আর্থিক ঋণের বিনিময়ে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের বাংলাদেশে রেখে দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। এই প্রস্তাবে বিশ্বের অন্য উদ্বাস্তুদের মতো রোহিঙ্গাদেরও সমাজের মূল স্রোতে মিশে যাওয়ার অধিকারেরও কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশ ওই ঋণ নিলে বা প্রস্তাবে রাজি হলে রোহিঙ্গারা সব নাগরিক সুবিধা ভোগ করবে এমনকি চাকরি-ব্যবসা করা সহ সারা দেশে চলাচলেরও স্বাধীনতা পাবে।
রোহিঙ্গাদের জন্য সবচেয়ে বেশি সম্পদ ব্যয় করছে বাংলাদেশ। অন্যান্য অনেক দেশ রোহিঙ্গাদের দেখ-ভালের জন্য জাতিসংঘকে অর্থ প্রদান করে। যদিও এই অর্থ প্রদানের পরিমাণ দিন দিন কমে আসছে এবং এর ফলে বাড়তি বোঝা বাংলাদেশের ওপর চাপানোর একটি চেষ্টা আছে বিদেশিদের।
এরই ধারাবাহিকতায় রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অবাধে কাজের সুযোগ করে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। তবে বাংলাদেশ এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করছে। উদ্বাস্তুদের আশ্রিত দেশের সমাজে অন্তর্ভুক্ত বা রেখে দেওয়ার জন্য বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাব মেনে না নিতে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগকে চিঠি দিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে ‘রিফিউজি পলিসি রিভিউ ফ্রেমওয়ার্ক’ শীর্ষক একটি পলিসি পেপার পাঠায়। সেখানে উদ্বাস্তুদের সমাজে অন্তর্ভুক্ত করা যায় কিনা তা জানতে চাওয়া হয়।
মন্ত্রণালয়ের আশঙ্কা বিশ্বব্যাংকের ওই প্রস্তাব মেনে নিয়ে ওই সংস্থা থেকে ঋণ গ্রহণ করলে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর বদলে তাদের বাংলাদেশেই চিরতরে রেখে দিতে হতে পারে। এজন্য ওই প্রস্তাবের পরিবর্তন না হলে উদ্বাস্তু সংক্রান্ত কোনও অর্থ বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে না নেওয়ার লিখিত মতামত পাঠানোর পাশাপাশি অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সঙ্গে বৈঠক করবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
সম্প্রতি অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের কাছে চিঠিতে বিশ্বব্যাংক উল্লেখ করে, ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে কোনও মতামত না পেলে ওই প্রস্তাব সরকার মেনে নিয়েছে বলে তারা ধরে নেবে। বিশ্বব্যাংকের এই রিফিউজি পলিসি রোহিঙ্গাসহ অন্যান্য দেশে অবস্থিত সব উদ্বাস্তুর জন্য প্রযোজ্য। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতামত চাইলে নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করে মন্ত্রণালয়।
এ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন বলেন, বিশ্বব্যাংক কিছু অবজারভেশন দিয়েছে। যার কিছু কিছু আমাদের পছন্দ নয়। তাদের মূল কথা হল রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি কমিউনিটির সঙ্গে ইন্টিগ্রেশন (অন্তর্ভুক্তি) করা। বাংলাদেশ উদ্বাস্তু সংক্রান্ত কনভেনশনে স্বাক্ষর করেনি। তাই আমরা এগুলো গ্রহণ করতে বাধ্য নই।
তিনি বলেন, বিশ্বব্যাংক যেসব ইস্যু এনেছে সেগুলো আমাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে আনেনি। ইউএনএইচসিআর সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের অবজারভেশনের কথা উল্লেখ করলে আমরা বিষয়টি জানতে পারি। তখনই বিষয়টি সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে শুরু করি। বিশ্বব্যাংকের এসব প্রস্তাব আমরা সংশোধন করতে বলেছি।
বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাব মেনে নিলে রোহিঙ্গারা যেকোনও স্থানে চলাচল করতে পারবে, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড অর্থাৎ শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে পারবে বা ব্যবসা করতে পারবে। শুধু তাই না, তাদের নিবন্ধনের আওতায় এনে সামাজিক পরিচয়পত্রও দিতে হবে।
ওই বৈশ্বিক ফ্রেমওয়ার্কের তিনটি উদ্দেশ্য হচ্ছে:
