কোনোরকম নিয়মনীতির কোনো তোয়াক্কা করছে না কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ায় আশ্রিত রোহিঙ্গারা। প্রতিনিয়ত ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে দেশের আনাচে-কানাচে। উখিয়া-টেকনাফের ত্রিশটি ক্যাম্পে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গার বসবাস। মিয়ানমারের সামরিক জান্তার নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে ঢুকে পড়া এসব রোহিঙ্গা এখন প্রতিদিন ক্যাম্প ছেড়ে পালাচ্ছেন। বড় একটি অংশ শিকার হচ্ছেন পাচারের। সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়ে থাকা তিন শতাধিক রোহিঙ্গা আটকের খবর পাওয়া গেছে।
কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে রামুতে দফায় দফায় রোহিঙ্গা শরণার্থী আটকের ঘটনা ঘটেছে। বুধবার ০৭ ই জুলাই দুপুর আনুমানিক সকাল ১২:৪৯ মিনিটের পর থেকে ০৫ জন রোহিঙ্গা আটকের মধ্য দিয়ে শুরু হয় রামুতে রোহিঙ্গা আটকের পালা। গেল ০৭ ই জুলাই বুধবার থেকে ০৪ আগষ্ট বুধবার বিকেল আনুমানিক ৫ টা পর্যন্ত সর্বমোট ০৯ দফায় রামু উপজেলার জোয়ারিয়ানালা,ফতেখাঁরকুল,রশিদনগর ইউনিয়নের বিভিন্ন জায়গা থেকে ৩৭০ জন রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আটক করা হয়েছে। জোয়ারিয়ানালা ইউনিয়ন পরিষদের সামনে,রশিদনগর ইউনিয়নের প্রবেশমুখ, ফতেখাঁরকুল ইউনিয়নের বাইপাস ফুটবল চত্বর থেকে তল্লাশি চৌকি বসিয়ে এসব রোহিঙ্গাদের আটক করতে দেখা গেছে।
এদিকে আটক হওয়া উখিয়ার কুতুপালং শরণার্থী শিবিরের ২ নং ক্যাম্প এলাকার নুর কাছেমের পুত্র মাহমুদুর রহমান জানান, তারা ক্যাম্পে পর্যাপ্ত খাবার আর নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী পাচ্ছেন না। তাই তারা নিরুপায় হয়ে পরিবারের প্রয়োজন মেটাতে অধিক টাকা রোজগারের আশায় ক্যাম্প ছেড়ে কাজের সন্ধানে বের হয়েছেন। যদিও তারা স্বীকার করেছেন- ‘ক্যাম্প ছেড়ে আসাটা অন্যায় হয়েছে’।
তারা প্রায় সময় কক্সবাজারের ঈদগাঁও উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ও চটগ্রাম জেলার সাতকানিয়া উপজেলার বিভিন্ন জায়গায় মাটির জোগালি, ধান রোপনসহ বিভিন্ন কাজ করছিল, লকডাউনের কারণে কাজ বন্ধ হওয়াতে তারা ক্যাম্পে যাত্রা করেন। আবার কেউ কেউ কাজের সন্ধানে ক্যাম্প থেকে ওই এলাকার উদ্যেশে যাত্রা করেন। কাজ শেষে অবশ্য তারা আবার ক্যাম্পে ফিরে যায় বলেও জানান তিনি।
প্রাপ্ত সুত্রমতে জানা যায়, গত জুলাই মাসের ৭.১২.১৯.২৫.২৬.২৮ তারিখ বুধবার পর্যম্ত প্রর্যায়ক্রমে ০৫.০৪.১৯.৭৮.১৩৯.১৯.২৫ সর্বমোট ২৮৯ জন রোহিঙ্গা শরণার্থী আটক করা হয়। সর্বশেষ আগষ্ট মাসের ৩ ও ৪ পর্যন্ত সর্বমোট ৩৭০ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে উপজেলার বিভিন্ন স্থান হতে আটক করা হয়। তাছাড়া ৩৭০ জনের মধ্যে ৮০% রোহিঙ্গা জোয়ারিয়ানালা ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থান হতে আটক করা হয়।
