করোনার পাশাপাশি ডেঙ্গুও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। হাসপাতালগুলোতে করোনা রোগীর চাপে চিকিৎসার সুযোগ কমে যাবার কারণে ডেঙ্গু রোগীদের ভোগান্তি বেড়েছে। গতকাল শনিবার (৭ আগস্ট) অব্দি কেবল ২৪ ঘন্টাতেই ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে ২১৪ জন।
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধে দুটি পরিকল্পনা নিয়েছিলো। এর মধ্যে উত্তর সিটির ‘ইন্টিগ্রেটেড ভেক্টর ম্যানেজমেন্ট’ প্রকল্পটিকে মন্ত্রণালয় থেকে গুরুত্ব দিয়ে সারাদেশে চালুর পরামর্শ দিলে এখনও তা আলোর মুখ দেখেনি।
এদিকে সিটি করপোরেশন সঠিক সময়ে কার্যকর উদ্যোগ না নেওয়ায় ও কার্যকর কীটনাশক ব্যবহার না করায় ঢাকায় ভয়াবহ আকারে ডেঙ্গু বাড়ছে। নিজেদের ব্যর্থতা আড়ালের অংশ হিসেবে ‘অভিযান-জরিমানা’র কৌশল বেছে নিয়েছে সিটি করপোরেশন, এমনটা মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ডেঙ্গু নিধনে ইন্টিগ্রেটেড ভেক্টর ম্যানেজমেন্টের অগ্রগতি নেই
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধে দুটি পরিকল্পনা নিয়েছিল। এর মধ্যে দক্ষিণ সিটির ডেঙ্গু প্রতিরোধ দপ্তর ‘কমিউনিকেবল ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড রিসার্চ ডিপার্টমেন্ট’ ও উত্তর সিটির ‘ইন্টিগ্রেটেড ভেক্টর ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্ট’ দুটি আলাদা প্রকল্প নিয়েছিল। প্রকল্প দুটি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে জমাও দেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে ‘ইন্টিগ্রেটেড ভেক্টর ম্যানেজমেন্ট’ প্রকল্পটিকে গুরুত্ব দিয়ে তা সারাদেশে চালুর পরামর্শ দেয় মন্ত্রণালয়। ডেঙ্গু পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপের দিকে গেলেও তা বাস্তয়ানের কোনো সম্ভাবনাই দেখা যাচ্ছে না।
মন্ত্রণালয়ের দাবি তারা প্রকল্পটির জন্য নীতিমালা তৈরি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠিয়েছে। সেখান থেকে আইন মন্ত্রণালয় অনুমোদন দেবে।
সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা করছেন, করোনার মতো ডেঙ্গুও মহামারি আকার নিয়েছে। কিছুদিনের মধ্যে লাগাম টেনে ধরতে না পারলে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার প্রকোপ ব্যাপক আকার নেবে। ২০১৯ সালের মতো পরিস্থিতির হলে এখনকার জনবল ও যন্ত্রপাতি দিয়ে কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না বলে মনে করছে সিটি করপোরেশন।
ডেঙ্গু প্রতিরোধে কলকাতা ও সিঙ্গাপুরের অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর উদ্যোগ থেকে নেওয়া হয় পরিকল্পনা। উত্তর সিটির মেয়র কলকাতা সিটি করপোরেশনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। আর দক্ষিণের তৎকালীন মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন করেন সিঙ্গাপুর ভ্রমণ। সেখানকার অভিজ্ঞতার আলোকে তারা ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে আলাদা দফতর স্থাপনের প্রস্তাব দেন। ওটার ভিত্তিতেই প্রকল্প তৈরি করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়।
দক্ষিণের পাঠানো প্রকল্প শুরু থেকেই মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। উত্তর সিটির মেয়র দেশের কীটতত্ত্ববিদদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করেন। এই কমিটি ‘ইন্টিগ্রেটেড ভেক্টর ম্যানেজমেন্ট’ প্রকল্প গ্রহণের সুপারিশ করে। এরপর প্রকল্পের প্রস্তাবনা তৈরি করে মন্ত্রণালয়ে পাঠায় ডিএনসিসি। সেটা নিয়ে এখনও কাজ শুরু হয়নি।
জরিমানা কৌশল নিজেদের ব্যর্থতা আড়ালের অংশ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা
কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশন থেকে তাদের কাছে পরামর্শ নেওয়া হলেও তা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না।
