গবেষকদের চোখ ‘বেনু’ নামের একটি গ্রহাণুতে। ৭ দশমিক ৮ কোটি টনের গ্রহাণুটি আগামী ১৫০ বছরে পৃথিবীর কক্ষপথের ৭৫ লাখ কিলোমিটারের মধ্যে আসবে। শুনতে খুব একটা উদ্বেগজনক মনে না হলেও শঙ্কামুক্ত হতে পারছেন না গবেষকেরা। কারণ, বেনু যে পাথরে তৈরি, তা পৃথিবীতে আঘাত হানলে বড় ধরনের ক্ষতি করতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থাটির হিসাবে, পৃথিবীতে বেনুর আঘাতের সম্ভাব্য তারিখ ২১৮২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর। সেদিন বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করতে পারে গ্রহাণুটি, আছড়েও পড়তে পারে পৃথিবীর বুকে।
অর্থাৎ ২৩০০ সালের মধ্যে যে কোনো সময় বেনুর আঘাত হানার শঙ্কা তো আছেই; তবে দিনটি ১৬১ বছর পর হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি।
তবে সুখবর হলো, আপাতদৃষ্টিতে বিপজ্জনক গ্রহাণুটির পৃথিবীতে আঘাত হানার গড় সম্ভাবনা এক হাজার ৭৫০ ভাগের এক ভাগ। নতুন হিসাবে বেনুর পৃথিবীতে আছড়ে পড়ার সম্ভাবনা খানিকটা বেশি হলেও এখনও তা বিজ্ঞানীদের রাতের ঘুম কেড়ে নেয়ার মতো কারণ হয়নি।
বিজ্ঞানবিষয়ক সাময়িকী ইকারাসে প্রকাশিত প্রতিবেদনে গবেষকরা বেনুর বিষয়ে নিজেদের পূর্বাভাস তুলে ধরেছেন। জানিয়েছেন, ২১৩৫ সালে পৃথিবীর খুব কাছে আসবে বেনু, কিন্তু সে সময় পৃথিবীর সঙ্গে এটির সংঘর্ষ কিংবা বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করার কোনো সম্ভাবনা নেই।
তবে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তির কারণে সূর্যকে ঘিরে গ্রহাণুটির কক্ষপথে পরিবর্তন হতে পারে। এর প্রভাবে খুব শিগগিরই আবারও পৃথিবীর কাছাকাছি আসবে বেনু। সম্ভাব্য সেই তারিখটিই হলো ২১৮২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর।
নাসা জানিয়েছে, গ্রহাণুটি আবিষ্কারের পর ২২ বছরে এর সবচেয়ে নিখুঁত গতিপথ নির্ধারণ করা হয়েছে নতুন গবেষণায়। এ হিসাবে আগামী ৩০০ বছরের মধ্যে পৃথিবীতে বেনুর আঘাত না করার সম্ভাবনা ৯৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ।
নাসার জেট প্রোপালশান ল্যাবরেটরির সেন্টার ফর নিয়ার আর্থ অবজেক্ট স্টাডিজের গবেষক ডেভিড ফার্নোচিয়া বলেন, ‘নতুন বিশ্লেষণে পৃথিবীতে গ্রহাণুটির আঘাতের সম্ভাবনা একটু বেশি হলেও তা খুব উল্লেখযোগ্য কিছু নয়। তাই এখনই উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ নেই। তবে যেহেতু গ্রহাণুর গতিপথ পরিবর্তনযোগ্য, এর গতিপথে আমাদের পর্যবেক্ষণ চলতে থাকবে।’
ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের প্রতিবেদনে জানানো হয়, বর্তমান গতিপথে ২১০০’র শেষ দিক থেকে ২২০০’র শুরু পর্যন্ত সময়ে অসংখ্যবার পৃথিবীর জন্য ঝুঁকি তৈরি করার মতো কাছাকাছি আসবে বেনু। এর মধ্যে সবচেয়ে কাছাকাছি আসবে ২১৮২’র সেপ্টেম্বরের এক মঙ্গলবারে।
তবে সেদিন পৃথিবীতে বেনুর আছড়ে পড়ার সম্ভাবনা দুই হাজার ৭০০ ভাগের এক ভাগ।
গ্রহাণু আঘাত হানলে কী হবে পৃথিবীর?
