বিবাহিত হলেও কোনও নারী এবং পুরুষের মধ্যে যৌন মিলন ঘটার ক্ষেত্রে সম্মতি থাকতেই হবে, এক যুগান্তকারী রায়ে গত সপ্তাহে এ কথা বলেছে ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় কেরালা রাজ্যের হাইকোর্ট।
কেরালা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চের বিচারপতি কওসার এডাপ্পাগাথ এবং বিচারপতি এ মুহাম্মদ মুস্তাক তাদের রায়ে বলেন, স্ত্রীর সম্মতি ছাড়া স্বামীর এই কর্মকান্ড বৈবাহিক ধর্ষণের পর্যায়ে পড়ে।
বিবিসির প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, যে মামলায় এই রায় দেওয়া হয়েছে তার আবেদনকারী মহিলা বলেছিলেন, তিনি অসুস্থ থাকলেও তার স্বামী তাকে নিয়মিত যৌন মিলনে বাধ্য করতেন।
রায়ে আরও বলা হয়, এই বৈবাহিক ধর্ষণ বিবাহ বিচ্ছেদেরও ন্যায়সঙ্গত কারণ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। যদিও এ যাবৎ ভারতে বৈবাহিক ধর্ষণ, অর্থাৎ যেখানে ধর্ষিতা ও ধর্ষকের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক থাকে, সেটাকে কোনও অপরাধ বলে গণ্য করা হতো না। তবে কেরালা হাইকোর্ট তাদের রায়ে বলছে, এটাকে চরম নৃশংসতা বলে গণ্য করাই যায়; যার ভিত্তিতে বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদনও মঞ্জুর করা সম্ভব।
ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৫ ধারায় ধর্ষণের যে সংজ্ঞা রয়েছে, তাতে স্বামীকে ধর্ষকের ভূমিকা থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে সযত্নে (স্ত্রীর বয়স যদি ১৫ বছরের নীচে না হয়)৷ অর্থাৎ স্ত্রীর অনুমতি ছাড়া তার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক রাখা কোনো অপরাধ নয়৷ তাই স্বামীর হাতে প্রতিনিয়ত যৌন নিপীড়নের শিকার হলেও, তাকে ‘ধর্ষণ’ বলা যাবে না৷
ভারতের ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর রিসার্চ অন উইমেন (আইসিআরডাব্লিউ) বা আন্তর্জাতিক নারী গবেষণা কেন্দ্রের সাম্প্রতিক সমীক্ষা অনুযায়ী, স্ত্রীকে ধর্ষণের কথা স্বীকার করেছে প্রতি পাঁচজনের একজন ভারতীয় পুরুষ৷ তাও আবার লজ্জিত হয়ে নয়, বেশ গর্ব করেই৷
বৈবাহিক ধর্ষণ কাউন্সেলর এবং এক আইনজীবীর মতে, গরিব, অশিক্ষিত স্ত্রীরাই বৈবাহিক ধর্ষণের শিকার হন বেশি; তথ্যগতভাবে এটা ঠিক নয়৷ অনেক শিক্ষিত ও অবস্থাপন্ন ঘরের মেয়েরাও এর শিকার৷ আসলে স্ত্রীর ওপর নিজের অধিকার ফলাতে, তাকে নিজের অধীনে রাখতে, পতি দেবতাদের এটা একটা সাধারণ হাতিয়ার৷ তাই বহুচর্চিত বিবাহকে ধর্মীয় পবিত্রতার তকমা দিয়ে ভারতীয় নারীদের ওপর ক্রমাগত চলতে থাকা দৈহিক ও মানসিক নির্যাতন কখনই মেনে নেয়া যায় না৷
কলকাতায় নারী অধিকার কর্মী ও অধ্যাপক শ্বাশ্বতী ঘোষ মনে করছেন, ভারতীয় উপমহাদেশের পটভূমিতে এই রায় অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ; কারণ এখানে যৌন মিলনের ক্ষেত্রে স্ত্রীর সম্মতিও যে জরুরি, সেই স্বীকৃতিটারই অভাব আছে।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “এই বিশেষ মামলাটিতে স্ত্রী অভিযোগ করেছেন ১২ বছর ধরে তিনি স্বামীর অন্যায় যৌন আকাঙ্ক্ষা মেটাতে গিয়ে ক্লান্ত। কিন্তু এর বিরুদ্ধে দুইবার পারিবারিক আদালতে গিয়েও তিনি কোনও প্রতিকার পাননি।”