কীটতত্ত্ববিদ তৌহিদ উদ্দিন আহমেদ টেলিফোনে এক জাতীয় দৈনিককে বলেন, ‘ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজন অ্যাডাল্ট মশা মারা। এক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের কোনো হাত নেই। এই কাজটি অবশ্যই সিটি করপোরেশনকেই করতে হবে।’
‘সিটি করপোরেশন যে ফগিং করে সেটি ত্রুটিপূর্ণ। তাছাড়া তাদের লোকবলের দক্ষতা নিয়েও সন্দেহ আছে। তাদের অধিকাংশ কাজ ত্রুটিপূর্ণ। সিটি করপোরেশনের নিজস্ব কোনো কীটতত্ত্ববিদ নেই। আমাদের কাছে মাঝে মধ্যে কিছু পরামর্শ নেয়। কিন্তু, আমরা যা বলি তারা তা শোনে না।’
তিনি বলেন, ‘সিটি করপোরেশন যে ফগিং করে সেটি ত্রুটিপূর্ণ। তাছাড়া তাদের লোকবলের দক্ষতা নিয়েও সন্দেহ আছে। তাদের অধিকাংশ কাজ ত্রুটিপূর্ণ। সিটি করপোরেশনের নিজস্ব কোনো কীটতত্ত্ববিদ নেই। আমাদের কাছে মাঝে মধ্যে কিছু পরামর্শ নেয়। কিন্তু, আমরা যা বলি তারা তা শোনে না।’
‘আমাদের দেশে অন্যের ওপর দোষ চাপানো খুব সহজ। সিটি করপোরেশন নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে, অপারগতা ঢাকতে, তাদের ত্রুটিপূর্ণ কাজগুলো আড়াল করতে জনগণের ওপর দায় চাপিয়ে অভিযান করছে, জরিমানা করছে। যা মোটেই উচিত না।’
‘সিটি করপোরেশনকে দক্ষ জনবল দিয়ে সঠিকভাবে কাজ করতে হবে, তবেই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে। নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে এসব অভিযান, জরিমানা করে তেমন কোনো লাভ হবে না,’ তিনি যোগ করেন।
কীটতত্ত্ববিদ ও বাংলাদেশ প্রাণীবিজ্ঞান সমিতির সাবেক সভাপতি ড. মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরী টেলিফোনে ঐ জাতীয় দৈনিককে বলেন, ‘প্রথম থেকে এডিস মশা ঠিকঠাক মতো দমন করা হয়নি। এ কারণেই এ বছর ডেঙ্গুর সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। নিজেদের কাজ সঠিকভাবে না করে তারা জনগণকে জরিমানা করছে। এতে বাস্তবে কোনো লাভ হবে না।’
তিনি বলেন, ‘সিটি করপোরেশন বা সরকারের ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে যেসব উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন ছিল তার কোনটাই তেমনিভাবে নেওয়া হয়নি। তাই ডেঙ্গু এক ধরণের মহামারি আকার ধারণ করেছে। এই সময়ে অ্যাডাল্ট মশা নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা নিতে হবে। কিন্তু সেটি তেমনিভাবে নেওয়া হচ্ছে না। কোন কোন জায়গায় ডেঙ্গুর ক্লাস্টার আছে তা খুঁজে বের করতে হবে। আমাদের নগর পিতারা তা না করে বিভিন্ন গান গেয়ে বেড়াচ্ছেন, জনগণের ওপর দায় চাপাচ্ছেন। তারা যে গান গায় তা আসলে সঠিক নয়।’
‘তারা আমাদের পরামর্শ নেয় ঠিকই কিন্তু, যেগুলোতে তাদের নিজের স্বার্থ আছে শুধু সেগুলোই শোনা হয়। বাকিগুলো শোনা হয় না। আমরা দেখি নির্মাণাধীন বাসায় গিয়ে জরিমানা করা হয়। কিন্তু সেই বাসার মশা মেরে আসা হয় না। এটি আসলে হাস্যকর। এ বছর তারা তেমন কোনো উদ্যোগই নেয়নি। এখন দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছে। এতে করে আসলে তেমন ফলাফল পাওয়া যাবে না। তাছাড়া তারা যে ফগিং করে তা তেমনিভাবে কার্যকর না। যে কীটনাশকগুলো ব্যবহার করা হয় সেগুলোর কার্যকারিতা নেই বললেই চলে,’ তিনি বলেন।
‘দক্ষিণ সিটি করপোরেশন হাঁস-ব্যাঙ দিয়ে মশা নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, এটি আসলে হাস্যকর। পৃথিবীর কোনো দেশেই এভাবে হাঁস-ব্যাঙ দিয়ে মশা মারা হয় না। এগুলো জনগণের টাকার অপচয় ছাড়া কিছুই না,’ তিনি যোগ করেন।
মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘নগর পিতারা কার্যকরভাবে কাজ করে না বলেই ঢাকা সিটি অভিশপ্ত নগরীতে পরিণত হয়েছে। গত ৬০ বছরে তারা যেহেতু মশা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি তাই এটি তাদের কাছ থেকে নিয়ে নিতে হবে। অন্য বিশেষ কোনো বাহিনী গঠন করে মশা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।’