সুত্র মতে রামু উপজেলা ও ঈদগাঁও উপজেলার কতিপয় দালাল মিডিয়া হিসাবে কাজ করে রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পের বাইরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজে নিয়োগ করে তাকে। তারা সুযোগ বুঝে বিভিন্ন সময় এই রোহিঙ্গাদের নানা অপকর্মে লিপ্ত করারও অভিযোগ রয়েছে।
এদিকে প্রায়ই রামুতে রোহিঙ্গা আটকের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করছেন স্থানীয় অনেক সচেতন বাসিন্দা। রামুর স্থানীয় বাসিন্দা অধ্যাপক নীলোৎপল বড়ুয়া জানান, প্রতিবার রোহিঙ্গারা ক্যাম্পের বাইরে আসতে পারার কারণ হচ্ছে নিরাপত্তা ব্যবস্থার অব্যবস্থাপনা। পাশাপাশি স্থানীয় অনেক বাসিন্দা এখানে জড়িত। বর্তমানে এই দেশে নাগরিক হয়ে গেছে এমন অনেক রোহিঙ্গারা এটির সঙ্গে জড়িত বলেও জানান তিনি।
কিভাবে এতো রোহিঙ্গা শরণার্থী নিরাপত্তা চৌকির চোখ ফাঁকি দিয়ে রামুসহ লোকালয়ে প্রবেশ করছেন জানতে কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার শাহ্ রেজওয়ান হায়াত এর সাথে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, নিরাপত্তা বেষ্টনী থাকার পরেও কিভাবে তারা ক্যাম্প থেকে বের হচ্ছে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
প্রতিবার রোহিঙ্গারা ক্যাম্পের বাইরে আসতে পারার কারণ হচ্ছে নিরাপত্তা ব্যবস্থার অব্যবস্থাপনা। পাশাপাশি স্থানীয় অনেক বাসিন্দা এখানে জড়িত। বর্তমানে এই দেশে নাগরিক হয়ে গেছে এমন অনেক রোহিঙ্গারা এটির সঙ্গে জড়িত।
রামু উপজেলা নির্বাহী অফিসার প্রনয় চাকমা জানান, আটক রোহিঙ্গাদের মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে ১৮৬০ এর ১৮৮ ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে তাদের কাউকে ০১ মাস করে বিনাশ্রম কারাদন্ড প্রদান করা হয়। আবার তাদের অনেককেই জরিমানা আদায় করে ক্যাম্পে ফেরত পাঠানো হয়। তাদের থেকে প্রায় ৫০ হাজার টাকা জরিমান আদায় করা হয়েছে। আটক রোহিঙ্গারা ক্যাম্প থেকে কৌশলে পালিয়ে কাজের সন্ধানে কক্সবাজারের চকরিয়া, চট্টগ্রামের লোহাগাড়া, সাতকানিয়া, পটিয়াসহ দেশের বিভিন্নস্থানে যাচ্ছিলো বা ওদিক থেকে রামুর সীমানা পার হচ্ছিলো বলে তিনি জানান।
এদিকে রামুতে কয়েক দফায় রোহিঙ্গা আটকের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন একাধিক স্থানীয় বাসিন্দা। এভাবে নিয়ন্ত্রণহীন রোহিঙ্গাদের চলাচল রামুর সার্বিক নিরাপত্তায় ব্যাঘাত ঘটাতে পারে বলে জানান তারা।
জানা গেছে, রোহিঙ্গারা যাতে দেশের মূল জনস্রোতে মিশে যেতে না পারে সে জন্য টেকনাফ থেকে উখিয়া পর্যন্ত বসানো হয়েছে বেশ কয়েকটি চেকপোস্ট। পুলিশ, বিজিবি, সেনাবাহিনী ও অন্যান্য সংস্থার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা এসব চেকপোস্টে তল্লাশি চালান। রোহিঙ্গাদের অবাধ যাতায়াত রোধ করতে স্থানীয়দের যাতায়াতের ক্ষেত্রে জাতীয় পরিচয়পত্র দেখিয়ে চলাচল করতে হয়। এত সতর্কতা সত্ত্বেও রোহিঙ্গারা ছড়িয়ে পড়ছে দেশের নানা প্রান্তে। জড়িয়ে পড়ছে সামাজিক ও অসামাজিক পেশায়।