মামলার বিবরণী উল্লেখ করে শ্বাশ্বতী ঘোষ আরও বলেন, “যৌন মিলনে বাধ্য করার সময় তার স্বামী খেয়ালই করতেন না যে স্ত্রী অসুস্থ কিনা। এমন কী তার স্ত্রীর মা যেদিন মারা যান, সে দিনও তিনি তাকে যৌন মিলনে বাধ্য করেছেন; নিজেদের মেয়ের সামনেও মিলিত হয়েছেন। এমন চরম নৃশংসতাও আইনের চোখে এতদিন অপরাধ ছিল না; এটাই আক্ষেপের।”
কলকাতায় নারী অধিকার কর্মী ও অধ্যাপক শ্বাশ্বতী ঘোষ মনে করছেন, ভারতীয় উপমহাদেশের পটভূমিতে এই রায় অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ; কারণ এখানে যৌন মিলনের ক্ষেত্রে স্ত্রীর সম্মতিও যে জরুরি, সেই স্বীকৃতিটারই অভাব আছে।
ভারতের নারী অধিকার কর্মীরা প্রায় সবাই এক সুরেই বলছেন, ভারত-সহ এ অঞ্চলের পাকিস্তান, বাংলাদেশ সব দেশেই সামাজিকভাবে একটা ধারণা প্রচলিত আছে যে বিবাহিত স্ত্রীরা বৈবাহিক ধর্ষণের বিরুদ্ধে মুখ খুললে ‘পরিবার’-এর ধারণাটাই ভেঙে পড়বে। কেরালা হাইকোর্টের রায় সেই ধারণাকে কিছুটা হলেও পাল্টাতে সাহায্য করবে বলে তাদের অনেকেই আশা করছেন।
শাশ্বতী ঘোষের কথায়, “ভারতের জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য জরিপেও (ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে) এই সমস্যার ব্যাপকতা বারেবারে ধরা পড়েছে। ভারতের অসংখ্য নারী পারিবারিক সংস্কারের চাপে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন বৈবাহিক ধর্ষণের শিকার হওয়াটাই তাদের ভবিতব্য; কারণ যে কোনও সময়, যখন খুশি যৌন মিলন স্বামীর অধিকার। তাদেরও যে কখনো কখনো অসম্মতি জানানোর অধিকার আছে, সেটাই আসলে স্ত্রীদের ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে।”
কেরালা হাইকোর্টের ঐতিহাসিক এই রায় ভারতীয় সমাজ ও পরিবার ব্যবস্থার সেই ‘ট্যাবু’ বা নিষিদ্ধ বিষয়কে অন্তত আলোচনা ও চর্চার কেন্দ্রে আনবে বলেই অ্যাক্টিভিস্টরা আশা করছেন।
শুধু ভারত নয়, দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশেই নারীকে পারিবারিক চাপ অথবা অন্য উপায় না থাকার ফলে বছরের পর বছর বাস করতে হয় ‘স্বামী’ নামের ধর্ষকের সঙ্গে৷ একবার নয়, হয়ত প্রতিদিন, প্রতি সপ্তাহে ধর্ষণ হয় তারা৷ লোকলজ্জার ভয়ে ডাক্তারের কাছে যেতে পারে না সে৷ তাই বয়ে বেড়াতে হয় যৌন রোগ, ক্ষত বা মানসিক অসুখ৷
তাই কোনো নারীকে যদি প্রশ্ন করেন, আপনার স্বামী কি আপনাকে ধর্ষণ করছেন?- তাহলে বেশিরভাগ নারীই হয় চুপ হয়ে যাবে কিংবা পড়ে যাবে চিন্তায়৷ আর কেউ যদি সাহস করে সত্যটা বলেও ফেলে, তাহলে তার ভবিষ্যৎ কী? কে দেবে তাকে পুনর্বাসন, অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ? পরিবার? রাষ্ট্র? ধর্ম? কেউ না৷ আর সে জন্যই ধর্ষক স্বামীরা আজও বুক ফুলিয়ে হাঁটে আর মেয়েরা পুতুল খেলতে খেলতে মুখ বন্ধ করে ‘ধর্ষিতা’ হন!
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/২১৩০
আপনার মতামত জানানঃ