হিন্দু না হলে জাতীয়তাবাদী হওয়া যায় না; ৬৪ শতাংশ ভারতীয় মনে করেন এমনটা। অবাধ ধর্মচারণ ও ধর্মীয় সহিষ্ণুতার মোড়কে এই নতুন ধর্ম চর্চা ফুলে ফেঁপে উঠেছে দেশটিতে হিন্দুত্ববাদী দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সাত বছরের রামরাজত্বে। বেশ কিছু সরকারি সিদ্ধান্তে দুই সম্প্রদায়ের পারস্পরিক অবিশ্বাস ও দূরত্ব বেড়েছে। নরেন্দ্র মোদির ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতি ভারতীয় সাম্প্রদায়িকতা এখন এক টাইম বোম।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনমত জরিপ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিউ রিসার্চ সেন্টার সম্প্রতি ভারতের ধর্মাচরণ-সম্পর্কিত এক সমীক্ষার প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। কোভিডের ঠিক আগে ভারতের প্রায় ৩০ হাজার নাগরিকের সঙ্গে আলাপচারিতা শেষে এই প্রতিবেদন তৈরি হয়েছে। সমীক্ষকেরা কথা বলেছেন ১৭ ধরনের ভাষাভাষী মানুষের সঙ্গে।
ভারতে একচেটিয়া হিন্দু্ত্বের বিকাশে নরেন্দ্র মোদি নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার শুরু থেকেই সক্রিয় ছিল। প্রথম পাঁচ বছরে তার সরকারের নজরে ছিল অযোধ্যার রাম মন্দির নির্মাণের কাঁটা সরিয়ে ফেলা এবং তিন তালাকের মতো প্রথার বিলুপ্তি। পাশাপাশি হিন্দুত্বের প্রসারে সংখ্যাগুরুর মেরুকরণে বিজেপির চেষ্টার কমতি ছিল না। গোহত্যা বন্ধ, হিন্দু নারীর ধর্মান্তরকরণ রোধের পাশাপাশি জম্মু–কাশ্মীরের দ্বিখণ্ডকরণ ও সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ রদের মতো কাজ শাসক দল বাধাহীনভাবে করে গেছে।
মোদির দ্বিতীয় দফায় দায়িত্ব গ্রহণের পর হিন্দুত্বের সর্বাত্মক বিকাশে দল ও সরকার প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত সক্রিয়। জননিয়ন্ত্রণের মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে আসাম ও উত্তর প্রদেশের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত সংখ্যাগুরু মেরুকরণে সহায়ক হবে বলে তাদের বিশ্বাস। আগামী বছরের ভোট বৈতরণি পেরোতে এই কর্মসূচি মুশকিল আসানের ভূমিকা পালন করবে বলে মনে করা হচ্ছে। এ কথা অনস্বীকার্য, মোদি সরকারের গত সাত বছরের রাজত্বে ধর্মভিত্তিক বিভাজনের পাশাপাশি হিন্দুত্বের বিকাশ মসৃণ হয়ে উঠেছে। পিউ রিসার্চ সেন্টারের সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে তারই প্রতিফলন।
পিউর সমীক্ষা দেখাচ্ছে, ৬৪ শতাংশ হিন্দু মনে করেন, হিন্দু না হলে জাতীয়তাবাদী হওয়া মুশকিল। ৫৯ শতাংশের আবার ধারণা, শুধু হিন্দু হলেই হবে না, সেই সঙ্গে হিন্দিভাষী হওয়াও দরকার। কেননা, হিন্দু ও হিন্দি প্রায় সমার্থক। ৮০ শতাংশ ভারতীয় মনে করেন, সেই প্রকৃত ভারতীয়, যিনি হিন্দু ও হিন্দিভাষী। বিজেপির অনুসারীদের মধ্যেও এই ধারণা প্রকট। ধর্ম এদের কাছে প্রধান; ৮৩ শতাংশ জনতা ধর্মবিরোধী কিছু করতে নারাজ। তা সে খাদ্য, পানীয় বা আচার-আচরণ; যাই হোক। ৯৫ শতাংশ মনে করেন, স্বধর্মে থাকাই জীবনের লক্ষ্য। এই বিশ্বাসীদের ৭৩ শতাংশ দৈনিক পূজা করেন। অথচ এরাই মনে করেন, ধর্মীয় বৈচিত্র্য ভারতের বৈশিষ্ট্য; লাভজনক। ২৪ শতাংশের মত যদিও ভিন্ন; যারা মনে করেন, এত বৈচিত্র্য ভারতের পক্ষে ক্ষতিকর।