প্রতিদিন ভোরে রোহিঙ্গা নারী-পুরুষের অনেকে কাজের সন্ধানে ক্যাম্প থেকে বের হন। সন্ধ্যা বা রাতে কেউ ফেরেন কেউ ফেরেন না এমনটাই জানালেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। যারা ফিরে আসেন না তারা দূরপাল্লার কোনো বাসে বা ট্রাকে চেপে বসেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এক শ্রেণির সদস্য টাকার বিনিময়ে তাদের বাইরে যেতে দেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া অরক্ষিত ক্যাম্পগুলোতে ন্যূনতম কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার কথা থাকলেও তা এখনো বাস্তবায়ন হয়নি।
উখিয়ার বালুখালী ক্যাম্পের কয়েকজন রোহিঙ্গার সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, তাদের নিজেদের কিছু লোক এবং স্থানীয় কিছু বাঙালি মিলে ক্যাম্প ছাড়ার ইন্ধন দিয়ে থাকে। তারা দেশের ভিতরে ভালো বেতনের চাকরি ও কম টাকায় বিদেশে গিয়ে উন্নত জীবন ধারণের প্রলোভন দেখিয়ে রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প থেকে বের করে। এতে কেউ কেউ নিজেদের জমানো টাকা-পয়সা ও সহায়-সম্বলের বিনিময়ে চক্রের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ক্যাম্পের বাইরে গিয়ে সর্বস্ব হারাচ্ছেন। প্রতারিত হয়ে আটকের পর শূন্য হাতেই তাদের আবার ক্যাম্পে ফিরতে হচ্ছে।
দালাল চক্র মালয়েশিয়া, দুবাই, সৌদি আরব, কাতার, কুয়েত, জাপান ও শ্রীলঙ্কায় ভালো চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এদের খপ্পরে পড়ে অনেক রোহিঙ্গা দ্বিতীয়বারের মতো নিঃস্ব হচ্ছে। আবার কোনো কোনো রোহিঙ্গা বাংলাদেশি পাসপোর্ট বানিয়ে বিদেশে গিয়ে নানা অপরাধকর্মে যুক্ত হয়ে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে। এতে শ্রমবাজারে বাঙালিদের সুনাম ক্ষুণ্ণ হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
বিশ্লেষকরা বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সীমানা প্রাচীর দিতে হবে। নইলে তারা অচিরেই দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাবে। ইতিমধ্যে অনেকে ক্যাম্প ছেড়ে দেশের নানা প্রান্ত থেকে নাগরিকত্ব সনদও গ্রহণ করেছে বলে জানা গেছে, যা আমাদের জন্য অত্যন্ত হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে কাজ করছেন এমন কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার সময় সরকারের পক্ষ থেকে হোটেল, রাস্তা, যানবাহনে সার্বক্ষণিক নজরদারি ও তল্লাশির ব্যবস্থা রাখার কথা বলা হলেও বাস্তবে তা অনেকটাই শিথিল।
তারা বলেন, রোহিঙ্গাদের মত কিছু স্থানীয় ব্যক্তিরা পরিস্থিতির জন্য অনেকটা দায়ি। কারণ কম মজুরিতে পাওয়ায় রোহিঙ্গাদের অনেকে নিজেদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, গৃহস্থালী এবং কৃষি ক্ষেত্রে শ্রমিক হিসেবে কাজ করার সুযোগ দেয়। তাই অনেক রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সকল সুবিধা পাওয়ার পরও লোভের বশবর্তী হয়ে কাজের আশায় দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িড়ে পড়ছে। তাই যারা রোহিঙ্গাদের কাজের সুযোগ বা আশ্রয় দিচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫০০
আপনার মতামত জানানঃ