কবিরুল বাশার বলেন, ‘এ বছর পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত হয়েছে। তাছাড়া প্রজননের শুরুতে সিটি করপোরেশন ডেঙ্গু নিয়ে তেমন একটা মনোযোগ দেয়নি। এ কারণেই ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে গেছে।’
পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সূত্রে জানা গেছে, ঢাকার প্রায় প্রতিটি হাসপাতাল ও সরকারি অফিসের আশেপাশে ডেঙ্গু মশার লার্ভা আছে। তবে সরকারি প্রতিষ্ঠান বা হাসপাতালগুলোর বিরুদ্ধে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। কয়েকদিন আগে হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের দুটি ড্রাম ও একটি ফুলের টবে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যায়। বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা বাড়িতে মোটা অংকের টাকা জরিমানা করা হলেও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বা জরিমানা করেনি।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা ও মুখপাত্র মো. আবু নাছের বলেন, ‘এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে আমাদের কোনো ঘাটতি নেই। এপ্রিল মাসেই আমরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দিয়েছি। কিন্তু, কেউ তেমনিভাবে সহযোগিতা করছে না বলেই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হচ্ছে না।’
হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বা জরিমানা করা হয়নি কেন, এমনটা ঐ জাতীয় দৈনিক জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কিছু স্পর্শকাতর বিষয় থাকার কারণে তাদেরকে জরিমানা করা হয়নি। তবে তাদেরকে সতর্ক করা হয়েছে। তা ছাড়া যেকোনো সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে লার্ভার খবর পেলে আমরা অভিযান চালাই।’
ডেঙ্গু পরিস্থিতির ভয়াবহতা
গতকাল শনিবার (৭ আগস্ট) স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমারজেন্সি অপারেশন সেন্টার অ্যান্ড কন্ট্রোল রুমের পরিসংখ্যান সূত্রে জানা গেছে, গতকাল অব্দি কেবল ২৪ ঘণ্টায় রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে রেকর্ড সংখ্যক ২০৪ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন।
এ নিয়ে সারাদেশের হাসপাতালে বর্তমানে ভর্তি থাকা মোট ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ৯৯৭ জন
সূত্র জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে ভর্তি ২০৪ জনের মধ্যে রাজধানীতে সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত হাসপাতালে ৬০ জন এবং বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে ১৩৪ জন, আর ঢাকা বিভাগে (ঢাকা জেলা ব্যতীত) ৭ জন, রাজশাহী বিভাগে একজন ও খুলনা বিভাগে দুজন ভর্তি হন।
এছাড়া চলতি মৌসুমে ডেঙ্গু সন্দেহে মৃত ১০ জনের তথ্য পর্যালোচনা করার জন্য রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (আইইডিসিআর) পাঠানো হয়। তবে এখন পর্যন্ত কোনো মৃত্যু নিশ্চিত করেননি পর্যালোচনা কমিটির সদস্যরা।
পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৭ আগস্ট পর্যন্ত সারাদেশে মোট ৪ হাজার ৩৩৯ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে ভর্তি হন। তাদের মধ্যে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ৩ হাজার ৩১২ জন।
এছাড়া চলতি বছরের জানুয়ারিতে ৩২ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৯ জন, মার্চে ১৩ জন, এপ্রিলে ৩ জন, মে ৪৩ জন, জুনে ২৭২ জন এবং জুলাইয়ে ২ হাজার ২৮৬ জন এবং ৭ আগস্ট পর্যন্ত ১ হাজার ৬৬১ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হন।
এসডব্লিউ/এমএন/ডব্লিউজেএ/১৬৫১
আপনার মতামত জানানঃ