যেকোনো রাষ্ট্রে সংখ্যালঘু মানসিকতা গোষ্ঠীবদ্ধ নিরাপত্তার যে গণ্ডি টেনে দেয়, ইংরেজিতে যাকে ‘ঘেটো’ বলে, ধর্মসহিষ্ণু ভারত তা থেকে মুক্ত হতে পারেনি। পিউ রিসার্চ সেন্টারের গবেষণা থেকে জানা যায়, ভারতের ৭৭ শতাংশ হিন্দু–মুসলমান কর্মফলে বিশ্বাসী। ৮১ শতাংশ হিন্দুর পাশাপাশি ৩২ শতাংশ খ্রিষ্টানের বিশ্বাস, পাপস্খলনের অদ্ভুত ক্ষমতা রয়েছে গঙ্গার। ৩২ শতাংশ মুসলমানও সুফি মতবাদের অনুসারী। সব ধর্মের মানুষ মনে করেন, প্রবীণদের সম্মান জানানো প্রকৃত ধর্মাচরণেরই অঙ্গ। ধর্মপালনের মহান ব্রত ও গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। এই সহিষ্ণুতা সত্ত্বেও ৬৬ শতাংশ হিন্দু ও ৬৪ শতাংশ মুসলমান মনে করেন, তারা অন্যদের থেকে স্বতন্ত্র। এই স্বতন্ত্রতার কারণে বিয়েশাদির মতো যাবতীয় সামাজিক অনুষ্ঠান নিজ নিজ নিজস্ব ধর্ম অনুযায়ী করে থাকেন।
জরিপ অনুযায়ী, ৬৭ শতাংশ হিন্দু মনে করেন, তাদের ধর্মের নারীর অন্য ধর্মে বিয়ে করা উচিত নয়। ৬৫ শতাংশের রায়, হিন্দু পুরুষদেরও উচিত নয় বিধর্মী নারীকে বিয়ে করা। এই ক্ষেত্রে মুসলমান মনোভাব আরও অন্তর্মুখী। ৮০ শতাংশ চান না মুসলিম নারী অন্য ধর্মাবলম্বীকে বিয়ে করুন। ৭৬ শতাংশ মনে করেন, মুসলমান পুরুষদেরও অন্য ধর্মের নারীকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করা উচিত নয়।
এই স্বতন্ত্রতা অবশ্য প্রতিবেশী পছন্দের ক্ষেত্রে ততটা কঠোর নয়। ৩৬ শতাংশ হিন্দু একেবারেই চান না তার প্রতিবেশী মুসলমান হোন। ৪৫ শতাংশ অবশ্য প্রতিবেশী পছন্দের ক্ষেত্রে অতটা ঋজু নন। তবে এই আপত্তি শিখ বা জৈন ধর্মাবলম্বীদের ক্ষেত্রে নেই। কিন্তু আন্তধর্ম বিবাহের মাধ্যমে বিভিন্ন ধর্মের মিশ্রণ ও সহাবস্থানের ক্ষেত্রে অধিকাংশেরই তীব্র আপত্তি। যেমন ৮২ শতাংশ হিন্দু যারা মনে করেন, অন্য ধর্মাবলম্বীদের শ্রদ্ধা ও সম্মান জানানোই ভারতীয় রীতি। তারা মনে করেন, হিন্দু নারীর অন্য ধর্মে বিয়ে করা একেবারেই উচিত নয়। এই মানসিকতা কেন, তার কোনো ব্যাখ্যা পিউর গবেষণায় নেই। অন্যান্য রাষ্ট্রে যেখানে বৈবাহিক সূত্রে ভিন্ন ধর্মে সম্পর্ক স্থাপনকে গুরুত্ব দেওয়া হয়, যাকে তারা ‘মেল্টিং পট’ হিসেবে দেখে, ভারতে তা অদৃশ্য। এখানে সহিষ্ণুতার অর্থ ভিন্ন সম্প্রদায়ের সঙ্গে পারিবারিক সম্পর্ক স্থাপন নয়। পিউর ভাষায় এটা ‘লিভ টুগেদার সেপারেটলি’।
বৈচিত্র্য ও বৈষম্য সত্ত্বেও দেশের অধিকাংশ মুসলমান নিজেদের ভারতীয় সত্তায় গর্ববোধ করেন। ৯৫ শতাংশ মুসলমান বলেছেন, ভারতীয় হিসেবে তারা গর্বিত। ভারতীয় সংস্কৃতি, যা কিনা পরধর্ম সহিষ্ণু, তাতে তারা উৎসাহিত হন। ৮৫ শতাংশ মুসলমানের ধারণা, ভারতীয়রা নাগরিক হিসেবে হয়তো নিখুঁত নয়, কিন্তু ভারতীয় সংস্কৃতি অন্য সবার চেয়ে আলাদা।এই মনোভাব সত্ত্বেও ভারতীয় মুসলমানদের প্রায় প্রতিক্ষণই তাদের ভারতীয়ত্ব অথবা জাতীয়তাবাদী চরিত্রের প্রমাণ দিতে হয়। তবে ক্ষেত্রবিশেষে তারতম্য রয়েছে। যেমন উত্তর ভারতে বৈষম্যের হাল সর্বাধিক; ৪০ শতাংশ। উত্তর–পূর্বাঞ্চলে ধর্মীয় বৈষম্য ৩৮ শতাংশ। পশ্চিম, মধ্য ও পূর্ব ভারতে বৈষম্যের এই প্রবণতা সবচেয়ে কম। ১৫ থেকে ১৮ শতাংশ। দক্ষিণ ভারতে ১৯ শতাংশ। বৈষম্যের এই আঞ্চলিক বিন্যাস সামাজিক ক্ষেত্রেও প্রতিফলিত। লাভ জিহাদ বা গোরক্ষাকে কেন্দ্র করে বৈষম্য ও বিবাদের অধিকাংশ অকুস্থলই উত্তর ভারত। ৬৫ শতাংশ হিন্দু–মুসলমান একযোগে মনে করেন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ভারতের সবচেয়ে বড় সমস্যা। অথচ রাজনৈতিকভাবে এই বিবাদ ও বৈষম্যই হয়ে উঠেছে ভোট জয়ের প্রধান হাতিয়ার।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৪৪২
আপনার মতামত জানানঃ