- উদ্বাস্তু ও হোস্ট কমিউনিটির জন্য অর্থনৈতিক সুযোগ তৈরি করা।
- উদ্বাস্তুরা যে দেশে অবস্থান করছে সেই সমাজে অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া অথবা তাদের ফেরত পাঠানো।
- দেশের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা, যাতে করে নতুন উদ্বাস্তুদের আশ্রয় দেওয়া সম্ভব হয়।
এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, আগে জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক ও পশ্চিমা বিশ্বের কিছু দেশ এই তিনটি উদ্দেশ্য আকারে-ইঙ্গিতে বা মুখে বলতো, কিন্তু এই প্রথমবারের মতো তারা বিষয়টি লিখিত আকারে উপস্থাপন করলো।
বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাব মেনে নিলে রোহিঙ্গারা যেকোনও স্থানে চলাচল করতে পারবে, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড অর্থাৎ শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে পারবে বা ব্যবসা করতে পারবে। শুধু তাই না, তাদের নিবন্ধনের আওতায় এনে সামাজিক পরিচয়পত্রও দিতে হবে বলে তিনি জানান।
আরেকজন কর্মকর্তা বলেন, ‘বিদেশি অর্থদাতারা চাইছে রোহিঙ্গাদের উপার্জনের ব্যবস্থা করতে, যাতে করে নিজেদের ব্যয় তারা নিজেরাই মেটাতে পারে। এছাড়া তাদের জন্য শিক্ষা, দক্ষতা বৃদ্ধি, অবাধ চলাচলের বিষয়েও তারা জোর দিচ্ছে।’
এ বিষয়ে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেন, ‘এ বিষয়ে আমাদের অবস্থান পরিষ্কার। তাদের কাছ থেকে অর্থ গ্রহণের জন্য যদি আমরা এসব মেনে নিই তবে আমাদের দীর্ঘমেয়াদি যে লক্ষ্যগুলো আছে সেগুলোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক হতে পারে। এজন্য আমাদের খুব সতর্ক থাকতে হবে।’
আমাদের জন্য তৃতীয় দেশে সেটেলমেন্ট ফিজিবল না। কারণ সংখ্যাটি অনেক বড়। যদি সংখ্যা ৩০ বা ৪০ হাজার হতো তাহলে বিভিন্ন দেশে ভাগ করে দেওয়া যেত। কিন্তু সংখ্যাটি ১০ লাখের ওপরে। এখন পৃথিবীর কোনও দেশ এই পরিমাণ মানুষ নেবে না, এটাই বাস্তবতা।
উদ্বাস্তু সমস্যা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, এটি তিনভাবে সমাধান করা যায়। একটি আছে অন্তর্ভুক্তিকরণ, আরেকটি হচ্ছে তৃতীয় দেশে সেটেলমেন্ট এবং অপরটি হচ্ছে প্রত্যাবাসন ।
তিনি বলেন, আমাদের জন্য তৃতীয় দেশে সেটেলমেন্ট ফিজিবল না। কারণ সংখ্যাটি অনেক বড়। যদি সংখ্যা ৩০ বা ৪০ হাজার হতো তাহলে বিভিন্ন দেশে ভাগ করে দেওয়া যেত। কিন্তু সংখ্যাটি ১০ লাখের ওপরে। এখন পৃথিবীর কোনও দেশ এই পরিমাণ মানুষ নেবে না, এটাই বাস্তবতা।
আরেকটি সমাধান হচ্ছে অন্তর্ভুক্তিকরণ, কিন্তু বাংলাদেশ পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতির দেশ এবং এখানে প্রচুর শ্রমিক আছে। ফলে বাড়তি শ্রমিকের কোনও প্রয়োজন নেই এবং সে সম্ভাবনাও নেই বলে তিনি জানান।
পররাষ্ট্র সচিব বলেন, সুতরাং আমাদের জন্য একমাত্র অপশন হচ্ছে তাদের নিজ ভূমিতে টেকসই ও সম্মানের সঙ্গে প্রত্যাবাসন। অন্তর্ভুক্তিকরণের বিষয়ে জাতিসংঘ বা বিশ্বব্যাংক চিন্তা করতে পারে কিন্তু আমরা এটি করতে পারবো না এবং এটি তাদের বারবার স্মরণ করিয়ে দিতে হচ্ছে।
তিনি বলেন, গতবারই তারা আমাদের যখন এ ধরনের ভাষা বা পয়েন্ট বলেছিল তখন তাদের আমরা বলেছি যে এটি আমাদের পক্ষে করা সম্ভব নয়।
এ প্রসঙ্গে ইআরডির অতিরিক্ত সচিব ও বিশ্বব্যাংক উইংয়ের প্রধান আব্দুল বাকী বলেন, বিশ্বব্যাংক থেকে পাঠানো পলিসি ব্রিফটি শুধু বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য নয়। এটা বিশ্বব্যাপী যেখানে উদ্বাস্তু রয়েছে সেসব দেশের জন্য প্রযোজ্য। এ বিষয়ে সংস্থাটি বাংলাদেশের মতামত জানতে চেয়েছে।
তিনি আরও বলেন, আমরা পররাষ্ট্র, স্বরাষ্ট্র, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কাছে মতামত চেয়েছি। তাদের মতামত পেলে শিগগিরই ইআরডি থেকে বিশ্বব্যাংকের কাছে মতামত পাঠানো হবে। তবে এখন পর্যন্ত শুধু পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ই মতামত দিয়েছে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৬২৩
আপনার মতামত জানানঃ