কখনো যদি বিশাল আকারের কোনো গ্রহাণু বা ধূমকেতু পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসে, কী করবো আমরা? এই আশঙ্কা সামনে রেখে কিভাবে তা এড়ানো যায়, সে গবেষণাই করছেন বিশেষজ্ঞরা৷
নাসার সংবাদভিত্তিক ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানানো হয়, বেনুর আকৃতির কোনো গ্রহাণু পৃথিবীতে আঘাত করলে ছয় মাইল চওড়া গর্ত সৃষ্টি হতে পারে ভূপৃষ্ঠে। যে স্থানে পড়বে গ্রহাণুটি, সেখানে গর্তের গভীরতা হতে পারে ৬০০ মাইলের বেশি।
বেনুর আকৃতির কোনো গ্রহাণু পৃথিবীতে আঘাত করলে ছয় মাইল চওড়া গর্ত সৃষ্টি হতে পারে ভূপৃষ্ঠে। যে স্থানে পড়বে গ্রহাণুটি, সেখানে গর্তের গভীরতা হতে পারে ৬০০ মাইলের বেশি।
তবে দুর্ঘটনাক্রমে বেনু যদি পৃথিবীতে আঘাত হানে, সে আঘাত ডাইনোসর বিলুপ্ত করে দেয়া গ্রহাণুটির আঘাতের মতো শক্তিশালী হবে না।
সাড়ে ছয় কোটি বছর আগে পৃথিবীতে আঘাত হানা ওই গ্রহাণুটি চওড়ায় প্রায় ছয় মাইল ছিল বলে ধারণা বিজ্ঞানীদের, যা বেনুর প্রস্থের প্রায় ১৮ গুণ।
অবশ্য বেনু যে অঞ্চলে আঘাত করবে, সেখানকার বিপর্যয়ের মাত্রা হতে পারে কল্পনাতীত।
গত বছর লেবাননের রাজধানী বৈরুতের বন্দরে যে ভয়াবহ বিস্ফোরণ দেখেছে বিশ্ব, তার ২০ লাখ গুণ হতে পারে বেনুর আঘাতে বিস্ফোরণের তীব্রতা।
বেনু কী?
বেনু হচ্ছে এপোলো গ্রুপের একটি গ্রহাণু। নাসার লিনিয়ার প্রজেক্টের মাধ্যমে এটি আবিষ্কৃত হয়। পৃথিবীর সঙ্গে এর সংঘর্ষ হওয়ার আশঙ্কা প্রবল। বেনু সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহের জন্য নাসা ওসিরিস রেক্স মিশন পরিচালনা করেছে, যা গ্রহাণুটির গঠনগত প্রকৃতি ও আকৃতি সম্পর্কে সুষ্ঠু ধারণা দিতে পারবে।
গ্রহাণু বেনুর ঘূর্ণায়মান ধ্বংসস্তূপ থেকে নমুনা সংগ্রহ করে পরোক্ষ গতিপথে ফিরে আসছে ওসিরিস-রেক্স। সৌরজগতের পরিচিত বিপজ্জনক গ্রহাণুর মধ্যে সবচেয়ে বড় দুটির একটি হিসেবে বিবেচনা করা হয় বেনুকে। আরও দুবছর পর ২০২৩ সালে এই নমুনা পৃথিবীতে এসে পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
২০১৮ সালে ওসিরিস-রেক্স বেনুতে আসার আগে গ্রহাণুর ভেতরকার বিষয়াদি নিয়ে নিখাদ ধারণা দিয়েছে বিভিন্ন দূরবীক্ষণ যন্ত্র। গ্রহাণুর ব্যাস এক মাইলের এক-তৃতীয়াংশ হতে পারে। ভবিষ্যতে গ্রহাণুর প্রদক্ষিণ পথ নিয়ে বিজ্ঞানীদের ভবিষ্যদ্বাণীর সহায়তায় গত আড়াই বছরে যথেষ্ট উপাত্ত সংগ্রহ করেছে এই মহাকাশযান।
এ নিয়ে গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশ করা হয়েছে ইকারোস সাময়িকীতে। এতে গ্রহাণুর গতিপথ নিয়ে মানচিত্র তৈরি করতে সহায়তা করবে এসব তথ্য-উপাত্ত। ভবিষ্যতে কখন আরেকটি বিপজ্জনক উল্কাপিণ্ড পৃথিবীতে আঘাত হানতে পারে, তা নিয়েও ভালো ধারণা পাবেন বিজ্ঞানীরা।
ওসিরিস-রেক্স ঘটনাস্থলে পৌঁছার আগে বেনুর পৃথিবীতে আঘাত হানা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেছেন বিজ্ঞানীরা। বলা হয়, ২২০০ সালে এটির আঘাত হানার শঙ্কা দুই হাজার ৭০০-এর মধ্যে এক শতাংশ। আর ২৩০০ সালে সেই আশঙ্কা এক হাজার ৭৫০-এর মধ্যে এক শতাংশ। আর এককভাবে সবচেয়ে ভয়ের দিনটি হচ্ছে ২১৮২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর।
২১৩৫ সালে বেনু পৃথিবীতে সবচেয়ে কাছাকাছি চলে আসতে পারে। তখন এটি চাঁদের অর্ধেক দূরত্ব দিয়ে অতিক্রম করবে। নাসার গ্রহ প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা লিন্ডলি জনসন বলেন, বেনু যদি পৃথিবীতে আঘাত হেনেই বসে, তবে প্রাণীজগৎ ধ্বংস হয়ে যাবে না। বরং গ্রহাণুর চেয়ে ১০ থেকে ২০ গুণ বড় জ্বালামুখ তৈরি করতে পারবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫৪৪
আপনার মতামত জানানঃ