিদ্ধান্ত হয়নি। ইসলামিক আইন প্রণয়নের পর চূড়ান্ত হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫৪৬
আপনার মতামত জানানঃ